৬০ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ / ৩০ চৈত্র, ১৪২৯
মাঠ আর মগজের লড়াইয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে পর্যুদস্ত করতে হবে
অর্ণব ভট্টাচার্য
যত দিন যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক শক্তি অক্টোপাসের মতো পুরো সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে চাইছে। আরএসএস এবং বিজেপি’র বিপদ সম্পর্কে সিপিআই(এম)’র কর্মসূচিতে বলা হয়েছেঃ সাম্প্রদায়িক এবং ফ্যাসিবাদী আরএসএস’র নেতৃত্বাধীন জোট কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসায় ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি হয়েছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমের সাম্প্রদায়িকীকরণের সুপরিকল্পিত প্রয়াস চলছে। (৫.৭অনুচ্ছেদ)। ভারতীয় রাষ্ট্র বৃহৎ বুর্জোয়াদের পরিচালিত বুর্জোয়া-জমিদার রাষ্ট্র। আমাদের দেশের শাসকশ্রেণি বর্তমানে সাম্প্রদায়িক আরএসএস-বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ধর্মমোহের মায়াজাল বিছিয়ে, সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি করে জীবন জীবিকার মৌলিক ইস্যু থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার এই কর্মকাণ্ড চলছে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে। বিভেদ ও ঘৃণার রাজনীতির পক্ষে সামাজিক অনুমোদন তৈরি করার জন্য একদিকে মিডিয়ার ওপর নিরঙ্কুশ দখল কায়েম করা হয়েছে, অন্যদিকে শিক্ষার জগৎ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে বৌদ্ধিক আধিপত্য বিস্তার করার নানা কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। বিশেষকরে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের মগজ ধোলাই করার জন্য স্কুলপাঠ্য বইয়ে নানাবিধ পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে।
ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির আজীবন সদস্য ও মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আলথুজার রাষ্ট্রযন্ত্রের দুটি দিক উল্লেখ করেছেন। একটি হলো দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র (Repressive State Apparatus) এবং আরেকটি হলো মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র (Ideological State Apparatus)। দমনপীড়ন এবং মতাদর্শগত আধিপত্যের বিস্তার এই দুইয়ের সমন্বয়ের ভিত্তিতেই আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।পুলিশ, মিলিটারির সাহায্যে দমনপীড়নমূলক কাজ চলে। আর স্কুল, কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠন রাষ্ট্রের মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র হিসেবে কাজ করে।
সমাজে শ্রেণিশাসন ও শ্রেণিশোষণ বজায় রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত বড়ো ভূমিকা পালন করে মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র। মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র মূলত এক ধরনের মানসিক ক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণের মনোজগতের দখল নেয়। মোদির রাজত্বে দমনপীড়নের পাশাপাশি এই মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যাপকভাবে সক্রিয়। তারই সাম্প্রতিকতম নিদর্শন ইতিহাসের সিলেবাস বদলে দেওয়ার সরকারি উদ্যোগ।
সংবাদমাধ্যম দখল করে সাম্প্রদায়িক ভাষ্য ও সংকীর্ণ ধর্মীয় আবেগ ছড়িয়ে যে বিভাজনের রাজনীতির পক্ষে পরিপূর্ণ সামাজিক সম্মতি আদায় করা যাবে না - তা জানে শাসকশ্রেণি। তাই দীর্ঘমেয়াদি ফল লাভ করার লক্ষ্যে ইতিহাসের ওপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।
এনসিইআরটি’র তৈরি দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে বাদ পড়ছে ‘‘কিংস অ্যান্ড ক্রনিকলস; মুঘল কোর্ট’’ এই অধ্যায়টি। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন ইতিহাস সচেতন, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। এ প্রসঙ্গে কড়া বিবৃতি দিয়েছেন রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব, মৃদুলা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ইতিহাসবিদ।
এনসিইআরটি-র তরফে পড়ুয়াদের চাপ কমানোর যে অজুহাত দেওয়া হয়েছে, তা খারিজ করে দিয়েছেন ইতিহাসবিদরা। রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিবদের মতে, পাঠ্যপুস্তক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য মুছে দিয়ে ‘ছদ্ম ইতিহাস’ রচনা করা হচ্ছে। তাঁরা আরও বলছেনঃ ‘‘হোয়াটসঅ্যাপ সহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ইতিহাস’ তৈরির প্রবণতা চলছে।’’ ইতিহাসবিদরা প্রশ্ন তুলেছেনঃ ‘‘এখন তো আর দেশে কোভিড পরিস্থিতি নেই। এখন তো স্কুলে পড়াশোনাও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে গিয়েছে। তাহলে কেন পাঠ্যবিষয়ে কাটছাঁট করা হচ্ছে? এগুলো স্রেফ অজুহাত।’’
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা এনসিইআরটি-র এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমেই ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাস সচেতন করা তোলা উচিত। সেই পথ থেকে সরে এসে যদি পাঠ্যবস্তু কাটছাঁট করা হতে থাকে, তাতে ছদ্ম ও একপেশে ইতিহাস তৈরি করা হবে।
অবশ্য ইতিহাস পরিবর্তনের কর্মসূচি বিজেপি অনেক আগেই গ্রহণ করেছে। বাজপেয়ী জমানাতেই এই কাজ শুরু হয়। আইসিএইচআর-এর মতো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে আরএসএস’র লোক বসিয়ে ইতিহাস বিকৃতি চলতে থাকে। রাজস্থানের বসুন্ধরা রাজের সরকার হলদিঘাট যুদ্ধের ইতিহাস পালটে দেয়। বিজেপি শাসিত এই রাজ্যে পড়ানো হতো হলদিঘাটের যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন মহারানা প্রতাপ সিংহ। পরাজিত হয়েছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। রাজস্থানের পরে পরেই তৎকালীন বিজেপিশাসিত মহারাষ্ট্র সরকার স্কুলের ইতিহাস বই থেকে মুঘল সাম্রাজ্য সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সম্প্রতি রাজ্যের অষ্টম ও নবম শ্রেণির ইতিহাস পাঠ্যবই সংশোধন করেছে মহারাষ্ট্র সরকার। সংশোধিত পাঠ্যবইয়ে মুঘল সাম্রাজ্য সম্পর্কে কার্যত কোনো তথ্যই নেই। এভাবে ঐতিহাসিক তথ্যকে মতাদর্শগত প্রয়োজনে পরিবর্তিত করা বা মুছে ফেলা হচ্ছে।
তবে এনসিইআরটি-র সিদ্ধান্তে কেবল কিছু ঐতিহাসিক তথ্য মুছে দেওয়া হচ্ছে তাই নয়, ইতিহাসের যে ধারা বহমান তার সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করার চক্রান্ত চলছে। মুঘল যুগে সম্রাটের সাথে ধর্মীয় নেতৃত্ব বা উলেমাদের বাদানুবাদ, মিশ্র সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা, মুঘল চিত্রকলার বিকাশের মতো এমন অনেক বিষয় এই বাদ পড়ে যাওয়া অধ্যায়ে ছিল যাতে মুঘল শাসকদের বহিরাগত, ধর্মান্ধ, লুঠেরা বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। অথচ এভাবেই আরএসএস এবং তার শাখা সংগঠনগুলি মুঘল শাসকদের চিত্রিত করে এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ‘বাবর কি আওলাদ’ বলে চিহ্নিত করে তাঁদের সম্পর্কে ঘৃণা ছড়াতে চায়। এই ঘৃণার ভাষ্য ছড়িয়ে দেওয়ার স্বার্থে মতাদর্শগত রাষ্ট্রযন্ত্র হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করছে আর এস এস।
এছাড়াও দ্বাদশ শ্রেণির সিভিকস বইয়ের বেশ কিছু বিষয় পরিবর্তন করছে এনসিইআরটি। ‘আমেরিকান হেজিমনি ইন ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স’ এবং ‘দ্য কোল্ড ওয়ার এরা’ - নামের দুটি অধ্যায় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া একাদশ শ্রেণির ইতিহাস বই ‘থিমস ইন ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’ থেকে ‘সেন্ট্রাল ইসলামিক ল্যান্ডস’ ‘কনফ্রনটেশন অফ কালচারস’, ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভেলিউশন’ অধ্যায়গুলি বাদ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে দ্বাদশ শ্রেণির বইয়ে ‘স্বাধীনতার পরে ভারতীয় রাজনীতি’ থেকে ‘জনপ্রিয় আন্দোলনের উত্থান’ এবং ‘এক পক্ষের আধিপত্যের যুগ’ নামে দুটি অধ্যায়ও পরিবর্তন করা হয়েছে। পাশাপাশি দশম এবং একাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে আর থাকবে না ‘গণতন্ত্র এবং বৈচিত্র্য’, ‘জনপ্রিয় সংগ্রাম ও আন্দোলন’ এবং ‘গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ’ বিষয়ক অধ্যায়গুলি। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ ও বৃহৎ দেশীয় বুর্জোয়াদের পক্ষে অস্বস্তিকর বিষয়গুলি বাদ পড়ছে। গণতন্ত্র, বহুত্ববাদের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তির চিরকালই সংঘাত চলছে। আর একইসাথে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে ছাত্রছাত্রীদের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি সম্পর্কে অন্ধকারে রাখা হচ্ছে যাতে তাদের দেশ-কাল-পৃথিবী সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা গড়ে না ওঠে।
শিক্ষা যেহেতু সংবিধানের যুগ্ম তালিকায়, তাই কেন্দ্রের এই অন্যায় আগ্রাসন রুখতে অ-বিজেপি রাজ্য সরকারগুলির সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া দরকার। তবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে বামপন্থীদের।
এরপর কোপ পড়তে পারে তুর্কি, আফগানদের সময়কালও। এর ফলে দেশের ইতিহাসটাই এক খাপছাড়া আখ্যান হয়ে উঠবে যা কীনা হরপ্পা-মহেঞ্জোদরোর সময় থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ভারতীয় সভ্যতার বৈচিত্র্যময়, বহুত্ববাদী ধারাকে প্রতিফলিত করবে না। দলিল, শিলালিপি, লেখ, প্রত্নসামগ্রী ইত্যাদির ভিত্তিতে যে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চা করা হয় তাকে ধ্বংস করে মনগড়া কাহিনিকে ইতিহাস বলে চালানোর জন্য এভাবে জমি প্রস্তুত করা হচ্ছে। মানুষের চেতনাকে অবরুদ্ধ করার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে জ্ঞানচর্চার জগতে এই ভয়ঙ্কর আগ্রাসনকে রুখতে হবে।
সবশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গত ৫ এপ্রিল দেশের রাজধানীতে শ্রমিক-কৃষকদের এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে যা কোনো গুরুত্বপূর্ণ টিভি চ্যানেলে দেখানো হয়নি। মেহনতি জনতার ঐক্য সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো বাধার প্রাচীর। করপোরেটের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া ইচ্ছে করেই এই সমাবেশের খবর সম্প্রচার করেনি, করার কথাও না। কেননা রাম-রহিমের বিরোধাভাস বজায় রাখতে হলে মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াইকে চোখের আড়ালে রাখাই শাসকশ্রেণির নীতি। তাই মগজ আর মাঠের লড়াই একসূত্রে গাঁথা। দুই লড়াইয়েই আমাদের জয় ছিনিয়ে আনতে হবে।