৫৯ বর্ষ ২২ সংখ্যা / ১৪ জানুয়ারি, ২০২২ / ২৯ পৌষ, ১৪২৮
আসানসোল নগর নিগম নির্বাচনে ভোটলুট রুখে দিয়ে গণতন্ত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রস্তুত হচ্ছেন মানুষ
দেবদাস ভট্টাচার্য
আসানসোল নগর নিগমের ভোট প্রচারে ৯৫ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিআই(এম) প্রার্থী সোমা দাস।
আসানসোল নগর নিগমের নির্বাচনী পরিমণ্ডলে ‘উন্নয়ন’ শব্দটাই তৃণমূলের কাছে বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভুক্তভোগী মানুষের মুখে মুখে আসানসোল নগর নিগমের অপর নাম ‘ঘুঘুর বাসা’। দুর্নীতি কর্পোরেশনের অঙ্গের ভূষণ। বিশাল মধুভাণ্ড। মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও মধুভাণ্ড দখলে রেখে দিয়েছিল প্রশাসক বসিয়ে। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে কর্পোরেশনের নির্বাচিত বোর্ডের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে।
২২ জানুয়ারি নির্বাচন। ১০৬টি ওয়ার্ড। সবার আগে বামফ্রন্ট প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। মনোনয়ন দাখিলের দিন থেকেই বশংবদ পুলিশ বাহিনীকে ময়দানে নামানো হয়েছে। বামফ্রন্ট প্রার্থীদের সেদিন রীতিমতন বাধা ঠেলেই মনোনয়ন দাখিল করতে হয়েছে।
গণতান্ত্রিক মানুষ যা চাইছেন, সেটাই বামফ্রন্টের অন্যতম মুখ্য দাবি। নাগরিক সমাজ নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চাইছেন। ২০১৫ সালে নগর নিগমের ভোট লুট হয়ে গিয়েছিল। লুটের ভোটে নগর নিগমের ক্ষমতা দখল করেছে তৃণমূল। স্বচ্ছ এবং দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন চাইছেন মানুষ। কুলটি, রানিগঞ্জ এবং জামুড়িয়া পৌরসভাগুলির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বমহিমায় আবার ফিরে আসুক এমনটা চাইছেন মানুষ। তৃণমূল সরকার মানুষের আপত্তিকে আমল না দিয়ে গায়ের জোরে এই তিনটি পৌরসভাকে আসানসোল নগর নিগমের অ্যাডেড এরিয়া করে দিয়েছে। সেই সময়ে হাওড়া কর্পোরেশনের অ্যাডেড এরিয়া করা হয়েছিল বালিকে। হাওড়া কর্পোরেশন থেকে শেষে বালিকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া এবং কুলটির আপত্তিকে আমল দেওয়া হয়নি। রানিগঞ্জ পৌরসভা বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী পৌরসভা ছিল। পৌরসভায় যে পরিষেবা নাগরিকরা পেয়েছেন, পৌর কর্পোরেশনে তা পাচ্ছেন না। মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। বহুগুণ কর বাড়ানো হয়েছে। জেলা ভাগ হয়েছে। মানুষ চেয়েছিলেন রানিগঞ্জ ও জামুড়িয়াকে নিয়ে পৃথক মহকুমা করা হোক। বামফ্রন্ট নির্বাচনে মানুষের দাবিকে তুলে ধরেছে।
শহরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ওষুধের দোকানদার, গৃহস্থ কেউ স্বস্তিতে নেই। একতরফাভাবে তৃণমূল পরিচালিত পৌর কর্পোরেশন ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কর বৃদ্ধি করেছে। করে-ও কাটমানির কারবার। অনেকে ক্ষমতাধরদের সঙ্গে ‘রফা’ করে নেওয়ায় তাদের কর কমে গেছে। পরিষেবা তলানিতে। খোদ আসানসোল শহরে জলকষ্টে রয়েছেন নাগরিকরা। রাস্তার ধারে টাইমকলে জল নিতে হয় বহু মানুষকে। জল সরবরাহ করার নির্দিষ্ট সময়সূচি নেই। শীতের দিনে ভোর ৪টাতেও টাইমকলে জল দেওয়া হয়ে থাকে। নদী দখল করে মাথা তুলেছে সিন্ডিকেটরাজের বহুতল। শহর জুড়ে জমি মাফিয়াদের দাপাদাপি। বন্ধ কারখানার যন্ত্রপাতি লোপাট হয়ে যাচ্ছে। রানিগঞ্জে বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বার্নস রিফ্র্যাক্টারির দু'টি কারখানার যন্ত্রপাতি শাসকদলের মদতপুষ্ট মাতব্বররা লোপাট করে দিয়েছে। পুলিশ চোখ বুজে ছিল। বন্ধ কারখানার জমি, আবাসন দখল হয়ে যাচ্ছে। জমি হাঙর, কয়লা, লোহার চোরাকারবারিদের রমরমা কারবার দেখছে শহর।
'হাউসিং ফর অল' প্রকল্পের দুর্নীতি চাপা নেই। অভিযোগ রয়েছে, বাড়ি প্রাপকদের নামের তালিকা পাঠানোর সময়েই ১০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। তালিকা অনুমোদনের পরে আর এক কিস্তি টাকা দিতে হয়েছে। পুরাতন বাড়ির দেওয়াল নীল সাদা রঙ করে নতুন বাড়ি বলে চালিয়ে দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে, এমন অভিযোগও রয়েছে। করোনাকালে দুঃস্থদের মাঝে বিতরণ করার জন্য কর্পোরেশন থেকে চাল দেওয়া হয়েছিল। ১১ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের কাউন্সিলর সেই চাল দোকানে বিক্রি করার জন্য ভ্যানে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এলাকার মানুষ চালচোর কাউন্সিলরকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। কোনো সাজা হয় নি তার। পাঁচটা বছর এভাবেই কাটিয়ে দিলেন চালচোর কাউন্সিলর। এই ১১ নম্বর ওয়ার্ডেই এবার বামফ্রন্টের সিপিআই(এম) প্রার্থী সাব্বির হোসেন (খুরসেদ)। মাস্টার ডিগ্রি করা বেকার যুবক। গৃহ শিক্ষকতা করেন। এলাকার মাদ্রাসায় পারিশ্রমিক না নিয়ে ছাত্র পড়ান। তাঁর সমর্থনে মানুষের ঢল নেমেছে। এখানে নর্দমা পরিষ্কার হয়না। পানীয় জলের প্রচণ্ড কষ্ট। ইসিএল-এর শ্রীপুর কোলিয়ারি তৃণমূল প্রথম বার রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর বন্ধ হয়ে গেছে। তৃণমূল প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসেছিল ২০১১ সালের মে মাসে। সেই মাসেই রানিগঞ্জে জেলার একমাত্র চালু জুটমিল বন্ধ হয়ে গেছে তৃণমূলী নৈরাজ্যে। আজ অবধি মিল চালু হয় নি। জামুড়িয়াতে ইসিএল-এর রানা কোলিয়রি বন্ধ হয়েছে। নিংঘা কোলিয়ারি বন্ধ করার চক্রান্ত চলছে। শিবডাঙা কোলিয়ারিতে উৎপাদন বন্ধ করা হয়েছে। শিল্পশহর আসানসোলে শিল্পের সর্বনাশ হয়ে চলেছে তৃণমূলী রাজত্বে। একটাও নতুন শিল্প হয় নি। যানজটে স্তব্ধ হয়ে গেছে বাণিজ্য শহর রানিগঞ্জ। বাম আমলে ২০১০ সালে বাইপাস রাস্তার অনুমোদন হয়েছে। তৃণমূলী রাজত্বে সেই ফাইল নড়ে নি। রাষ্ট্রায়ত্ত বালকো কারখানা বেসরকারিকরণ হয়েছে। উৎপাদনহীন হয়ে পড়ে রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বার্ন স্ট্যান্ডার্ড ওয়াগন বার্নপুরে বন্ধ হয়ে গেল। ওয়াগন কারখানার আবাসনে বিদ্যুৎ, পানীয় জলের আকাল। কেউ দেখার নেই। এদিকে পৌর কর্পোরেশনের শহুরি রোজগার যোজনা কেবল একটা গালভরা নাম। মানুষের হাতে কাজ নেই। বিজেপি এবং তৃণমূল শহরে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার খেলা চালিয়ে গেছে। দাঙ্গার আগুন ছড়িয়েছে শহরে। ভ্রাতৃত্বের শহর, রুজিরুটির শহর মিনি ভারত আসানসোলে বিভাজনের রাজনীতিকে উসকে দেওয়া হচ্ছে।
মিডিয়ার তৈরি তৃণমূল- বিজেপি’র বাইনারির মাঝেই শাসকদলের ছত্রছায়ায় একটার পর একটা আরএসএস-এর শাখা গজিয়ে উঠেছে। একই মালিকের এক ছাদের তলায় দুই গুদামের মাল এঘর থেকে ওঘর হচ্ছে। কেউ সকালে এঘর ছেড়ে ওঘরে যাচ্ছে। বিকালে ফিরে আসছে। তৃণমূলের মেয়র কিছুদিন হলো ওঘরে গেছেন।
এবারে উজ্জ্বল ভাবমূর্তির একঝাঁক তরুণ বামফ্রন্টের প্রার্থী হয়েছেন। রক্তদান আন্দোলন, বিজ্ঞান জনচেতনার আন্দোলনে এঁরা রয়েছেন অনেকে। রয়েছেন মানুষের বিপন্নতায়। করোনাকালে আপদে বিপদে পাড়ার মানুষের ভরসা হয়ে তরুণের দল রয়েছেন। উল্লেখযোগ্যহারে মহিলারা এগিয়ে এসেছেন প্রচারে। ৩৯ জন মহিলাকে প্রার্থী করেছে বামফ্রন্ট। জামুড়িয়ায় এমএ পাশ করা তপশিলি পরিবারের তরুণী প্রার্থী হয়েছেন। সদ্য কলেজের পড়া শেষ করা ২১ বছরের বার্নপুর শ্যামবাঁধের তরুণী সোমা দাসের মতন প্রার্থী রয়েছেন। রয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষিকা, গৃহবধূ, সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন না, এমন অনেকে এগিয়ে এসেছেন বামফ্রন্টের প্রার্থী হবার জন্য। এঁদের কাছে প্রশ্ন ছিল, কেন এলেন বামফ্রন্টে? জবাবে বলেছেন, দুর্নীতিমুক্ত পৌর কর্পোরেশন চাই। লুটে খাওয়া বন্ধ হোক। পৌর পরিষেবা চাই। কেউ বলেছেন, শিল্প শহরে শিল্পের পরিবেশ চাই। সব সম্প্রদায়ের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আগের মতন ভালো থাকতে চাই।
শহরে বাড়ি তৈরি করতে গেলে হ্যাপা। এডিডিএ’র কাছে টাকা জমা দিয়ে এনওসি নাও। নগর নিগমের কাছে বাড়ি তৈরি করার প্ল্যান জমা দিয়ে অনুমতি নাও। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বাড়ি তৈরি করতে হচ্ছে। অনেকেই বিনা অনুমতিতে বাড়ি করে ফেলেছে মাতব্বরদের সঙ্গে বন্দোবস্তর মাধ্যমে।
দুর্নীতি সর্বত্র। ট্রেড লাইসেন্সে দুর্নীতি, অটো, টোটো, হকার, শংসাপত্র, ডিজিটাল রেশনকার্ড, রেশন ডিলার, মাল কেনা, মাল বেচা, টেন্ডার, বিনা টেন্ডার সব জায়গায় দুর্নীতি। এর ওপর রয়েছে স্বজন পোষণ। চাপাকল বসাবে বাড়িতে, কর্পোরেশনের সরকারি খাজানায় ১০ হাজার টাকা দাও। কম টাকায় করতে চাইলে কর্পোরেশনে যেওনা। মাতব্বরদের সঙ্গে রফা করে নাও। ‘পকেটমানি’ আড়াই হাজার টাকায় চাপাকল বসাও।
গণতান্ত্রিক মানুষের আকুতি ভোট লুট হবে না তো! ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে নাগরিকরা গদগদ হয়ে তৃণমূলকে ভোট দেবে এই প্রত্যয় শাসকদলের নেই। তাই প্রথম থেকেই দলদাস পুলিশ প্রশাসনকে ময়দানে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বামফ্রন্ট প্রার্থীর প্রচারে কড়া নজর রেখেছে প্রশাসন। করোনাবিধিকে হাতিয়ার করে মাঝপথে বামফ্রন্ট প্রার্থীর প্রচার মিছিল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আসানসোলে। অন্যদিকে শাসকদলের প্রচারে কোনো বিধিনিষেধ নেই।
নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন জামুড়িয়াতে পার্টির জেলা কমিটির নেতা মনোজ দত্তর বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ করে হুমকি দিয়েছে পুলিস। মনোজ দত্ত তখন বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর স্ত্রীকে হুমকি দিয়ে পুলিশ বলেছে, সামনে নির্বাচন, মনোজ বাবুকে সাবধানে থাকতে বলবেন। আপনিও সাবধানে থাকবেন। ৬ নম্বর ওয়ার্ডে জামুড়িয়া মণ্ডলপুর গ্রামে পার্টি সদস্য কালীদাস বাউরি ও পার্টি সমর্থক হেমন্ত বাউরির ঘরে গিয়ে পুলিস শাসিয়ে এসেছে। বলেছে, বাড়ি দেখে গেলাম। বাড়াবাড়ি করো না। কালীদাস বাড়িতে ছিলেন না। হেমন্ত পুলিসের চোখে চোখ রেখে বলেছেন, বামফ্রন্টের প্রচার করছি, করব। ভোটও দেব।
এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে জামুড়িয়া তথা সমগ্র জেলা জুড়ে। সিপিআই(এম) জেলা সম্পাদক গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি নির্বাচন কমিশনারের কাছে প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়ে বলেছেন, পুলিশ শাসকদলের অনুগত বাহিনীর কাজ করছে। অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন তিনি। জেলা শাসক, পুলিশ সুপার সহ প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে পার্টি। পার্টিনেতা মনোজ দত্তর স্ত্রী মমতা দত্ত থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। সর্ব ভারতীয় মহিলা কমিশনে অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি। মণ্ডলপুরে দু’জন তপশিলি জাতির পার্টিকর্মীর বাড়িতে পুলিশ চড়াও হয়ে হুমকি দেবার ঘটনার বিহিত চেয়ে কালীদাস বাউরি ও হেমন্ত বাউরি জাতীয় তপশিলি জাতি উপজাতি কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
২০১৫ সালে পৌর কর্পোরেশন ভোটলুট সব জায়গায় রুখতে পারেননি মানুষ। এবার তা হবে না। এবার প্রতিরোধের মেজাজ জেগে উঠছে বিভিন্ন ওয়ার্ডে। ১১ নম্বর ওয়ার্ড শ্রীপুর এলাকার মানুষ যেমন হেঁকে বলেছেন, এখানে ভোট লুট করতে দেব না। ৯১ নম্বর ওয়ার্ড রানিগঞ্জ গির্জাপাড়ায় পুলিসের সামনে বোমাবাজি করে বুথ দখল করা হয়েছিল। গির্জাপাড়া এবার বলেছে, ভোট লুট হতে দেব না। নিজের ভোট নিজে দিন প্রচার তোলা হয়েছে সর্বত্র।
তৃণমূলী রাজত্বে সব ভোটের মতন আসানসোল নগর নিগমের ভোট নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে। এ পর্যন্ত রাজ্যবাসী বহু একপেশে নির্বাচন পরখ করলেন। একদিকে পুলিশ, প্রশাসন, শাসকদলের বাহুবলি এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বধিরতা এবং অন্যদিকে অসহায় মতদাতা। জেগে ওঠা মানুষের ভোটের প্রতীক্ষায় রয়েছে আসানসোল।