৫৮ বর্ষ প্রথম সংখ্যা / ১৪ আগস্ট ২০২০ / ২৯ শ্রাবণ ১৪২৭
কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী - বেঁচে থাকবে আন্দোলন, লড়াইয়ের মধ্যেই
বিমান বসু
সুভাষ চক্রবর্তী, বিমান বসু, শ্যামল চক্রবর্তী।
কমরেড শ্যামলের চলে যাওয়া ব্যক্তিগতভাবে শুধু আমার কাছে নয়, আমাদের পার্টিরও ক্ষতি। একজন দক্ষ, জনপ্রিয় সংগঠক ছিলেন।
লড়াই সংগঠনের প্রতি স্তরে যেমন যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন, তেমনই আবার পরিবহণ দপ্তরের মন্ত্রী হিসাবে পরিষদীয় রাজনীতিতেও স্বাক্ষর রেখে গেছেন কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী।
কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দীনেশ মজুমদার, সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল ও আমি, সেই সময় আমরা একটা ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মধ্যে ছিলাম। তা একদিকে যেমন ছিল প্রবল রাজনৈতিক, একইসঙ্গে ব্যক্তিগত অনুভূতি, ঘটনাও আমরা একে অপরকে বলতাম। শ্যামল-সুভাষ একসঙ্গে অনেক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। ওঁদের ওই সম্পর্ক শুরু হয়েছিল দমদম মতিঝিল কলেজ থেকে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই কমিউনিস্টদের এগোতে হয়।
কমরেড শ্যামলের ব্যবহার, ওঁর কথা বলার ধরনের কারণেই হয়তো কেন জানি আমার মা খুবই পছন্দ করতেন ওঁকে। মা যাদের খুব ভালোবাসতেন, একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী।
আজকে একটা ঘটনা মনে পড়ছে। একবার আমাদের বাড়িতে অনেকে গেলেন আমার সঙ্গেই। বাড়িতে কোনো একটা অনুষ্ঠান ছিল, এখন মনে পড়ছে না। খাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল। মা পায়েস করেছিলেন। অন্যান্য খাওয়া হয়ে গেলে মা সবাইকে পায়েস খেতে দিয়েছেন। কাউকে ছোটো বাটিতে, কাউকে মাঝারি বাটিতে। তো শ্যামল খাওয়া শেষ করেই মা’কে বলল, ‘মাসিমা পায়েস কি শেষ হয়ে গেছে, নাকি একটু আছে বেঁচে?’ মা বুঝলেন ও কী বলতে চাইছে। আবার দিলেন পায়েস। খুবই তৃপ্তি করে খেত শ্যামল।
পার্টি, গণসংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে আমরা বিভিন্ন সময়ে একসঙ্গে গিয়েছি। শ্যামলের একটা বড় গুণ ছিল - যেমন দক্ষ সংগঠক ছিল, যেমন বক্তৃতা করতে পারতেন, তেমনি ছিল ওঁর লেখার হাত। আমি মনে করি, শ্যামল যদি শুধুমাত্র সাহিত্য চর্চাই করত, তাহলে বড়ো মাপের একজন সাহিত্যিক হতে পারত। একাধিক রাজনৈতিক বিষয়ে ও যেমন প্রবন্ধ লিখত বিভিন্ন পার্টি পত্র-পত্রিকায়, পরে সেই প্রবন্ধকে আরেকটু বাড়িয়ে, গুছিয়ে সেটা বই আকারেও লিখত। ওঁর শব্দ চয়নে অদ্ভুত পারদর্শিতা ছিল। কাশ্মীর বিষয় থেকে ভারতের জাতি, বর্ণ এবং ধর্মীয় বিভাজনের সামাজিক অবস্থান ব্যাখ্যা করতে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছে। পরে সেগুলি আবার বই আকারেও প্রকাশ করেছে। গভীর রাজনৈতিক বিশ্লেষণাত্মক লেখায় পারদর্শিতা ছিল। আরও একটা বিষয় ছিল, তা হলো ওঁর লেখায় আবেগ থাকত। যে কোনো লেখার সঙ্গে যুৎসই কবিতার লাইন যুক্ত করে তাকে যথাযথভাবে উপস্থিত করার দক্ষতা ছিল কমরেড শ্যামলের।
ছাত্র আন্দোলনের এক উল্লেখযোগ্য বিশিষ্ট নেতা ছিলেন কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী। পশ্চিমবঙ্গে ষাট ও সত্তর দশকের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারির নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী। যাত্রা শুরু হয়েছিল দমদম মতিঝিল কলেজ থেকে। তারপর কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজ। সেখানে তখন ছাত্র সংসদের নির্বাচনে সকল ছাত্রের ভোটে সরাসরি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন হতো। শ্যামল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিল কলেজে। দমদম এলাকায় পার্টির কাজেও যুক্ত ছিল। শ্যামল চক্রবর্তীর আদিবাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলায়। পরে একাধিক জায়গায় বদল হয়, চাকদহ-কৃষ্ণনগরেও ছিল এক সময়। শ্যামলের দমদমের নলতার বাড়িতে একবার রাতে ছিলাম। তখনই দেখেছিলাম খুব কষ্ট করে বড়ো হয়েছে শ্যামল। শ্যামলের মায়ের সঙ্গে কথাবার্তায় বুঝেছিলাম একসময় দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেই শ্যামল স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেছে। শ্যামল তখনকার ২৪ পরগনার দমদম এলাকায় পার্টির কাজকর্ম করেই পার্টি সদস্যপদ অর্জন করেছিল, কিন্তু পরে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে সদস্যপদ কলকাতা জেলায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। ধীরে ধীরে শ্যামল কলকাতায় পার্টির জেলা কমিটির ও জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হয়েছিল।
পরে ১৯৮১ সালে মানিকতলা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়। সুহৃদ মল্লিক চৌধুরীর মৃত্যুর পরে উপনির্বাচন হয়। ও জয়লাভ করে। শুরু হয় পরিষদীয় রাজনীতির জীবন। ১৯৮২সালে ফের ভোটে জেতে, তারপর ৮৭ সালেও জয়ী হয়। ২০০৮ সালে কমরেড শ্যামল রাজ্যসভার সদস্য হয়েছিল। ওঁর রাজনৈতিক জীবন বর্ণময় ছিল। গণআন্দোলনের অগ্রণী নেতাই শুধু নয়, ছিল ভালো লেখকও। কবিতাও পাঠ করত এবং সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত রেখেছিল।
ওঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বহুধাবিস্তৃত ছিল। ছাত্র-যুব আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনে গৌরবময় ভূমিকা ছিল। পরিবহণ ক্ষেত্রে, বিদ্যুৎ শিল্পের আন্দোলনে কমরেড শ্যামলের গৌরবজনক ভূমিকা ছিল। ছাত্র আন্দোলনের পর কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নেন। বিভিন্ন ইউনিয়ন গঠন, তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সিআইটিইউ পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সহসভাপতি ও সভাপতি হিসাবেও দক্ষতার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন শ্রমিক আন্দোলনে।
১৯৭৩ সালে শ্যামল চক্রবর্তী এসএফআই’র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হন। এসএফআই’র সর্বভারতীয় স্তরেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। ১৯৭৮ সালে রাজ্য সম্মেলন থেকে শ্যামল চক্রবর্তী পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। ২০০২ সালে হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসে শ্যামল চক্রবর্তী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
ওঁর কন্যার প্রতি সমবেদনা জানাই। বুয়ার কাছে এটা বড় ক্ষতি। বুয়ার ভালো নাম উষসী। খুব কম বয়সে ও মাকে হারায়। ১৯৮২ সালে কমরেড শিপ্রা ভৌমিকের মৃত্যু হয়। আজকে বাবাকে হারালো।
এই বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ওঁর মৃত্যু আমাদের সকলের কাছে একটা ক্ষতি। কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী লড়াই আন্দোলনের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন।
কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী লাল সেলাম।
কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী অমর রহে।