৬০ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৪ জুলাই, ২০২৩ / ২৮ আষাঢ়, ১৪৩০
গণতন্ত্র দলনে শাসকদল, পুলিশ-প্রশাসন একাকার
২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচন সন্ত্রাস ও ব্যভিচারের নজির হয়ে রইল
পঞ্চায়েত ভোটে প্রহসনের বিরুদ্ধে বামফ্রন্ট-কংগ্রেস-আইএসএফ-র কেন্দ্রীয় প্রতিবাদ মিছিল।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ রাজ্যে গণতন্ত্র আক্রান্ত, বিধ্বস্ত-কলঙ্কিত রাজ্যের ঐতিহ্য। তৃণমূলী জমানার জঘন্য অপকীর্তির নজির সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হিংসা, সন্ত্রাস, রক্তপাত ও মৃত্যু মিছিল একদিকে যেমন রাজ্যবাসীকে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত করেছে, অন্যদিকে এই ভয়াবহতা ও শাসকদলের কুৎসিত মারণ খেলায় গোটা দেশ ও বহির্বিশ্বের আঙিনায় বাংলার মানুষের মাথা নিচু করে দিয়েছে। শাসকদলের এই সমস্ত অপকীর্তি-অপহ্নব, নির্বিচারে রক্ত ঝরানো ও খুনের মত্ততা যেন আজ রাজ্যের স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে!
১৯৭৮ সালে বামফ্রন্ট সরকারের জমানায় ত্রিস্তর পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠার পর থেকে পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিল গ্রামীণ মানুষের কাছে গণতন্ত্রের উৎসব। তখন গ্রামাঞ্চলের মানুষ নিজেদের স্বার্থেই তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন মানুষের পঞ্চায়েত। তৃণমূলের জমানায় সেই পঞ্চায়েত আদপে হয়ে দাঁড়িয়েছে লুটের পঞ্চায়েত, আর গণতন্ত্রের উৎসব যেন রূপান্তরিত হয়েছে রক্তপাত আর মৃত্যুর বীভৎসতায়। যেখানে মূল লক্ষ্য গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণ - সেখানে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেন শাসকদলের হিংস্র উন্মত্ততার পরিণামে ৪৭ জন মানুষের প্রাণ যাবে - এই প্রশ্ন আজ সর্বাগ্রে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনেই উঁকি দিচ্ছে। একইসঙ্গে এ প্রশ্নও আজ দেখা দিয়েছে, কেন সাধারণ মানুষ তাঁদের পছন্দমতো প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে গণতান্ত্রিক অধিকার অবাধে প্রয়োগ করতে পারবেন না? কেন সুষ্ঠু-স্বাভাবিক পরিবেশে নির্বাচন সুসম্পন্ন হতে পারবে না? এ দায় কার?
এর উত্তর স্পষ্ট। রাজ্যের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন প্রথমে পঞ্চায়েত নির্বাচন করতে রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত টালবাহানা। তারপর হঠাৎ করেই পছন্দের লোককে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে বসিয়ে দেওয়া, কোনোরকম আগাম প্রস্তুতি ছাড়াই ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের নির্ঘণ্ট ঘোষণা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে যায় গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির প্রতি রাজ্য সরকারের সদিচ্ছা কতটুকু।
নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই বামফ্রন্ট সহ অন্যান্য বিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন পত্র জমা দিতে বাধা দেওয়া, হুমকি, আক্রমণ এমনকী নির্দ্বিধায় রক্ত ঝরিয়ে, খুন করে গণতন্ত্র হরণে মত্ত হয়ে ওঠে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। এই হিংস্রতারই রেশ জারি থাকে স্ক্রুটিনি পর্বে। পেশি শক্তির জোরে, বোমা-বন্দুকের সাহায্যে ভীত-সন্ত্রস্ত করে বামপন্থী ও অন্যান্য বিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করাতে উদ্যত হয় শাসকদলের দুর্বৃত্তরা। মারধর, রক্তপাতই শুধু নয়, অপহরণ, ঘরবাড়ি ভাঙচুরের মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। লক্ষণীয় দিক হলো, শাসকদলের এই সমস্ত কার্যকলাপে প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ নানাভাবে মদত জুগিয়ে গেছে নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ কর্তৃপক্ষ। শাসকদলের প্রতি প্রশাসন ও পুলিশের এমন নির্লজ্জ তাঁবেদারির নজির সম্ভবত কোনো রাজ্যেই দেখা যায়নি।
সিপিআই(এম) সহ অন্যান্য বামপন্থী দল এবং তৃণমূল বিরোধী অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র আটকাতে বিভিন্ন জেলায় অত্যন্ত কুৎসিত ভূমিকায় দেখা যায় বিডিও এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মীদের। হাওড়ার এক বিডিও স্বয়ং সিপিআই(এম) প্রার্থীর মনোনয়ন বিকৃত করার দায়ে অপসারিত হয়েছেন। মিনাখাঁয় শাসকদলের এক প্রার্থী হজে গিয়ে অনলাইনে তাঁর মনোনয়নপত্র পাঠিয়েছেন এবং তা সংশ্লিষ্ট বিডিও নথিভুক্ত করে দায়িত্ব খুইয়েছেন। একইভাবে কদর্য দলদাসের ভূমিকায় দেখা গেছে পুলিশকে। তারা বিভিন্ন স্থানে কার্যত তৃণমূলের ক্যাডারের ভূমিকা পালন করেছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর ১ ব্লকে সিপিআই(এম)’র এক মহিলা প্রার্থী যাতে ব্লক অফিসে মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারেন, তারজন্য স্থানীয় থানার ওসি’র নেতৃত্বে পুলিশবাহিনী (সবাই ছিলেন পুরুষ)-কে প্রকাশ্যে টানা হেঁচড়া করতে দেখা গেছে। শাসকদল তৃণমূলকে তুষ্ট করতে পুলিশের এমন জঘন্য কার্যকলাপও মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর্বে।
সরকারি প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ - সবাই একযোগে মেতে উঠেছিল বামপন্থী ও অন্যান্য তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী শক্তিকে আটকাতে, যাতে তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারে। এই সময়ে একেবারে নির্বিকার ও স্থবির ভূমিকায় দেখা গেছে নির্বাচন কমিশনকে। কিন্তু যখন পঞ্চায়েত নির্বাচনে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বিরোধীদের দাবি ওঠে কেন্দ্রীয় বাহিনী আনার, এবং হাইকোর্টও তার সপক্ষে রায় দেয়, তখন কেন্দ্রীয় বাহিনী আটকাতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া রাজ্য সরকারের লেজুড় ধরে রাজ্য নির্বাচন কমিশনও সুপ্রিম কোর্টে যায়। কিন্তু সেখানে রাজ্য সরকারের সাথে নির্বাচন কমিশনও শীর্ষ আদালতের চপেটাঘাত খেয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। দেখা যায়, কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্যে এলেও তাদের ঠিকমতো মোতায়েন না করে শাসকদলের সুবিধা করে দেয় নির্বাচন কমিশন। খোদ বিএসএফ’র আইজি কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সঠিকভাবে ব্যবহার না করার অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে লিখিত আকারে জানিয়েছেন।
এরপর নির্বাচনের দিন ভোটারদের ভোট দিতে যেতে না দেওয়া, দেদার ছাপ্পা, ভোট লুট, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভাঙা, পুকুরে ফেলে দেওয়া, সেই সঙ্গে নির্বিচারে বোমা-গুলির মধ্যদিয়ে হিংস্র সন্ত্রাসের বেনজির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে শাসক দল। ফলে ভোটের দিনই ১৬ জনের প্রাণ ঝরে যায়। এরপর ৬৯৬টি বুথে উপনির্বাচনের দিনটিও তৃণমূলের হিংসা-সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্ত ছিল না। প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে কিছুটা নিজেদের অপরাধকে আড়াল করতে নির্বাচন কমিশন ১৩ জুলাই ২০টা বুথে পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দিয়েছে।
উল্লেখনীয় দিক হচ্ছে, মনোনয়ন পর্বের শুরু থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের মদতে শাসকদলের দুর্বৃত্তদের লাগামহীন হিংসা-সন্ত্রাস সত্ত্বেও বামপন্থী ও অন্যান্য বিরোধী শক্তি গ্রামের মানুষকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হয়। তাঁরা সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের প্রতিরোধ করেই যেমন বিভিন্ন স্থানে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন, তেমনি নির্বাচনের দিন অকুতোভয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। বলা বাহুল্য, নির্বাচনের দিনও নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশ ছিল কার্যত নির্বিকার এবং শাসকদলের সাহায্যে মগ্ন।
গণনার দিনও শাসকদলের বেপরোয়া হিংস্রতা, নানা বেআইনি কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করেছেন রাজ্যবাসী। গণনায় যতরকমের কারচুপি করা যায় তার দৃষ্টান্ত রেখেছে শাসকদল। বিরোধীদলের প্রার্থী, কাউন্টিং এজেন্টদের মারধর, কাউন্টিং এজেন্টদের গণনা কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকতে বাধা, গণনা কেন্দ্রের ভেতরে নতুন করে ছাপ্পা দেওয়া, বামফ্রন্ট এবং আইএসএফ’র জয়ী প্রার্থীদের জোর করে পুনর্গণনার মাধ্যমে হারিয়ে দেওয়া, জয়ের শংসাপত্র ছিঁড়ে ফেলা, এমনকী বিডিও এবং প্রশাসনের কর্তাদের উপস্থিতিতে সিপিআই(এম) প্রার্থীকে জোর করে হারিয়ে দেওয়ার মতো জঘন্য কার্যকলাপের সাক্ষী থেকেছেন রাজ্যবাসী। এছাড়াও সিপিআই(এম)’র জয়ী প্রার্থী গরিব পরিবারের গৃহবধূর শিশু সন্তানকে তৃণমূলী দুষ্কৃতীরা বন্দুক ঠেকিয়ে অপহরণ করে এবং সেই প্রার্থীকে শাসকদলে যোগ দিতে বাধ্য করানোর মতো বর্বরোচিত ঘটনা ঘটিয়েছে শাসকদল। এভাবেই জনমতকে পদদলিত করে গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করেছে মমতা ব্যানার্জি’র দল তৃণমূল কংগ্রেস।
তবুও অন্যায়, অপরাধ, হিংসা ও বর্বরতা যে কখনোই চেতনাদীপ্ত মানুষকে অবদমিত করে রাখতে পারে না, তার নজির রেখেছেন গ্রাম বাংলার মানুষ। এত হিংসা-সন্ত্রাস-রক্ষপাত-খুনের আবহের মধ্যেও যেখানে যেখানে সুষ্ঠু স্বাভাবিকভাবে মানুষ ভোট দিতে পেরেছেন, সেখানেই জয়ী হয়েছেন লালঝান্ডার প্রার্থী সহ তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী শক্তি। তৃণমূলের হিংসা যত বেড়েছে, তার বিরুদ্ধে এবার মানুষের প্রতিরোধ স্পৃহাও কয়েকগুণ বেড়েছে। এবারের নির্বাচনে হিংসা, রক্তপাত, খুন, জখম, ভোট ডাকাতির মধ্যে এটা একটা উল্লেখযোগ্য দিক।
এদিকে পঞ্চায়েত নির্বাচনের এই অস্বাভাবিক হিংসাশ্রয়ী পরিবেশ এবং গণতন্ত্র হরণের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্ট ১২জুলাই এক নির্দেশে বলেছে, সমস্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ফলাফল ঘোষণা আদালতের বিচারাধীন থাকবে। আদালতের পরবর্তী নির্দেশের ওপরে নির্ভর করবে জয়ী প্রার্থী ঘোষণাও।
শাসকদলের কাছে পঞ্চায়েত হচ্ছে লুটের কারখানা-এর বিরুদ্ধেই মানুষের লড়াই। প্রশাসন, নির্বাচন কমিশনের মদতে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে, গণতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করে যেভাবে শাসকদল নির্বাচনে জয়ের উল্লাসে মত্ত হয়েছে, তা কখনই চিরস্থায়ী হতে পারে না। রাজ্য তথা দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট, এই রায় কোনোভাবেই সঠিক জনমতের রায় নয়। মানুষ এবারের নির্বাচনী লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন তারা প্রস্তুত হচ্ছেন প্রতিরোধের বৃহত্তর লড়াইয়ে। তৃণমূলীরা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে, সামগ্রিকভাবে রাজ্যের সুষ্ঠু স্বাভাবিক গণতন্ত্রের পরিবেশকে যেভাবে বানচাল করে সর্বস্তরে শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চাইছে - তার মধ্যেই ওদের পতনের রাস্তা তৈরি হচ্ছে। রাজ্যের মানুষ সেই পতনকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যেই প্রস্তত হচ্ছেন।