৫৯ বর্ষ ২২ সংখ্যা / ১৪ জানুয়ারি, ২০২২ / ২৯ পৌষ, ১৪২৮
‘ইসকাফ’-এর সত্যজিৎ শতবার্ষিকী সংখ্যাঃ অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি সংকলন
অধ্যাপক ডঃ পল্লব সেনগুপ্ত
ভারতের সাংস্কৃতিক সহযোগিতা ও মৈত্রী সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদ (আইএসসিসিএফ)-এর মুখপত্র ‘ইসকাফ’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যাটি ক’দিন আগে প্রকাশিত হয়েছে। ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সহৃদয়-বন্ধুতার সূত্রে সংখ্যাটি হাতে পাবার এবং পড়ে ফেলবার অনবদ্য একটি সুযোগও মিলেছে।
সংখ্যাটি নিবেদিত হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতির উদ্দেশে, তাঁর জন্মশতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে। আয়তনে খুব বড়ো না-হলেও, এর অন্তর্গত প্রবন্ধগুলির কারণে সংখ্যাটির ওজন কিন্তু খুবই বেশি! সত্যজিৎ-শতবর্ষে প্রচুর পত্রপত্রিকাতেই প্রচুরতর লেখাপড়ার সুযোগ মিলেছে ঠিকই। কিন্তু এই স্বল্পায়তন পত্রিকাটির মধ্যে সংকলিত লেখাগুলো সাম্প্রতিক পারিপার্শ্বিকে সত্যজিৎ-বন্দনের প্রচলিত রীতির বাইরে গিয়ে অনেক কিছু নতুন করে জানিয়েছে, নতুন করে ভাবিয়েছে।
এই সংখ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখা হলো স্বয়ং সত্যজিৎ রায়েরই প্রবন্ধ ‘সোভিয়েট চলচ্চিত্র - পঞ্চাশ বছর’ প্রবন্ধটি। রুশ বিপ্লবের অর্ধশতাব্দী পূর্তি উপলক্ষে ধরণী গোস্বামী ও অমিয় গুপ্তের সম্পাদনায় ‘সোভিয়েৎ বিপ্লব পরিচয়’ সংকলন থেকে এটিকে পুনর্মুদ্রিত করে ‘ইসকাফ’ খুব বড়ো একটা দায়িত্ব পালন করেছে। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি তখন হয়ত প্রবীণেরা পড়েছিলেন পরবর্তীদের কাছে এটা একেবারেই অপরিচিত ছিল। বিস্মৃতির স্তূপ থেকে এই নিবন্ধটি তুলে আনার কারণে, বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিংশ শতাব্দীর প্রায় শুরু থেকেই পরবর্তী প্রায় সাড়ে ছ’টি দশকের রুশি-তথা-সোভিয়েত সিনেমার একটি ছোটো, কিন্তু ব্যাপ্তিময় ইতিহাসকে ধরা আছে এই লেখায়। বিশ্বের চলচ্চিত্র নিয়ে যাঁরা পড়াশুনা করেন, তাঁদের বাইরে যে-বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠী রয়েছেন তাঁদের কাছে এই লেখাটি তো তথ্যের রত্নখনি বটেই, তার সঙ্গে এর মধ্যে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের প্রাজ্ঞ এবং অন্বিষ্ট বিশ্লেষণ। ভারসাম্যে নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক দৃষ্টিতে সত্যজিৎ এই দীর্ঘ সময়কালে রুশ চলচ্চিত্রের সামগ্রিক মূল্যায়নের ফাঁকে-ফাঁকেই উল্লেখযোগ্য কিছু সিনেমা এবং বরেণ্য কিছু চলচ্চিত্র পরিচালকের কাজের অপক্ষপাতী বিচার করেছিলেন, যেটা এখনকার সিনেমা-ক্রিটিকদের কাছেও যেন দিশারি বলে ধার্য হতে পারে।
এই সংখ্যার আর একটি খুব মূল্যবান লেখা হচ্ছে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ত্রিধারা সংগমে সত্যজিৎ রায়’ - যেখানে সত্যজিতের সৃষ্টির আড়ালে-থাকা নানান প্রেরণার উৎসমুখগুলি অত্যন্ত মননশীল একটা আলোচনা পড়তে পাওয়া গেল। শমীক দেখিয়েছেন যে, সব প্রথমে সত্যজিৎ প্রেরণা পেয়েছিলেন ‘‘হলিউডের চিত্রপরম্পরা’’ থেকে। এবং দ্বিতীয় ধারাটি ছিল দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ের ইতালিয় ঘরানার চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রাণিত। আর তৃতীয় ধারা ছিল বিপ্লব-পূর্ব এবং বিপ্লব-পরবর্তী রুশীয় চলচ্চিত্রের সম্ভার থেকে উৎসারিত। এই সব ক’টি উৎসমুখ থেকেই প্রেরণা পান বটে, তবে এই প্রারম্ভিক অনুধ্যানকে অতিক্রম করেই সৃষ্টি হয় তাঁর নিজস্ব একটি শিল্পশৈলী, নতুনতর একটা ভাবনার হয় সঞ্জনন। এভাবে সত্যজিতের সৃষ্টির ক্রম-অয়নকে শমীক চিহ্নিত করে ঋজু অথচ গভীর অভিনিবেশে। তাঁর লেখা থেকে আরও একটা খুব উল্লেখযোগ্য তথ্য মিললঃ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির সম্পত্তি ছিল একটি ১৬ এম এম প্রিন্ট - আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’-এর। এই প্রিন্ট অজস্রবার দেখেছেন সত্যজিৎ; এবং এক সময়ে তিনি ‘‘ছবির দৃশ্যখণ্ড মিলিয়ে মিলিয়ে রেকর্ড বেছে’’ পাশ্চাত্য যন্ত্রসংগীতের সুর সংযোজন করেছিলেনও - যদিও সেই এক্সপেরিমেন্টটার ফসল পরে হারিয়ে যায়! শমীক আরও লিখেছেন, ‘‘বিপ্লবের ভাবাদর্শের যে স্রোত সোভিয়েট চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলির মধ্যে বহমান’’ তার সঙ্গে, ‘‘ইতালীয় নব্যবাস্তবতা’’ পেরিয়ে ঐতিহাসিক বাস্তবতার একটা মাত্রা খুঁজে পেয়েছিলেন সত্যজিৎ। এবং ‘‘কালোত্তীর্ণ মহৎ সাহিত্যের’’ সঙ্গে যে তুলনীয় সেটা তাঁর সমস্ত সৃষ্টিধারার মধ্যেই প্রতিবিম্বিত।
শমীক এই যে কথাটার দিশা দিয়েছেন, তার প্রত্যক্ষ এবং সুনির্দিষ্ট প্রকাশ দেখা গেছে ভানুদেব দত্তের লেখা সত্যজিতের স্মৃতিকথন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষায় তাঁর মূল্যায়ন বিষয়ের তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধটিতে। ‘আইএসসিসিএফ’ (‘ইসকাফ’ যাঁদের মুখপত্র)-এর পূর্বরূপ ‘ইসকাস’-এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সত্যজিৎ সংযুক্ত ছিলেন। ‘‘আসলে তিনি মনোভাব ও মানসিকতার দিক থেকে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগঠনের কাছাকাছি ছিলেন’’ বলেই এটা হয়েছিল। এই ‘‘কাছাকাছি’’ থাকার অনেক তথ্য শ্রীদত্তের স্মৃতিচারণে আত্মপ্রকাশ করেছে। এবং সমস্ত সময়ে প্রত্যক্ষভাবে বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও তার প্রতি তাঁর সহমর্মিতা যে ছিল, সেটা শ্রীদত্তের লেখা থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়। যেমন বোঝা যায় এই বিষয়টা তার বিভিন্ন সিনেমাতেও, বিশেষত বলব ‘‘হীরক রাজার দেশে’’-র মধ্যে - যাতে রূপকথার পোশাক পরিয়ে বস্তুতপক্ষে ঐতিহাসিক বস্তুবাদী চিন্তার বিন্যাস করেছেন তিনি। তখন আর তা শুধু ছোটোদের জন্যে তৈরি একটি ফিল্ম নয় - দস্তুরমতো সমাজবিজ্ঞানের উপচারে ঋদ্ধও বটে!
চন্দন সেন একটা নতুন ভঙ্গিতে সত্যজিতের মূল্যায়ন করেছেন প্রধানত ‘অপরাজিত’ সিনেমাটিকে অবলম্বন করে। সত্যজিতের ব্যক্তিজীবনের প্রতিভাস আর অপুর জীবনপথের পদক্ষেপকে বিচিত্রভাবে তুলনা করেছেন তিনি।
শর্মিলা ঠাকুরের নিবন্ধে সত্যজিৎকে ‘‘একই সঙ্গে বাঙালি এবং আন্তর্জাতিক’’ রূপে দেখানো হয়েছে। তিনি সত্যজিতের চলচ্চিত্রে অনেকবারই নায়িকার রূপে উপস্থিত হয়েছেন। তাই তাঁর লেখায় স্মৃতিচারণা তো থাকবেই, তার গুরুত্বও অনেক। কিন্তু তারই সঙ্গে তিনি যেভাবে সত্যজিতের ‘বাঙালিয়ানা’ এবং ‘বিশ্বজনীনতা’-র অন্বেষণ করেছেন সেটা বাস্তবিক প্রশংসার্হ।
দীপঙ্কর সরকারও তাঁর স্মৃতিচারণে এমন কিছু তথ্যের প্রতিবেদন করেছেন, যা সেই মানুষটিকে উপলব্ধির পাথেয় জোগায়। শুভা দাসমল্লিকের ‘বিজ্ঞানপ্রেমী সত্যজিৎ’ আকর্ষণীয় লেখা। শুধু শঙ্কুই যে তাঁর বিজ্ঞান প্রীতির জাতক নয়, প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান মানবসভ্যতার অগ্রগতিকে যে প্রশ্নচিহ্নের সামনে ফেলে দিয়েছে, ‘আগন্তুক’ অবলম্বনে সেটা লেখিকা দেখিয়েছেন।
সবগুলি লেখা মিলিয়ে নিঃসন্দেহে ‘ইসকাফ’-এর এই বিশেষ সংখ্যাটি খুবই মূল্যবান। যত্ন করে রাখবার মতো। শুধু একটি অনুযোগঃ সত্যজিতের ‘ফ্যামিলি ট্রি’ আরও ব্যাপ্ত করে দেখালে ভালো হতো। বিশেষত ডাঃ কাদম্বনী গাঙ্গুলী এবং লীলা মজুমদার - এঁরা দু'জন সেখানে বাদ পড়াটা মানা গেল না যে!