৫৯ বর্ষ ২২ সংখ্যা / ১৪ জানুয়ারি, ২০২২ / ২৯ পৌষ, ১৪২৮
সিপিআই(এম) অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য ২৬তম সম্মেলন
সম্মেলনের উদ্বোধন করছেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ গণ লাইন সম্পন্ন শক্তিশালী পার্টি গড়ে তুলতে হবে। জোরদার করতে হবে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য। কেন্দ্রীয় সরকার ও তার নীতির বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে হবে। পরাস্ত করতে হবে কেন্দ্রের মোদি সরকারকে। প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় সিপিআই(এম) অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য ২৬তম সম্মেলন থেকে উচ্চারিত হলো এই আহ্বান। ২৭ থেকে ২৯ ডিসেম্বর এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় গুন্টুর জেলার টাডেপল্লীতে।
সম্মেলন থেকে ৫০ সদস্যের নতুন রাজ্য কমিটি নির্বাচিত হয়েছে। নব গঠিত রাজ্য কমিটির প্রথম সভা থেকে সর্বসম্মতিতে সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ভি শ্রীনিবাস রাও।
সম্মেলনস্থলের নামকরণ করা হয় প্রয়াত নেতা কমরেড জাককা ভেঙ্কাইয়া, টি নরসিমহাইয়া, সুন্নাম রাজাইয়া, রেড্ডি শ্রীরামমূর্তি এবং টি সাদরেক-এর নামে।
প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা বি বি তুলসিরাও সম্মেলনের শুরুতে রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর শহিদ বেদিতে ফুল এবং মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
সম্মেলনের উদ্বোধন পর্বে শহিদ স্মরণে আনা মশাল গ্রহণ করছেন ভি শ্রীনিবাস রাও।
উদ্বোধনী পর্ব
২৭ ডিসেম্বর সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক পি মধু। অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান ভি কৃষ্ণাইয়া স্বাগত ভাষণে প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকদের অভিনন্দিত করেন।
সম্মেলনের উদ্বোধন করে পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, আগামী দিনে মূল লক্ষ্য হলো কেন্দ্রের মোদি সরকারকে পরাস্ত করা। দেশে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নেতৃত্বে আরএসএস’র হিন্দুত্ব রাষ্ট্রের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই সরকার সংবিধানের অমর্যাদা করছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ব রাষ্ট্রে বদলে দেবার পথ প্রশস্ত করছে। এরা ভারতীয় সংবিধানের ভিত্তিকে এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য সমূহকে ধ্বংস করছে।
সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, এটা এমন একটা বিষয় যা চলতে দেওয়া যায় না। কেন্দ্রীয় সরকার ও তার নীতির বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে হবে পার্টি কর্মীদের। তিনি তাঁর বক্তব্যে চিলি এবং লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলির সাম্প্রতিক পরিবর্তন এবং শক্তিধর দেশ হিসাবে চীনের উত্থান ইত্যাদি বিষয় ব্যাখ্যা করে তার ইতিবাচক দিকগুলি তুলে ধরেন। এরপর তিনি এক বছর ধরে চলা কৃষক আন্দোলনের জয়ের প্রসঙ্গ তুলে কৃষকদের লাগাতার লড়াইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাঁর বক্তব্যে নিপীড়িত মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম সফল হবেই এই প্রত্যয় ছড়িয়ে যায় সমবেত জনগণের মধ্যে।
উদ্বোধনী পর্বের অন্যতম বক্তা হিসেবে সিপিআই(এম) তেলেঙ্গানা রাজ্য সম্পাদক টি বীরভদ্রম বলেন, রাজ্যটি দু’টি ভাগে বিভক্ত হলেও, খেটে খাওয়া ও সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলি নিয়ে শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তেলেগু জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সিপিআই রাজ্য সম্পাদক কে রামকৃষ্ণ তাঁর বক্তব্যে সম্মেলনের প্রতি সহমর্মিতা জানান এবং দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির ও শক্তির একীকরণের কথা বলেন।
সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত একটি প্রস্তাবে অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য ২০১৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ পুনর্গঠন আইনে ‘বিশেষ বিভাগের মর্যাদা’ দেওয়ার আশ্বাস বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয় এবং ওই দাবি আদায়ের জন্য জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।
সম্মেলন থেকে রাজ্য সরকারকে অমরাবতীকে রাজধানী হিসাবে স্থায়ী করার এবং কুর্নুলে অন্ধ্রপ্রদেশ হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ভি শ্রীনিবাস রাও এই প্রস্তাবটি পেশ করে বলেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ্যের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বিজেপি। এই বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় এসেছে।
ভি শ্রীনিবাস রাও বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারকে পোলাভারম প্রকল্প, বিশাখাপত্তনম রেলওয়ে জোন, ইস্পাত কারখানা, রামায়াপত্তনম বন্দর, রাজধানী শহর, রায়লসীমা এবং উত্তর উপকূলীয় অন্ধ্রপ্রদেশের পিছিয়ে পড়া অঞ্চল এবং কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উন্নয়নের জন্য অবিলম্বে ব্যয় বরাদ্দ করতে হবে।
সম্মেলনে গৃহীত অপর একটি প্রস্তাবে রাজ্যের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, অন্ধ্রপ্রদেশে ক্ষমতাসীন ওয়াইএসআর কংগ্রেস একটি ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করছে যে নবরত্ন (কল্যাণ) প্রকল্পগুলি সমস্ত সমস্যার একমাত্র সমাধান। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে, বিজেপি সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলি তাদের সুবিধাবাদী, অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে ফায়দা তুলতে ব্যস্ত। প্রস্তাবে বিজেপির বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে এই দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রতিনিধি অধিবেশন পর্ব
প্রতিনিধি অধিবেশন পর্ব শুরু হয় বিকেলে। এম এ গফুর, ডি রামাদেবী, ভি ভেঙ্কটেশ্বরলু, কে লোকনাধাম, কুঞ্জ সীতারামাইয়াকে নিয়ে প্রেসিডিয়াম গঠিত হয়। শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন রাজ্য সচিবালয়ের সদস্য ওয়াই ভেঙ্কটেশ্বর রাও।
রাজনৈতিক সাংগঠনিক খসড়া রিপোর্ট পেশ করেন সম্পাদক পি মধু। তিনি ২০১৮ সালে ভীমাভারমে শেষ সম্মেলনের পর থেকে বিগত সময়ে পার্টির নেতৃত্বে লড়াই সংগ্রাম সম্পর্কে বলেন, এই পর্বে পার্টি রাজ্যের জন্য বিশেষ বিভাগের মর্যাদা দাবি করা থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ে স্থানীয় সমস্যা এবং জনগণকে সংগঠিত করা সহ কৃষিজীবী-শ্রমজীবীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বহু সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে।
খসড়া রিপোর্টের উপর ২৩টি জেলা থেকে ৩৭ জন এবং বিভিন্ন গণফ্রন্টের ৩৬ জন প্রতিনিধি পরবর্তী দেড় দিন ধরে আলোচনায় অংশ নেন। প্রতিনিধিদের আলোচনা থেকে কিছু প্রস্তাবনা ও সংশোধনীর প্রস্তাব উঠে আসে।
জবাবি ভাষণে বিদায়ী সম্পাদক পি মধু প্রতিনিধিদের আলোচনার প্রশংসা করেন এবং কয়েকটি ইস্যু ব্যাখ্যা করেন। জবাবি ভাষণের পর সর্বসম্মতিতে রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রতিবেদন গৃহীত হয়।
সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে বিশাখা স্টিল প্ল্যান্ট, রাজ্যের রাজধানী হিসাবে অমরাবতী, কুর্নুলে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত সহ সমস্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়।
এই পর্বে পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাত তাঁর বক্তব্যে প্রতিনিধিদের সমালোচনা এবং আত্মসমালোচনামূলক খোলামেলা আলোচনার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে কলকাতা প্লেনামে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে গণ লাইন সম্পন্ন শক্তিশালী পার্টি গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি সমস্ত স্তরের পার্টি ইউনিটগুলিকে মহামারীর সময়ে অসামান্য পরিষেবা প্রদানের জন্য অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, সর্বভারতীয় স্তরে এবং এই রাজ্যেও প্রধান বিপদ হিন্দুত্ব। বিজেপি-আরএসএস বাহিনী জনগণের মধ্যে জায়গা করার জন্য সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করে চলেছে। এ সম্পর্কে সজাগ থাকার জন্য তিনি প্রতিনিধিদের আহ্বান জানান।
প্রসারিত করো গণ সংগ্রাম
পার্টি পলিট ব্যুরোর সদস্য বি ভি রাঘভুলু সম্মেলনের সমাপ্তি ভাষণে বাস্তব পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মধ্যদিয়ে মার্কসবাদকে সেই পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োগ করার গুরুত্বের ওপর জোর দেন। তিনি এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটির নথির উল্লেখ করে প্রতিনিধিদের নব্যউদারনীতির পটভূমিতে কৃষি পরিস্থিতি, শ্রমিক শ্রেণি এবং মধ্যবিত্তদের অবস্থার প্রেক্ষিতে লড়াই সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য সজাগ থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আবাসিক এলাকায় বহুমুখী কার্যক্রম চালু ও সম্প্রসারণ করতে হবে।
বি ভি রাঘভুলু বলেন, জনগণের ইস্যুতে ব্যাপকভাবে তীব্র এবং ধারাবাহিক সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পার্টি সংগঠনকে সুসংহত করে এগোতে হবে। ২৬তম সম্মেলন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে এগিয়ে যেতে দ্বি-মেরুর রাজনীতি চূর্ণ করে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য জোরদার করার জন্য তার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেছে।
সম্মেলনে প্রতিনিধি এবং পর্যবেক্ষক মিলিয়ে মোট ৪৫৪ জন অংশ নিয়েছেন। এই ৪৫৪ জন এরমধ্যে ৪৪৩ জন নির্বাচিত। মহিলার সংখ্যা ৭৭ জন,অর্থাৎ মোট প্রতিনিধি সংখ্যার ১৭ শতাংশ। ৪০ বছরের নিচে ৭৫ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ১৫২ জন এবং ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ১৪০ জন। বয়সের দিক থেকে সবথেকে প্রবীণ দুজন, ৮১ বছর বয়স্ক পাতরু রামাইয়া (যিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য) এবং ওয়াই কেশব রাও। প্রতিনিধিদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ দু’জন, যাদের বয়স ২৩ বছর। তারা হলেন আবদুল্লাহ এবং ভেঙ্কটেশ্বর রাও।
প্রতিনিধি এবং পর্যবেক্ষকদের মধ্যে শ্রেণিগত উৎসের দিক থেকে শ্রমিক শ্রেণি থেকে এসেছেন ৬৬ জন, খেতমজুর ৭৯ জন এবং গরিব কৃষক ৫৯ জন। অর্থাৎ সবমিলিয়ে মূল শ্রেণির ৪৬ শতাংশ। সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের তপশিলি জাতিভুক্ত ৫৮ জন, আদিবাসী ২৯ জন এবং অন্যান্য পিছড়ে বর্গের ১৫৮ জন।
পার্টিতে যুক্ত হবার ক্ষেত্রে প্রতিনিধিদের তিনজন ১৯৬০ সালের আগে যোগ দিয়েছেন, ১৪ জন ১৯৬১ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে যোগ দিয়েছেন এবং ১৩৪ জন পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে। অর্থাৎ নয়াউদারবাদী নীতির জমানায় পার্টিতে যুক্ত হয়েছেন প্রতিনিধি এবং পর্যবেক্ষকদের দুই-তৃতীয়াংশ। প্রতিনিধিদের মধ্যে ৪৪ জন অর্থাৎ ১০ শতাংশ কমরেড আত্মগোপনে কাটিয়েছেন এবং ২১১ জন অর্থাৎ প্রায় ৫০ শতাংশ রাজনৈতিক কারণে কারাবাস করেছেন।
সম্মেলন থেকে ৫০ সদস্যের নতুন রাজ্য কমিটি নির্বাচিত হয়েছে। এই ৫০ জনের মধ্যে আট জন আমন্ত্রিত এবং পাঁচজন বিশেষ আমন্ত্রিত। রাজ্য কমিটির প্রথম সভা থেকে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী নির্বাচিত হয়েছে। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে নেওয়া হয়েছে দু’জনকে।