E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ প্রথম সংখ্যা / ১৪ আগস্ট ২০২০ / ২৯ শ্রাবণ ১৪২৭

পরিবেশ আলোচনা

চোখে পড়ে না যে খবর

তপন মিশ্র


দেশে এখন অনেক কিছুই ঘটছে যা আমাদের জানা দরকার কিন্তু চোখে পড়ছে না। আমাদের চোখে যাতে না পড়ে তাই খবরে দেখানো হচ্ছে না বা ছাপা হচ্ছে না। এমন দু’একটা খবর যা আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক মনে হয় না তাই চোখ এড়িয়ে যায়, তার উল্লেখ করব। এমনিতেই পরিবেশ রক্ষা সম্পর্কিত খবর আমল পায় না, তার উপরে পরিবেশ রক্ষার উপর সরকারি কোপ পড়লে তো কথাই নেই। যতটা লুকিয়ে করা যায় ততোই মঙ্গল। যখন আমরা আশা করছি, রাষ্ট্র বায়ুদূষণ কমানোর সবরকম চেষ্টা করবে তখন উল্টোদিকে জল বইতে শুরু করছে। বোধহয় জুলাই মাসকে বেছে নেওয়া হয়েছে কারণ আমরা তখন করোনা যুদ্ধে ব্যস্ত। কার্যত দিন যত যাচ্ছে সরকারের উপস্থিতি ততো ম্লান হয়ে যাচ্ছে। মরণ বাঁচনের এই যুদ্ধ ভুলে পরিবেশ রক্ষার লড়াই আমাদের কাছে গৌণ হয়ে গেছে।

বায়ুদূষণ বৃদ্ধিতে সবুজ সঙ্কেত

গত জুলাই মাসের ৮ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দান করে। তাতে বলা হয় যে, ২০০৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের নাইট্রোজেন অক্সাইড বাতাসে ত্যাগ করার মাত্রা ৩০০ মিলিগ্রাম প্রতি ঘন মিলিমিটার (milligram/normal cubic metre বা mg / Nm3) থেকে বাড়িয়ে ৪৫০ করা হলো। এই যে ৩০০ মিলিগ্রাম প্রতি ঘন মিলিমিটারের মান ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারত সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক (Ministry of Environment, Forest and Climate Change) একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বলে। জার্মানিতে এই মাত্রা হলো ১৫০, চীনে ২০০ (সুত্র-Improving emission regulation for coal-fired power plants in ASEAN, 2017)। কয়েকটি দেশে এই মাত্রা আমাদের দেশের থেকে বেশি হতে পারে কিন্তু তাদের বাতাসে দূষকপদার্থগুলির পরিমাণ আমাদের দেশের তুলনায় অনেক কম। যদি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বেশি পরিমাণ নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গত হওয়ার অর্থ বাতাসে বেশি পরিমাণ ছড়িয়ে যাওয়া। এই সময়ে এ ধরনের ঝুঁকি কি নেওয়া যায়? আমাদের দেশে ২০০৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত কয়লা জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার হয় এমন তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের মোট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫৮ শতাংশ এবং সেগুলির উৎপাদন ক্ষমতা ১,২১,৩৪০ মেগাওয়াট।

এবার আসুন দেখি মানুষের দেহের উপর এর প্রভাবটা কি? দেশে দেশে বাতাসে এই ধরনের বায়ুদূষকের সহনমাত্রার ভিন্নতা নির্ধারণে একটু আধটু ফারাক আছে। তবে ফারাকটা অনেক বেশি হলে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ইয়োরোপের একজন মানুষ বা আফ্রিকার একজন বা ভারতের একজনের শরীরের দূষক শোষণ করার ক্ষমতার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য থাকার কথা নয়। সব মানুষের শারীরবৃত্তীয় কাজ প্রায় একইরকম।

নাইট্রোজেনের অক্সাইডগুলি প্রাথমিকভাবে নাইট্রিক অক্সাইড আকারে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে কয়লা দহনকালে নির্গত হয়। এই গ্যাস বাতাসে অন্যান্য দূষণকারী গ্যাসগুলির দোসর। নাইট্রোজেনের অন্যান্য অক্সাইডগুলি বাতাসে ছেড়ে দেওয়ার পরে জারণের মাধ্যমে নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড তৈরি হয় এবং এটি একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর গ্যাস, যা শ্বাসনালীর শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি দ্বারা শোষিত হয় এবং জ্বালা অনুভূত হয়। সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ে শ্বাসনালীর নিচের দিকে। ফুসফুসের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। উপরের বায়ুবাহী নালীগুলির কম ক্ষতি হয়, কারণ নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইডে জলে অপেক্ষাকৃত কম দ্রবণীয় হওয়ায় নিচে ফুসফুসের দিকে গড়িয়ে গিয়ে জমা হয়। এর নিট ফল হলো ফুসফুসের সংক্রমণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। চিকিৎসকরা একে পালমোনারি ফাংশন হ্রাস বলে অভিহিত করেন।

বর্তমানে আমাদের দেশ এবং ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়ন বাতাসে উপস্থিত বেশিরভাগ দূষণকারী পদার্থের জন্য একটি মান (standard) প্রণয়ন করেছে। মানের অর্থ হলো সেই নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি হলে তা যেকোনো মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইডের ক্ষেত্রে বাতাসে এই পরিমাণ হলো ২০০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘন মিটার (২০০ µg/m3)। এটি প্রতি ঘণ্টার গড় হিসাবে ধরা হয়। এটাই হলো মানুষের সহনশীল মাত্রা। পরেও বলা হয় যে, এই গ্যাসের প্রতি সংবেদনশীল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ৫০ µg/m3 মধ্যে থাকলে ভাল এবং ১০০ µg/m3 র বেশি হলে তা সংবেদনশীল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হতে পারে। আসলে নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইডের দূষণ কমাতে যে প্রযুক্তির ব্যবহার করা দরকার তাতে খরচ বেশি। সেই বিনিয়োগ থেকে মুক্তি পেতে এই ব্যবস্থা নয় তো? পৃথিবীতে যখন পরিবেশ দূষণের জন্য জরুরি অবস্থা চলছে তখন এই রায়ের প্রভাব কি হবে আমাদের আজানা নয়।

কম্পেনসেটরি বৃক্ষরোপণে সরকারি বাধা

গত ১০ জুলাই রাজ্য সরকারগুলিকে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া একটি চিঠি দেশের কম্পেনসেটরি আফরেস্টেশনের (Compensatory afforestation) যে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা এতোদিন ধরে প্রচলিত, তাতে বড়ো পরিবর্তন আনতে চলেছে। চিঠিটি কেন্দ্রীয় সরকারের রোড ট্রান্সপোর্ট এবং হাইওয়ে মন্ত্রক থেকে সমস্ত রাজ্য সরকারকে দেওয়া হয় (চিঠি নম্বর H-11013/02/2019-S&R(P&B, dated 30th June, 2020)। চিঠিতে বলা হয় যে, দেশের পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনাক্রমে ঠিক হয়েছে যে, এবার থেকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং সাধারণ অসংরক্ষিত বনাঞ্চল দিয়ে রাস্তা তৈরি করতে যে গাছ কাটা যাবে তার পরিবর্তে রাজ্য সরকারকে বৃক্ষরোপণের জন্য জমির ব্যবস্থা করার দরকার হবে না।

আমাদের দেশে বন সংরক্ষণ আইন (ফরেস্ট কনজারভেশন অ্যাক্ট ১৯৮০ এবং ২০০৩) অনুযায়ী অরণ্যের মধ্যে কোনো রাস্তা, খনি বা অন্য কোনো পরিকাঠামো তৈরির কাজ করতে গেলে অর্থাৎ বনভূমিকে অন্য কোনভাবে রূপান্তরিত (Forest land for non-forest purpose) করতে গেলে যে পরিমাণ গাছ কাটা যাবে তার জন্য কম্পেনসেটরি আফরেস্টেশন জরুরি। এই আইন কেন্দ্র, রাজ্য সরকার এবং বেসরকারি যে কোনো সংস্থার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। আইন অনুযায়ী কেন্দ্র সরকার রাস্তা তৈরির প্রকল্পের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত (converted) জমিতে যে পরিমাণ গাছ ছিল তার ঠিক দ্বিগুণ পরিমাণ গাছ লাগাবে বনাঞ্চলের মধ্যেকার পতিত (degraded forestland) জমিতে। কিন্তু রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে বা রাজ্য পূর্ত দপ্তর রাস্তা তৈরি করলে অধিগৃহীত এবং রূপান্তরিত জমির সমপরিমাণ বনাঞ্চলের বাইরে জমি জোগাড় করে তাতে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। কিন্তু এবার থেকে তার আর দরকার হবে না।

বৃক্ষরোপণের অর্থ কিন্তু বনসৃজন নয়। তবুও ধরে নেওয়া যাক যে, বাস্তুতন্ত্রের কিছুটা ক্ষত এই পদ্ধিতিতে পূরণ করা হচ্ছিল। অভিযোগ আছে যে, বনসৃজনের নামে কেবল একটি প্রজাতির গাছ লাগানোর কাজ অধিকাংশ জায়গায় হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, রাজ্য সরকারের জন্য কেন এমন ভিন্ন আইন ছিল। এর কারণ হলো, রাজ্যসরকার রাজ্যের মধ্যে বনভূমি বা অন্য কোনো কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা সংরক্ষিত জমি বাদ দিয়ে আইনত ভুমি অধিগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তা পারে না বা করে না। দেশে বনভূমির পরিমাণ নির্দিষ্ট। বন আচ্ছাদন কিন্তু এর থেকে ভিন্ন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বা তার ঠিক কিছুদিন পর বনভূমি অধিগ্রহণের কাজ সমাপ্ত হয়। এই কাজ হওয়ার পর এই জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনাও নেই। আমাদের দেশে বনভূমির (recorded forest area) ২০০৫ সালে ছিল ২৩.৪১ শতাংশ কিন্তু এখন বনের আচ্ছাদন ২৪.৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ বনভূমির বাইরেও বেশকিছু বৃক্ষ আচ্ছাদন রয়েছে। বনভূমির বাইরের পতিতজমিকে বৃক্ষ আচ্ছাদনের মধ্যে আনতে না পারলে এদেশে ৩৩ শতাংশ বনাঞ্চলের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। ফলে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য নষ্ট হয়ে যাওয়া বনভূমি এবং বন আচ্ছাদনের ক্ষতি পূরণ করা যাবে না। কিন্তু বনভূমির বাইরে এমন অনেক পতিত জমি আছে যেখানে পরিকল্পিত বনসৃজন করা যায়। ভারত সরকারের ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত করা একটি সমীক্ষা বলছে, এদেশে পতিত জমির পরিমাণ ৯৬৪ লক্ষ হেক্টর। অর্থাৎ দেশের মোট ভূমির ২৯.৩ শতাংশ।

মহারাষ্ট্র সরকারের দেওয়া একটা তথ্য বলছে যে, ১৯৮০ সালে অরণ্য সংরক্ষণ আইন তৈরি হওয়ার পর এপর্যন্ত বনাঞ্চলের ৬৭,০০০ হেক্টর জমির পরিবর্তে ৬০,০০০ হেক্টর বনাঞ্চলের বাইরের জমি বনভূমি তৈরির জন্য দেওয়া হয়েছে। অন্য রাজ্যের তথ্য আমাদের হাতে নেই। ভারত সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের হিসাব বলছে কেবল ২০১৯ সালে সারা দেশে ১১,৪৬৭ হেক্টর বনভূমি তথাকথিত উন্নয়নের গর্ভে গেছে। তার কতটা ফেরত এসেছে বৃক্ষরোপণ বা বনসৃজনের জন্য সে তথ্য পাওয়া ভার। এমন এক অবস্থায় সরকারের অরণ্য ধ্বংসের পরিকল্পনা অত্যন্ত নিন্দনীয়।

পর পর আঘাত আসছে আমাদের চারপাশের প্রকৃতির উপর। ভুখা মানুষের এখন কেবল চাই খাদ্য। এখন সময় কই পরিবেশ রক্ষার কথা ভাবার। তাই এই সময়ে যত পারো লুঠ করো। প্রতিবাদের স্বর এখন ক্ষীণ। আরও ক্ষীণতর করতে আছে বিভিন্ন দমনমূলক আইন। এই সেদিন কয়েকজন সর্বনাশা ‘এনভায়রন ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে চিঠি পাঠানোর গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করায় তাদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু কণ্ঠ রুদ্ধ হলে পরিবেশের যে ক্ষতি হবে তা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বেদনার।