৫৮ বর্ষ প্রথম সংখ্যা / ১৪ আগস্ট ২০২০ / ২৯ শ্রাবণ ১৪২৭
ভারত বাঁচাও দিবসে দেশজুড়ে ধ্বনিত হয়েছে সরকারি নীতির তীব্র প্রতিবাদ
৯ আগস্ট দিল্লিতে শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনগুলির বিক্ষোভ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেন্দ্রের দেশবিরোধী-জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এবং করোনার ভয়াবহ সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীর জীবন-জীবিকা রক্ষার দাবিতে ৯ আগস্ট দেশজুড়ে ঐক্যবদ্ধভাবে ‘ভারত বাঁচাও দিবস’ পালন করলেন অগণিত শ্রমজীবী মানুষ। ঐতিহাসিক ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের দিনটিতে দেশের গ্রাম-শহর-শিল্পাঞ্চল সর্বত্র কর্পোরেটদের হাতে দেশের মহামূল্যবান সম্পদ বেচে দেওয়ার বিরুদ্ধে এবং করোনা অতিমারী মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য এই প্রতিবাদ দিবসের ডাক দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির জাতীয় মঞ্চ এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলি। এদিন স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কেন্দ্রের মোদী সরকারের দেশবিরোধী, জনবিরোধী, শ্রমিক ও কৃষকবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে কারখানার গেটে, কর্মস্থলে, শ্রমিক সংগঠনের অফিস এবং রাজপথে সমবেত হয়ে শ্রমজীবীরা প্রতিবাদে সরব হন। শ্রমিক-কৃষকের এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন ছাত্র, যুব, বস্তিবাসী, মহিলা, কর্মচারী, আইনজীবী ও চিকিৎসকরা। এদিন দেশের এক লক্ষেরও বেশি জায়গায় এই কর্মসূচিতে অংশ নেন ১ কোটিরও বেশি মানুষ।
এদিনের এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে শ্রমজীবী মানুষ অংশ নিয়ে ‘ভারত বিক্রির জন্য নয়’, ‘কর্পোরেট লুট বন্ধ করো’, ‘কর্পোরেট লুটেরারা ভারত ছাড়ো’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে দিনভর নানা কর্মসূচি পালন করেন। তাঁরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সত্যাগ্রহ, জেল ভরো, মিছিল, জনসভা ইত্যাদির মাধ্যমে কেন্দ্রের মোদী সরকারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
রাজধানী দিল্লি, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, জম্মু-কাশ্মীর, কেরালা, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, ওডিশা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের সর্বত্র ‘ভারত বাঁচাও দিবস’ কর্মসূচিতে ভালো সাড়া পড়ে। বহু জায়গাতেই আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশি বাধা, জুলুম ও ধরপাকড়ের মধ্যেও ত্রিপুরায় সিআইটিইউ, কৃষকসভা, খেতমজুর ইউনিয়ন এবং জিএমপি’র উদ্যোগে ব্যাপক অংশের বামপন্থী মানুষ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন। রাজ্যের ২৩টি মহকুমার ১২১টি জায়গায় এই প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত হয়েছে। মুম্বাইয়ের ঐতিহাসিক আজাদ ময়দানে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির উদ্যোগে বিরাট সমাবেশ হয়েছে।
রাজধানী দিল্লিতে যন্তর মন্তরের কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন, এআইইউটিইউসি’র সাধারণ সম্পাদক অমরজিৎ কাউর, আইএনটিইউসি’র সহ সভাপতি অশোক সিং, এআইটিইউসি’র জাতীয় সম্পাদক আর কে শর্মা, এলপিএফ’র জওহর সিং, এআইসিসিটিইউ’র রাজীব ডিমরি, এআইকেএসসি’র আহ্বায়ক ডি এম সিং প্রমুখ। এছাড়া এই কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন সিআইটিইউ’র সভাপতি কে হেমলতা, সারা ভারত কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম ধাওয়ালে, শ্রমিক নেতা এম এল মালকোটিয়া, স্বদেশ দেবরায়, এ আর সিন্ধু, অমিতাভ গুহ, কৃষক নেতা বিজু কৃষ্ণণ, পি কৃষ্ণপ্রসাদ প্রমুখ। এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যে এই আন্দোলনে যোগ দেন আইএনটিইউসি’র সভাপতি সঞ্জীব রেড্ডি, এসইডব্লিউএ’র মানালি শাহ, ইউটিইউসি’র অশোক ঘোষ, টিইউসিসি’র শিবশঙ্কর এবং দেবরাজন প্রমুখ।
এদিন দেশজুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলনে বিপুল সংখ্যায় যোগ দেওয়ায় শ্রমজীবী মানুষকে এক বিবৃতিতে অভিনন্দন জানিয়েছেন সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন এবং সারা ভারত কৃষক সভার সভাপতি অশোক ধাওয়ালে এবং সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা। এদিন দেশের কয়েকটি প্রান্তে স্থানীয়ভাবে লকডাউন থাকায় আগের দিন অর্থাৎ ৮ আগস্ট এবং কর্মসূচির পরের দিন ১০ আগস্ট এই কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
করোনা অতিমারীজনিত কারণে দেশের অন্তত ২৪ কোটি মানুষের কাজ চলে গেছে। ৪০ কোটি মানুষ তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েছেন। এই পরিস্থিতিতে রেল, এয়ার ইন্ডিয়া, প্রতিরক্ষা, ব্যাঙ্ক, বিমা, টেলিকম, কয়লা ব্লক প্রভৃতি রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র একের পর এক কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে চক্রান্ত করছে কেন্দ্রের সরকার। মুখে ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর গালভরা বুলি আউড়ে করোনা পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ওপর আক্রমণ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিগত ২ মাসে ২২ বার পেট্রোপণ্যের দাম বাড়িয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে চড়া হারে। দেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী গরিব সাধারণ মানুষের সর্বনাশ করে কেন্দ্রের সরকার শুধুমাত্র তাদের কর্পোরেটবান্ধব ও কাছের বৃহৎ ব্যবসায়ীদের মুনাফা সুনিশ্চিত করতে চাইছে। তারই প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে এদিনের কর্মসূচিতে।
দেশব্যাপী এই আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে ৯ আগস্ট ‘ভারত বাঁচাও দিবস’-এ কলকাতা সহ রাজ্যের সর্বত্র বিক্ষোভসভা, মিছিল, প্রতিবাদসভায় অংশ নেন শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব, মহিলা সহ বিভিন্ন গণসংগঠনের কর্মীবৃন্দ। এদিন শুধুমাত্র কলকাতা শহরেই মোট ৭২টি জায়গায় এই প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত হয়েছে।
এদিন বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন এবং গ্রামাঞ্চলে সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির ডাকে ৯ দফা দাবিতে এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, উত্তর দিনাজপুর, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, নদীয়াফ, পুরুলিয়া, হুগলি, হাওড়া, বর্ধমান জেলা সহ বিভিন্ন স্থানে, ব্লকে, গঞ্জে, সভা-মিছিল ইত্যাদি সংগঠিত হয়েছে।
এদিন কলকাতায় গান্ধী মূর্তি এবং রানুছায়া মঞ্চের সামনে দু’টি বিক্ষোভসভা অনুষ্ঠিত হয়। সিআইটিইউ, এআইটিইউসি, ইউটিইউসি, টিইউসিসি, এআইইউটিইউসি, এআইসিসিটিইউ, আইএনটিইউসি, এইচএমএস, ১২ই জুলাই কমিটি, বিইএফআই, বিএসএনএলসিসি, ইআরএমইউ, ডিফেন্স ফেডারেশন, এলআইসিইএ সহ ছাত্র, যুব, মহিলা, বস্তি সংগঠনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। রানুছায়া মঞ্চের সামনে পুলিশের আপত্তি অগ্রাহ্য করেই সভা করেন প্রতিবাদীরা। গান্ধী মূর্তির সামনে বিক্ষোভসভায় বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ’র রাজ্য সভাপতি সুভাষ মুখার্জি, দীপক দাশগুপ্ত, টিইউসিসি নেতা প্রবীর ব্যানার্জি, ইউটিইউসি নেতা অশোক ঘোষ, এআইটিইউসি নেতা অরুণ চট্টরাজ, আইএনটিইউসি নেতা কামারুজ্জমান কামার প্রমুখ। রানুছায়া মঞ্চের সামনে প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ নেতা দেবাঞ্জন চক্রবর্তী, নিরঞ্জন চ্যাটার্জি সহ অতনু চক্রবর্তী, বাসুদেব বসু প্রমুখ।