E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ প্রথম সংখ্যা / ১৪ আগস্ট ২০২০ / ২৯ শ্রাবণ ১৪২৭

দেশহিতৈষী’র প্রতিষ্ঠা দিবসকে স্মরণে রেখে

বিমান বসু


দেখতে দেখতে দেশহিতৈষী সাপ্তাহিক ৫৭ বছর নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ৫৮ বছরে পা দিল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে মতাদর্শগত বিতর্কের এক বিশেষ পর্বে এই পত্রিকার আত্মপ্রকাশ।

পার্টির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক কমরেড হর‍‌কিষেণ সিং সুরজিৎ দেশহিতৈষী’র ৪০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে এক লেখায় যথার্থভাবে উল্লেখ করেছিলেনঃ ‘‘দেশহিতৈষী’র আবির্ভাব এবং প্রসার পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)’র জন্ম এবং অগ্রগতির একটি মাপকাঠি। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে যে প্রচণ্ড সংগ্রাম চলছিল সিপিআই(এম) গঠিত হওয়াটা ছিল তারই পরিণতি। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের রণনীতিগত লক্ষ্য কী হবে এবং তা অর্জনের জন্য কী রণকৌশল গ্রহণ করতে হবে, সেটিই ছিল অন্তঃপার্টি বিরোধের মূল বিষয়। সংক্ষেপে, সেই সংগ্রাম ছিল মার্কসবাদ-‍‌লেনিনবাদকে রক্ষা করার এবং আমাদের দেশে বাস্তব পরিস্থিতির উপযোগী করে তাকে প্রয়োগ করার।’’ উল্লেখ্য, দেশহিতৈষী পত্রিকা প্রকাশের সময় আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে দৈনিক কোনো পত্রিকা হাতে ছিল না। একমাত্র দেশহিতৈষী ছিল আমাদের সাপ্তাহিক মুখপত্র।

১৯৬৩ সালে রাজ্যের ১৬টি জেলার রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কার্যকলাপ, আন্দোলন-সংগ্রামের রিপোর্টিং ও আশু কর্মসূচির ব্যাপক প্রচারের লক্ষ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের প্রতিষ্ঠিত অধ্যাপক মোহিত মৈত্রকে সভাপতি করে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আন্দামান ফেরত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড সুধাংশু দাশগুপ্তকে সম্পাদক করে পত্রিকা প্রথম প্রকাশ হয়েছিল। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ এক শুভেচ্ছাবার্তায় বলেছিলেনঃ ‘‘দেশহিতৈষী যেন সত্যিই মেহনতী মানুষের মুখপত্র হয় এবং ধনিক-বণিক-জমীদারী সরকারের লেজুর না হয়, সেইদিকে আপনারা সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন।’’ দেশহিতৈষী পত্রিকার অন্য ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও একথা বলতেই হবে, কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গির কথা মান্য করেই দেশহিতৈষী পথ চলছে।

দেশহিতৈষী পত্রিকা প্রকাশের তিন বছরের মাথায় কমরেড সমর মুখার্জি ধারাবাহিকভাবে মতাদর্শগত একটি ব্যাখ্যামূলক প্রবন্ধ ওই সাপ্তাহিকে লিখেছিলেন। তখনকার সময়ে ওই লেখা ছিল অশোক মুখার্জির নামে, যা পরে পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। পুস্তিকাটির নাম ছিল ‘সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও সঙ্কীর্ণতাবাদী ঝোঁক’ - এই প্রবন্ধটি সেইসময় সঙ্কীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রামে পার্টিকর্মীদের সাহায্য করেছিল।

৫৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর বিশেষ লগ্নে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এবং জাতীয় ক্ষেত্রের পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে রাজ্য রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের কার্যকলাপ সম্পর্কে দেশহিতৈষী পত্রিকাকে তার ইতিহাস-নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের লক্ষ্য নিয়েই প‍‌থ চলতে হবে। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের আক্রমণে জনজীবন বিপর্যস্ত। কিন্তু, সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি ও মুনাফা-লালসা অব্যাহত। ইতিমধ্যেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভারত রাষ্ট্রকে তাদের জুনিয়র পার্টনার হিসেবে গড়ে তোলার কাজ সম্পন্ন করছে। ভারতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রত্যক্ষ মদতে ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার দেশের সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে ধ্বংস করে তথাকথিত হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে তোলার কর্মসূচি নিয়ে চলতে চাইছে। একদিকে কোভিড ১৯ অতিমারীর আক্রমণ অন্যদিকে ধর্ম-বর্ণ-জাতি ও ভাষার বিভাজনের অবাঞ্ছিত পরিবেশ। সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সামনে বিপদ তৈরি করছে। দেশের সরকার ঐক্য সংহতি সম্প্রীতির মহান আদর্শকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিক-কৃষক-কর্মচারী সহ সব অংশের মেহনতকারী মানুষ দেশ বাঁচানোর স্লোগানে মুখরিত।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বেকারের দেশ আমাদের ভারত। ভারতে কয়েক মাস আগেও যাঁরা কর্মরত ছিলেন তাঁদের একটা উ‍‌‍‌ল্লেখ্যযোগ্য অংশ কাজ হারিয়ে নতুন করে বেকার হয়েছেন। সারা দেশের অর্থনীতির অবস্থা বিপর্যস্ত। আমাদের রাজ্যের অবস্থাও ভালো নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা এবং সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি।

উদ্ভূত এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, কৃষক-খেতমজুর সংগঠনসহ অন্যান্য নানা সংগঠন মিলিতভাবে সারা দেশের মতো আমাদের রাজ্যেও কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নানা জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-মুখর হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসের দিন সকলেই মিলিতভাবে সংবিধান ও সংবিধানের মর্মবস্তু বাঁচানোর লড়াইতে বদ্ধপরিকর।

বিজেপি’র নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার স্বাবলম্বী অর্থনৈতিক নীতি কার্যকর করার কথা ঘোষণা করছে আর গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বেসরকারিকরণসহ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের দরজা সটান খুলে দেওয়ার কর্মসূচি কার্যকর করতে ব্যস্ত রয়েছে। এই অবস্থায় দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য। আবার রাজ্য সরকার রাজ্যের উন্নয়নের মিথ্যা ফিরিস্তি দিয়ে দুর্নীতিমূলক কাজে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এই উভয়বিধ সমস্যার বিরুদ্ধে আমাদের সব ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তুলতেই হবে।

এবার দেশহিতৈষী প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে প্রত্যাশা করব দেশের জনগণের সঙ্গে রাজ্যবাসী যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে তার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণাত্মক লেখা পাঠক-পাঠিকার সামনে তুলে ধরবার কাজে দেশহিতৈষী যুক্ত থাকবে। দেশহিতৈষী’র বহুল প্রচার কামনা করছি।