E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ প্রথম সংখ্যা / ১৪ আগস্ট ২০২০ / ২৯ শ্রাবণ ১৪২৭

প্রসঙ্গঃ স্বাধীনতা আন্দোলন মহাবিদ্রোহ ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুসলিমদের ভূমিকা

সুপ্রতীপ রায়


আর একটা স্বাধীনতা দিবস সামনে। বীরত্বপূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমরা ব্রিটিশকে বিতাড়িত করতে পেরেছি। ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে হিন্দু-মুসলমান সবার অবদান ছিল। কিন্তু বিজেপি-সহ হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমদের অবদান স্বীকার করে না। আরএসএস স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে বিকৃত করে চলেছে। প্রকৃত ইতিহাসকে তুলে ধরার কঠিন দায়িত্ব ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে পালন করতে হবে। আমরা দেখে নিতে চাই মহাবিদ্রোহ ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুসলিমদের কী ধরনের ভূমিকা ছিল।

১৭৫৭-র পলাশী যুদ্ধের ১০০ বছরের মধ্যেই ব্রিটিশকে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় - ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহে। এই বিদ্রোহে মুসলিমদের বিরাট ভূমিকা ছিল। এই বিদ্রোহে বাহাদুর শাহ জাফর (দ্বিতীয়)-এর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। বলা যেতে পারে বাহাদুর শাহ মহাবিদ্রোহের কেন্দ্রীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁরই নামে ভারতের ব্যাপক অংশের মানুষ, দেশীয় রাজন্যবর্গ, নবাব, সর্দার মহাবিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৮৫৭-র ১১ মে দিল্লি দখল করে আশি বছরের বাহাদুর শাহকে ‘হিন্দুস্তানের বাদশাহ’রূপে বরণ করে নিয়েছিলেন।

বাহাদুর শাহ জাফরের নামে ১৮৫৭-র ২৫ আগস্ট হিন্দুস্থানি ও উর্দু ভাষায় দেশবাসীর কাছে একটি ব্যাখ্যামূলক (ইশ্‌তিহার)-এ বলা হয়েছিল - “ভারতের সমস্ত হিন্দু-মুসলমান, সমস্ত নাগরিক ও কর্মচারীরা, দিল্লি দখলদারী ভারতীয় বাহিনী ও মীরাটের সিপাহীরা আপনাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা সমস্ত বিদেশী, বিধর্মী ইংরেজদের ধ্বংস করতে মনস্থ করেছি। এই সংগ্রামে হিন্দু মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।...”

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফৌজকে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ১৮৫৭-র ২০ সেপ্টেম্বর সেনাপতি হাডসন দিল্লি পুনর্দখল করেন। আত্মগোপনরত বাহাদুর শাহকে সপরিবারে ২১ সেপ্টেম্বর বন্দি করা হয়। তাঁর সামনে দুই পুত্র মীর্জা মুঘল এবং আবু বকরকে হত্যা করে ব্রিটিশ।

মহাবিদ্রোহের অন্যতম ব্যক্তিত্ব মৌলবী আহমদউল্লা শাহ। অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ-র পদস্থ কর্মচারী ছিলেন ফৈজাবাদের মৌলবি আহমদউল্লা। ১৮৫৭-র ৩০ এপ্রিল সারা অযোধ্যায় পালিত হয় আইন অমান্য আন্দোলন।আহমদউল্লা গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনায় অযোধ্যা ও রোহিলখণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।

মহাবিদ্রোহে ব্রিটিশ বিরোধী ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে বেগম হজরত মহলের ভূমিকা কে অস্বীকার করবে? বেগম হজরত মহল অযোধ্যার অপসৃত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের অন্যতম বেগম ছিলেন। ডালহৌসি কুশাসন-এর অভিযোগ এনে অযোধ্যা দখল করেন। এরপর লর্ড ক্যানিং-র নির্দেশবলে অযোধ্যার তালুকদারের তালুকদারি কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে ব্রিটিশ বিরোধী ঘৃণা তীব্র হয়।

বিদ্রোহ চলাকালীন নেতৃত্বদায়ী ভূমিকা নিয়েছিলেন বেগম হজরত মহল। লক্ষ্ণৌ প্রতিরোধে ৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তিনি প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন। বেগম হজরত নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থাকতেন। লক্ষ্ণৌতে পরাজয়ের পর বাহারাইচের বৌন্দি দুর্গে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ চালান। শাহজাহানপুরের যুদ্ধে অংশ নেন। এই যুদ্ধে পরাজয়ের পর ব্রিটিশের নিকট আত্মসমর্পণের বদলে তিনি ১৮৫৮-র ডিসেম্বরে নেপালে আশ্রয় নেন।

খান বাহাদুর খান ছিলেন শহিদ হাফিজ রহমত খানের পৌত্র। ১৮৫৭-র ৩১ মে বাহাদুর খান নিজেকে বাহাদুর শাহের রাজপ্রতিনিধি ‘নবাব’ হিসাবে ঘোষণা করেন। খান বাহাদুর খানের নেতৃত্বে ৪০ হাজার সেনার এক বাহিনী দিল্লিতে পাঠিয়েছিলেন বাহাদুর শাহকে সাহায্যের জন্য। রোহিলখণ্ডে ব্রিটিশ বাহিনীকে প্রতিরোধে খান বাহাদুর খান কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ১৮৫৯ সালে বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি ধৃত হন। ১৮৬০ সালে বেরেলিতে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

মহাবিদ্রোহে আর এক বীরের নাম বখত খাঁ। তিনি ছিলেন প্রথম আফগান যুদ্ধে এক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি ও ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রতি অনুরক্ত। দিল্লিতে সেনাপরিচালনার জন্য যে সেনাপতিমণ্ডলী গঠন করা হয়েছিল, তার সর্বাধিনায়ক ছিলেন বখত খাঁ। দিল্লি দখলে ইংরাজদের প্রচেষ্টা প্রতিরোধে তিনি লড়াই চালিয়েছিলেন।

আজিমুল্লা খান ইউসুফজাই ১৮৫১ সালে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের মৃত্যুর পর প্রথমে তিনি নানা সাহেবের সেক্রেটারি পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি নানা সাহেবের দেওয়ান হিসাবে নিযুক্ত হন। তিনি নানা সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে উত্তর ও মধ্য ভারতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে দিতে ছুটে বেড়িয়েছিলেন। নানা সাহেবের হয়ে তিনি ফরাসি সম্রাট লুই নেপোলিয়ানের কাছে চিঠিও লিখেছিলেন।

মহাবিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল শাহজাদা ফিরোজ শাহর। দিল্লি, মধ্যভারত, মান্দাসৌর, অযোধ্যা, রোহিলখণ্ড প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সময়ে গিয়েছিলেন। গেরিলা যুদ্ধ চলাকালীন সিরোঞ্জের অরণ্যে তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। আত্মসমর্পণ করলে বৃত্তি দেওয়া হবে মহারানির এই ঘোষণা সত্ত্বেও তিনি আত্মসমর্পন করেন নি।

মহাবিদ্রোহে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন ফৈজাবাদের মৌলবি আহম্মদ শাহ, পাটনার পীর আলি, শাহজাদার ফিরোজশাহ, ইঞ্জিনিয়ার মহম্মদ আলি খাঁ, নাজিম মহম্মদ হাসান প্রমুখ।

মহাবিদ্রোহে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন তাঁদের অমানুষিক নির্মমতার সঙ্গে বিচার করা হয়েছিলে। নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমনের পর শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। ১৮৫৮ সালের ২৭ জানুয়ারি দিল্লিতে বিচার শুরু হয়। সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে প্রথমে প্রাণদণ্ডের কথা বলা হয়। অবশ্য তাঁকে শেষ পর্যন্ত রেঙ্গুনে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশের প্রতি তাঁর এতটাই ঘৃণা ছিল যে, তিনি ব্রিটিশের কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি। রেঙ্গুনে নির্বাসিত বন্দি অশীতিপর বাহাদুর শাহ (জাফর)-কে জনৈক অফিসার বলেছিলেনঃ “কামানে আর দম নেই, জাফর প্রাণ ভিক্ষা চাও, তোমার তরবারির নেশা খতম।” এর উত্তরে বাহাদুর শাহ বলেছিলেনঃ “যতদিন শহিদদের মধ্যে প্রাণদানের আদর্শ অটুট থাকবে, ততদিন জেনো লন্ডনের সিংহাসন অবধি পৌঁছাবে হিন্দুস্তানের তরবারি।”

মহাবিদ্রোহ সমাপ্ত হওয়ার পর বৃটিশ মুসলিম সম্প্রদায়ের উপরই বেশি আক্রমণ নামিয়ে আনে। বল্লভগড়, ফারুকনগর, ফারাক্কাবাদ, ঝাড়ার প্রভৃতি স্থানের নবাবদের অনেককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। বিদ্রোহী মুসলমানদের শূকরের চামড়া দিয়ে গোটা দেহ মুড়ে দিয়ে সেলাই করা হতো। সেলাই করে গভীর জলে ফেলে দেওয়া হতো। শূকরের চর্বিতে ভিজিয়ে তাঁদের ফাঁসি দেওয়া হতো।

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে ওয়াহাবি আন্দোলনকারী বিদ্রোহীদের পাশে ছিলেন। মৌলভী সরফরাজ আলির মতো ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব মহাবিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। বিদ্রোহীরা মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেললে ওয়াহাবির স্বেচ্ছাসেবকরা উৎসাহ জোগাতেন। অনেকক্ষেত্রে বিদ্রোহ পরিচালনার দায়িত্ব বিদ্রোহী সিপাহীদের হাত থেকে ওয়াহাবিরা নিজেদের হাতে নিয়ে নিতেন।

মহাবিদ্রোহের খবর ছড়িয়ে পড়লে ১৮৫৭-র ৩০ মে লক্ষ্ণৌ-এর ওয়াহাবিরা সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন ও প্রায় দেড় হাজার নাগরিক নিয়ে রাস্তায় প্যারেড করেন। ওয়াহাবিরা দেশের মানুষকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার জন্য স্বেচ্ছাসেবীদের দলে নাম লেখানোর আহ্বান জানান। পাটনাতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ার আগেই প্রথম সারির ওয়াহাবিদের ব্রিটিশ সরকার গ্রেপ্তার করে। মহাবিদ্রোহের খবর প্রচারিত হলে এলাহবাদ দুর্গের বিদ্রোহী সিপাহীরা বেশ কিছু ব্রিটিশ অফিসারকে হত্যা করেন। ওয়াহাবি নেতা লিয়াকত আলি এলাহাবাদ দুর্গে এসে উপস্থিত হন ও সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন।

মহাবিদ্রোহে অংশ নিয়ে যাঁরা শহিদ হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন - মির্জা আবিবুদ্দিন, মির্জা বাহাদুর, মির্জা বুলন্দী, দাউদ শাহ, মির্জা গুলাম আব্বাস, মির্জা গুলাম বকরুদ্দিন, মির্জা গুলাম মহম্মদী, মির্জা হুসেন বক্স, মির্জা কালে, মির্জা করিমবক্স, মির্জা খাজীর সুলতান, খাজুর সুলতান, মাহমুদ শাহ, মাহমুদ শিকোহ, মির্জা আবদালী, মির্জা মেহরুক, মির্জা রমজানী, মির্জা সুজা শিকোহ, জীমুরদ, মির্জা মঈনুদ্দিন, মির্জা মাওলাবক্স, মির্জা মুহম্মদ বক্স, মির্জা মঈজুদ্দিন, মির্জা নুরুদ্দিন, মির্জা কুতুবউদ্দিন, সরবুদ বখত, মির্জা ওয়ালী শিকোহ। এঁরা সবাই মুঘল রাজপরিবারের সন্তান ছিলেন।

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে অংশ নিয়ে কয়েকজন অসামরিক বিত্তশালী শহিদ হয়েছিলেন। যেমন দিল্লির মৌলভী মহম্মদ বাকির। বেশ কয়েকজন মুসলিম মহিলাও শহিদ হয়েছিলেন। যেমন উত্তর প্রদেশের হাবিবা, উত্তর প্রদেশের মুন্দার, উত্তর প্রদেশের আসগরী বেগম প্রমুখ।

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ সম্পর্কে কার্ল মার্কস মূল্যায়ন করেছিলেন, কলম ধরেছিলেন। তিনি ‘নিউইয়ক ডেইলি ট্রিবিউন’-এর ৫০৬৫ সংখ্যা (১৫ জুলাই ১৮৫৭)-তে লিখেছিলেন “বর্তমান বিদ্রোহ কতকগুলি বৈশিষ্ট্যসূচক ও মারাত্মক লক্ষণে চিহ্নিত। এই প্রথম সিপাহী বাহিনী হত্যা করল তাদের ইউরোপীয় অফিসারদের, মুসলমান ও হিন্দুরা তাদের পারস্পরিক বিদ্বেষ পরিহার করে মিলিত হয়েছে সাধারণ মনিবদের বিরুদ্ধে।” বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুসলিমদের বিরাট ভূমিকা ছিল। ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়। বঙ্গভঙ্গের সরকারি ঘোষণার বিরূদ্ধে বরিশাল, ময়মনসিংহ, শ্রীরামপুরের বিভিন্ন মসজিদে প্রার্থনা হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বগুড়া, মাদারিপুর, টাঙ্গাইল প্রভৃতি অঞ্চলের সভাগুলিতে স্থানীয় মুসলিমরাও সভাপতিত্ব করতেন। স্বদেশি আন্দোলনের সময় কলকাতা ও মফঃস্বল জেলাগুলিতে যে সভা অনুষ্ঠিত হতো সেই সভাগুলিতে সুবক্তা হিসাবে বক্তব্য রাখতেন ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল, মৌলবী আব্দুল কাশীম, দেদার বক্স, আবদুল হালিম গজনবি, দীন মোহম্মদ প্রমুখ। ১৯০৬ সালে বরিশালে প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলনে ব্রিটিশ পুলিশের বেপরোয়া লাঠি চার্জের ফলে বহু মানুষ রক্তাক্ত হয়েছিলেন। ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল ওই সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনিও পুলিশের হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের এই চণ্ডনীতির বিরূদ্ধে ১৪ মে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে চার হাজার মুসলমান জমায়েত হয়েছিলেন। বরিশালের মুকুটহীন রাজা অশ্বিনীকুমার দত্তের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে মফিজউদ্দিন বয়াতি জারিগানের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে স্বদেশি আন্দোলনে অংশ নিতে উৎসাহিত করেছিলেন। স্বদেশি ব্যবসার জন্য টাঙ্গাইলের আব্দুল হালিম ও বগুড়ার নবাবের প্রচেষ্টায় ‘বেঙ্গল হোসিয়ারি কোম্পানি’ ও ‘ইউনাইটেড বেঙ্গল কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বদেশি আন্দোলনের সূত্রেই চট্টগ্রামের মুসলমান ব্যবসায়ীরা ‘দি বেঙ্গল স্টিম কোম্পানি’ নামে একটি স্টিমার কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

স্বদেশি আন্দোলনের সময় যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেক মুসলিম ছিলেন। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন’ যে ৯২ জন সভ্যকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল তার ৭৬ জন ছিলেন মুসলিম। অ্যান্টি-সারকুলার সোসাইটিতে মুসলমানদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।

খাজা আতিকুল্লাহ কলকাতা কংগ্রেসের অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। বরিশালের জমিদার চৌধুরী গোলাম আলি মওলানা ১৯০৬ ও ১৯০৭ সালে রাখিবন্ধনের আবেদন পত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। ফরিদপুরের সহস্রাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে যে প্রতিবাদলিপি প্রেরণ করেছিলেন তাতে সর্বপ্রথম স্বাক্ষর ছিল জমিদার চৌধুরী আলীমুজ্জামানের। বরিশালের জমিদার সৈয়দ মোতাহার হোসেন স্বদেশ বান্ধব সমিতির বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন।

স্বদেশি আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কুমিল্লার আবদুর রসুল, টাঙ্গাইলের হালিম গজনবী, বর্ধমানের জমিদার আব্দুল কাশেমের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯০৬সালে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ধর্মঘটের সময় যাঁরা সামনে থেকে প্রচার করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আবুল হোসেন ও লিয়াকত হোসেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, ১৯০৭ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ের ছয় জন মুসলমান ড্রাইভার কোরান ছুঁয়ে ধর্মঘট করার অঙ্গীকার করেছিলেন।

স্বদেশি আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব ছিলেন দেদার বক্স। তিনি হাওড়া হুগলি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রচারকের ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯০৯ সালে হুগলিতে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনি বিলাতি দ্রব্য বয়কটের প্রস্তাব করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত বেশ কয়েকজন বক্তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল। বক্তা হেদায়েত বক্স ও মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সরকার নিয়েছিল।

সিরাজগঞ্জের সৈয়দ আবুমুহাম্মদ ইসমাইল হুসেন সিরাজী, বাটাজোর-এর আব্দুল গফুর, হুগলির আবুল হুসেন স্বদেশি আন্দোলনের যুগে অগ্নিবর্ষী বক্তৃতা দিতেন। লিয়াকত হোসেনের বক্তব্যের প্রশংসা করে ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায় একাধিক বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল।

মৌলবী লিয়াকত হোসেন কুখ্যাত কারলাইল সারকুলারের বিরূদ্ধে, বয়কট আন্দোলনের সমর্থনে নিরবচ্ছিন্ন প্রচার চালিয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে আর একজন বিশিষ্ট নেতৃত্ব ছিলেন আবদুর রসুল। ১৯০৬-০৭ সালে পূর্ব বাংলায় সংগঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলি প্রতিরোধে আবদুর রসুল বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২৩ সেপ্টেম্বর রাজাবাজারে দশ হাজার মানুষের সমাবেশে বক্তব্য রেখেছিলেন আবদুর রসুল।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে আবদুল হালিম গজনবীর নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯০৫ সালের ২৭ আগস্ট জগন্নাথ কলেজ প্রাঙ্গণে যে বিরাট সভা হয়েছিল তাতে তিনি উপস্থিত ছিলেন। ওই বছরের ১৬ অক্টোবর কলকাতায় যে বিরাট জনসভা হয়েছিল তাতেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। ঐক্যের প্রতীক হিসাবে ফেডারেশন হলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানেও গজনবী উপস্থিত ছিলেন। ১৯০৬ সালের ১৪, ১৫ এপ্রিল বরিশালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনে আবদুর রসুল সভাপতি ছিলেন। কিন্তু রসুল সাহেবের অসুস্থতার কারণে আবদুল হালিম গজনবি সেই সম্মেলনে অভিভাষণ পাঠ করেছিলেন।

বঙ্গবিভাগে মুসলমান সম্প্রদায়ের সমর্থন আছে বলে লর্ড কার্জন যখন প্রচার করেছিলেন, তখন নবাব সৈয়দ আমীর হোসেন ও কেন্দ্রীয় মুসলিম সমিতি বা Central Mohammedan Association ১৯০৮-র ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলার মুখ্যসচিবকে জানান, তারা বঙ্গ বিভাগ চান না।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার সময় থেকেই মুসলিম সমাজের অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিল। ১৯০৩ সালে যখন বঙ্গভঙ্গের মূল প্রস্তাব প্রকাশিত হয় তখন ব্রিটিশ সরকারের কাছে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে যে সব প্রতিবাদপত্র প্রেরণ করা হয়েছিল তাতে অনেক মুসলিমের স্বাক্ষর ছিল। ১৯০৪ সালে কলকাতার কেন্দ্রীয় মহামেডান অ্যাসোসিয়েশনের সভায় মৌলবী সামসুল হুদা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে বক্তব্য রেখেছিলেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম অবদান ভোলা যাবে না। এই অবদানগুলিকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ধৈর্য্যশীল, নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। না হলে মানুষ সঙ্ঘ পরিবারের বিকৃত প্রচারে বিভ্রান্ত হবেন।