৫৯ বর্ষ ২২ সংখ্যা / ১৪ জানুয়ারি, ২০২২ / ২৯ পৌষ, ১৪২৮
বিধাননগর পৌরনিগম নির্বাচন
দিনবদলের আকাঙ্ক্ষায় প্রস্তুতি নিচ্ছেন মানুষ
বিধাননগরে ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে প্রচারে প্রার্থী চন্দনা মণ্ডল।
দিন বদলের ডাক দিচ্ছেন বামফ্রন্টের প্রার্থীরা। দিন বদলের আকুতি রাজ্যের মানুষের মতো বিধাননগর পৌরনিগমের বাসিন্দাদেরও। তাঁদের বক্তব্য, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মরজিতে নয়, পৌরনিগম পরিচালনা হোক নীতির ভিত্তিতে। ফিরে আসুক নিজের অঞ্চলের উন্নয়নে মতপ্রকাশ ও কথা বলার অধিকার।
রাজ্যের তিনটে পৌরনিগমের সঙ্গে ২২ জানুয়ারি নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে বিধাননগর পৌরনিগমের। আদালতের হস্তক্ষেপে নির্দিষ্ট সময়ের দু’বছরের বেশি সময় পরে নির্বাচন হতে চলেছে। দীর্ঘ সময় তৃণমূল কংগ্রেস কো-অর্ডিনেটর বসিয়ে পৌরনিগম দখলে রেখেছে। বাসিন্দারা প্রশ্ন তুলেছেন, ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতিতে আরও দু’মাস পরে নির্বাচন করলে নতুন করে কী ক্ষতি হতো? প্রচারের ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেসের বেশিরভাগ প্রার্থীর বেপরোয়াভাবে কোভিডবিধি উপেক্ষার প্রেক্ষিতে পুলিশ, নির্বাচন কমিশনের উদাসীনতায় রাজারহাট, সল্টলেক অঞ্চলের মানুষ শুধু বিরক্ত নয়, আতঙ্কিতও।
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিধাননগর পৌরনিগম অঞ্চলে সংক্রমণে আক্রান্ত ও মৃত মানুষের সংখ্যা কলকাতার পরেই ছিল। এবারেও সংক্রমণ হাজার ছাড়িয়েছে। পুলিশ থেকে শুরু করে বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ও কর্মীদের আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। এই পৌরনিগম অঞ্চলে গত কয়েকবছর ধরে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। পৌর হাসপাতালগুলো ও মহকুমা হাসপাতালে পরিষেবা না থাকা, অনেক ক্ষেত্রে ধ্বংস করার কারণে মানুষের হয়রানি, অসহায়তা বেড়েছে। ভিআইপি রোড পার্শ্বস্থ ও সল্টলেকের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সম্পদ বেড়েছে। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে পৌরনিগমের সংগঠিত কোনো উদ্যোগ প্রায় দেখা যায়নি। রেড ভলান্টিয়ার আর শ্রমজীবী ক্যান্টিনই মানুষকে ভরসা দিয়েছিল। এখন তৃতীয় ঢেউয়ের সময় নির্বাচন ও বিধি না মানা তাই মানুষের আতঙ্ক বাড়াচ্ছে।
রাজারহাট-গোপালপুর পৌরসভা ও বিধাননগর পৌরসভাকে একত্রিত করে ২০১৫ সালে বিধাননগর পৌরনিগম হয়। রাজারহাট নাম যুক্ত না করায় নাগরিক সমাজ আন্দোলনে পথে নামে। কিন্তু তাঁদের মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পৌরনিগম গঠন করা হয় এবং নির্বাচনে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস চালিয়ে পৌরনিগম তৃণমূল দখল করে। ওই নির্বাচনে সাংবাদিক থেকে আবাসিক সবাই রক্তাক্ত হন। এবারেও ৪১টা ওয়ার্ডেই একই কায়দায় নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার ইঙ্গিত স্পষ্ট। সেই সঙ্গে এবারে তৃণমূলের চরম গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হতে পারার সম্ভাবনাও প্রবল।
গত পাঁচ বছর তৃণমূল কংগ্রেসের পরিচালনায় ওয়ার্ড কমিটি, নাগরিক কমিটির অস্তিত্ব মুছে গেছে। উন্নয়নে ব্লক কমিটি থেকে পাড়ার বাসিন্দাদের বক্তব্য উপেক্ষিত হয়েছে। ভিআইপি রোড সংলগ্ন রাজারহাট অংশে, সল্টলেকের সংযুক্ত অংশে বেআইনি বহুতল বেড়েছে। বামফ্রন্টের পৌরবোর্ডের পরে নিকাশি, পরিশ্রুত পানীয় জল, রাস্তা নিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত বা কাজ কিছুই হয়নি। বাগজলা, কেষ্টপুর খালের কোনো সংস্কার হয়নি। এমনকি নিকাশি, পানীয় জল নিয়ে বাম বোর্ডের সিদ্ধান্তকেও রূপায়িত করা হয়নি। কিছু প্রসাধনী উন্নয়নে অর্থের অপচয় হয়েছে। মেট্রো রেল তৈরির কারণে দত্তাবাদ অঞ্চলের মানুষদের পুনর্বাসন দেওয়ার ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক রং দেখার অভিযোগে মানুষ সরব। খাসমহল, ছয়নাভি সহ সংযুক্ত অঞ্চলে ভেরি সমবায়ে সবুজায়ন প্রকল্প থেকে ভেরি দখল করে বিভিন্ন কোম্পানিকে বিক্রি করা, ভেরি শ্রমিকদের উপর অত্যাচার, সরকারি জমি দখল করে বহুতল তৈরি সহ বহু অভিযোগ শাসক দলের বিরুদ্ধে। বিধবা ভাতা সহ নানা সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত প্রকৃত গরিব মানুষ।
১৩ নম্বর ওয়ার্ডে প্রচার প্রার্থী মহসিন আহমেদ।
সিপিআই(এম)-র বিদায়ী কাউন্সিলর ও এবারেও ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী মহসিন আহমেদের কথায়, ‘পৌরবোর্ডের সভা ক্লাব সভার থেকেও নিম্নমানের ছিল। উন্নয়ন নিয়ে ওদের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে প্রচুর সময় নষ্ট হয়েছে। বিরোধী কাউন্সিলরদের অঞ্চলে কাজে নানাভাবে বাধা তৈরি করা হয়েছে। ঠিকাদারদের বিল মেটানোর ক্ষেত্রে পছন্দ অপছন্দ গুরুত্ব পেয়েছে। নিম্নমানের কাজের ফলে দুর্ভোগ বেড়েছে। কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির দাবিও আলোচনা হয়নি। দুর্নীতি, অর্থের অপচয়ে একাধিক অভিযোগ উঠে এলেও তা চাপা দেওয়া হয়েছে।’ পৌরনিগমের মেয়রকে সরাতে দীর্ঘ সময় পৌরনিগম স্তব্ধ হয়ে ছিল। তৃণমূলের সেই মেয়র কয়েকমাস আগে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনিই এবারে আবার তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী।
বামফ্রন্টের প্রার্থী তালিকায় রাধানাথ চাঁদ, শাশ্বতী মণ্ডল, মহসিন আহমেদের মতো বিভিন্ন কাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষ কাউন্সিলররা যেমন আছেন, আবার বাসব বসাকের মতো শিক্ষক ও বিজ্ঞান আন্দোলনের অগ্রণী কর্মী, পরীক্ষিত সমাজকর্মী-সংগঠকও আছেন। ১৫ জন মহিলা, ১৪ জন রেড ভলান্টিয়ার সহ অঞ্চলে পরিচিত পার্টি কর্মীরা আছেন এবারের প্রার্থী তালিকায়। বাড়ি বাড়ি প্রচারে গিয়ে বাম প্রার্থীরা শুনছেন সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তায় জল জমা, বাড়িতে জল ঢোকার সমস্যা, বেহাল রাস্তা, পানীয় জলের সমস্যার কথা। বেআইনি নির্মাণ থেকে জলা জমি ভরাটের অভিযোগ করেছেন বাসিন্দারা। কাউন্সিলরের দেখা না পাওয়া, ট্রেড লাইসেন্স, পৌর হাসপাতালগুলো থেকে শুরু করে বিধাননগর মহকুমা হাসপাতাল নিয়ে হাজারো অভিযোগ রয়েছে শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। আর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অসামাজিক কাজে তিতিবিরক্ত মানুষ। তাঁরা বাম প্রার্থীদের কাছে এসব নিয়ে নানা কথা বলছেন। কিন্তু অন্যান্য নানা বিষয়ের সাথে সর্বত্র মানুষের একই প্রশ্ন - ভোট দিতে পারব তো ? তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে যে ভোট-সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি হবে না তো? পৌরনিগম অঞ্চলে শান্তি শৃঙ্খলার বাতাবরণ ফিরিয়ে আনতে বিশিষ্টজনেরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানাচ্ছেন। সিপিআই(এম) সহ বামদলগুলো ই-সভা, কোভিডবিধি মেনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসহনীয় অবস্থার অবসানের আবেদন জানাচ্ছে।
ভোট লুটের আশঙ্কার বাস্তবতা ইতিমধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দশদ্রন, রঘুনাথপুর, কৈখালি, পোলেনাইট সহ নানা জায়গায় ইতিমধ্যে বাম প্রার্থীদের ফ্লেক্স, পতাকা ছিঁড়ে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। বাড়িতে গিয়ে, পথে প্রার্থী থেকে কর্মীদের উপর হুমকির ঘটনা ঘটছে, গোপনে ধমকানো চমকানো চলছে। প্রচারে, ভোটের দিন বাড়িতে থেকে না বেরোনোর নির্দেশ যাচ্ছে। সুকান্ত নগর অঞ্চলে বাইপাস ও বিধাননগরের সংযোগ স্থলে বিশাল ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। প্রতিদিন বহিরাগতদের আসা, সেখান থেকে সল্টলেকের অঞ্চল চেনানোর কাজ চলছে। একদিকে দিনবদলের আকাঙ্ক্ষায় মানুষ বাম প্রার্থীদের সাদরে গ্রহণ করছেন, অন্যদিকে অতীতের মতোই ভোটকে প্রহসনে পরিণত করতে শাসকদল প্রস্তুত হচ্ছে। পুলিশ, প্রশাসন নির্বিকার।