৫৮ বর্ষ প্রথম সংখ্যা / ১৪ আগস্ট ২০২০ / ২৯ শ্রাবণ ১৪২৭
কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী অমর রহে
দীপক দাশগুপ্ত
মানুষ মরণশীল। এটা বৈজ্ঞানিক সত্য, সকলেই জানেন এই বৈজ্ঞানিক সত্য। মৃত্যুর পরেও কিছু কিছু ব্যক্তি বেঁচে থাকেন তাঁদের কৃতকর্মের জন্য। কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী - এ রাজ্যের ও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রের শীর্ষস্থানীয় শ্রমিক নেতা, পূর্বতন ছাত্র নেতা এবং গণআন্দোলনের প্রথম সারির নেতা, সেভাবেই রাজ্য তথা সারা দেশের শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের হৃদয়ে তিনি চিরজাগরুক থাকবেন।
তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে সংশোধনবাদ ও সংকীর্ণতা এবং বামপন্থী হটকারিতা-বিরোধী সংগ্রামে যোগ্য ও দক্ষ সেনা হিসাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মতাদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন।
একইভাবে সত্তর দশকে এরাজ্যে কংগ্রেসের সরকারি আধা-ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস ও জরুরি অবস্থা জারির নামে যে তানাশাহী স্বৈরতন্ত্র ইন্দিরা সরকার চালু করেছিল, তার বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সামনের সারির একজন যোদ্ধা ছিলেন তিনি।
।। দুই ।।
প্রয়াত কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, মার্কসবাদী মতাদর্শকে যথাযথ প্রয়োগের জন্য আমাদের দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, আর্থসামাজিক ব্যবস্থাগুলি জানা ও বোঝা প্রয়োজন। তিনি বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারতীয় সমাজ, সভ্যতা, সম্প্রদায়, জাতপাত, ধর্ম, বর্ণগত সমস্যা প্রভৃতি বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতেন নিয়মিত। এ ব্যাপারে অনেকগুলি বইও তিনি লিখেছিলেন। বর্তমানে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদী শাসনের স্বরূপ উদ্ঘাটনের জন্য নিয়মিত বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখে ফ্যাসিস্ট হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির মুখোশ খুলে দিয়েছেন। এই সমস্ত বই ও প্রবন্ধগুলি আমাদের কমরেডদের ও সাধারণ পাঠকদের সচেতন করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। শ্যামল চক্রবর্তী প্রধানমন্ত্রী মোদীর ফ্যাসিস্ট ও সাম্প্রদায়িক নীতি ও কাজের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার থেকে সংগঠিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন।
।। তিন ।।
ষাটের দশকের সূচনায় আমি ছাত্র আন্দোলন ও পার্টির সঙ্গে যুক্ত হই। ওই সময় কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যেকার মতাদর্শগত সংগ্রামের প্রভাব পার্টির সঙ্গে সঙ্গে গণসংগঠন বিশেষ করে এআইএসএফ এবং বিপিএসএফ’র মধ্যেও পড়েছিল। বিপিএসএফ’র মধ্যে মতাদর্শগত সংগ্রাম বহুদিন যাবত চলেছিল। আমাদের রাজ্যে মতাদর্শগত সংগ্রাম একদিকে, অপরদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম, ভিয়েতনামের ওপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অভূতপূর্ব আগ্রাসন, নাপাম বোমার ব্যাপক বর্ষণের বিরুদ্ধে, শিক্ষাগত সমস্যা সহ শিক্ষান্তে চাকুরি, ট্রামভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের মধ্যেকার ক্ষোভকে ব্যাপক আন্দোলনের দ্বারা রাজ্যের ও কেন্দ্রের সরকারগুলির গণভিত্তিকে টলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তখন রাজ্যে উদীয়মান ছাত্র আন্দোলনকে পরিচালনার কাজে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী ও কমরেড সুভাষ চক্রবর্তী। তখনকার ছাত্র নেতৃত্বের মধ্যে দীনেশ মজুমদার, সুবিনয় ঘোষ, হরিনারায়ণ অধিকারী ও বিমান বসু আগে থেকেই ছিলেন। উদীয়মান নেতৃত্বের সঙ্গে কমরেড প্রফুল্ল চক্রবর্তী ও আমি যুক্ত থাকলেও আমরা প্রধান ভূমিকায় ছিলাম না।
।। চার ।।
ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিচয় হলেও অল্পদিনের মধ্যে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী সহ অন্যান্য রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমার। ১৯৬৭ সালে শ্রীরামপুর সম্মেলন থেকে আমি কিছুটা জোর করেই ছাত্র আন্দোলন ছেড়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে যুক্ত হয়ে যাই। আজও আমি ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের কাজ করে চলেছি।
পরবর্তী সময়ে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী ও কমরেড সুভাষ চক্রবর্তী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে যুক্ত হন। কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক শিল্পের ইউনিয়ন যেমন বিদ্যুৎ, পোর্ট এবং ডক ইউনিয়ন, ট্রান্সপোর্ট ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন ও পরবর্তী সময়ে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। এছাড়াও রাজ্যের বহু ইউনিয়নের কাজে সহায়তা করতেন। ২০০৩ সালে সিআইটিইউ রাজ্য কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন ও প্রথমে কালী ঘোষ এবং পরবর্তী সময়ে আমি সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ওঁর সঙ্গে কাজ করেছি। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দিন পর্যন্ত শ্যামলবাবু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ও সংগঠনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসাবে ভূমিকা পালন করেছেন। আমি প্রথম থেকেই তাঁর নেতৃত্বে থেকে কাজ করেছি। উনি সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করেছেন। আমি সিআইটিইউ-র ত্রয়োদশ সর্বভারতীয় সম্মেলন থেকে জাতীয় ক্ষেত্রে কর্মকর্তা হিসাবে নির্বাচিত হই এবং এ রাজ্যের শ্রমিক আন্দোলন পরিচালনা করতে তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছি।
।। পাঁচ ।।
১৯৯১ সালে আমাদের দেশে নয়া-উদারনীতি চালু হওয়ার পর শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে পরিবর্তন আসে। বিশালসংখ্যক অসংগঠিত শিল্প গড়ে ওঠে, এবং কোটি কোটি শ্রমিক কাজ করতে থাকেন। অবিসংবাদিত শ্রমিক ও কমিউনিস্ট নেতা কমরেড বি টি রণদিভে তাঁদের সংগঠিত করা ও আন্দোলন গড়ে তুলতে অগ্রাধিকার দিতে বলেন। সেই অনুযায়ী আমাদের রাজ্যে অসংগঠিত শ্রমিকদের সংগঠন গড়ে তোলার ওপর প্রয়াত কমরেড মৃণাল দাস ও বেশ কয়েকজন ছাত্র ফ্রন্ট থেকে আসা কর্মীও উক্ত কাজে সক্রিয়তার সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন। ২০০৩ সালে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী সিআইটিইউ’র রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সভাপতি হিসাবে তাঁর মেধাকে অসংগঠিত শ্রমিকদের সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তিনি সিআইটিইউ এবং পার্টিতে বারবার জোর দিয়ে বলতেন গ্রামাঞ্চলেও যেহেতু ব্যাপক সংখ্যায় অসংগঠিত শিল্পগুলির প্রসার ঘটছে, তাই সেখানেও কর্মরত শ্রমজীবী মানুষকে নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলা প্রয়োজন।
অসংগঠিত শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য সংগঠনের দু’বার রাজ্য সম্মেলনে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী অসংগঠিত শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সংগঠিত করার জন্য লিখিত নোট পেশ করেছেন, এবং প্রতিনিধিরা দীর্ঘসময় ধরে তা আলোচনা করেছেন। একইভাবে প্যারাটিচার, এসএসকে, এমএসকে, শিশু শ্রমিক ও ভোকেশনাল কর্মীদের নিয়ে রাজ্যে মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মী ইউনিয়ন গড়ে তোলার প্রশ্নে প্রধান নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। প্রশান্ত নন্দীচৌধুরী, কমরেড সুভাষ মুখার্জি ও মধুমিতা ব্যানার্জিও তাঁর সহযোগী হিসাবে ভূমিকা পালন করেছিলেন। ২০১৫ সালে আমাদের রাজ্যে শতাধিক গণসংগঠনকে নিয়ে যে বেঙ্গল প্ল্যাটফর্ম অব মাস অর্গানাইজেশন (বিপিএমও) গড়ে ওঠে, কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী ছিলেন তার অন্যতম মূল কারিগর।
২০১২ সালে হাওড়ায় অনুষ্ঠিত সিআইটিইউ’র রাজ্য সম্মেলন থেকে আমাকে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত করা হয় ও কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী সভাপতি হিসাবে পুনর্নির্বাচিত হন। ঐ সময়ে শ্যামল চক্রবর্তীর সঙ্গে কাজ করার ফলে আমার আরও গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
।। ছয় ।।
কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী ছিলেন প্রকৃত অর্থে গণআন্দোলনের নেতা, তিনি কঠিন ও জটিল পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে সাহসী ও দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থান গ্রহণ করতেন। কেবলমাত্র গণআন্দোলন ও গণসংগঠন গড়ে তোলার কাজই তিনি করতেন না, সাংসদ হিসাবে এবং রাজ্যের মন্ত্রীসভার দায়িত্বশীল সদস্য হিসাবে জনস্বার্থে সমান দক্ষতাপূর্ণ ও সৃজনশীলভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন। সর্বস্তরের কর্মী ও মানুষের সঙ্গে তাঁর মেলামেশা ছিল। তাঁর জীবনাবসান আমাদের শ্রমিক ও গণআন্দোলনে এক শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। আমাদের সবাইকে মিলে তা পূরণ করতে হবে। তাঁর কন্যা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী লাল সেলাম। কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী অমর রহে। শ্যামল চক্রবর্তী শ্রমিক ও গণআন্দোলনের মধ্যে অমর হয়ে থাকবেন।