E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৪ জুলাই, ২০২৩ / ২৮ আষাঢ়, ১৪৩০

পুনর্নির্বাচনের নামে প্রহসন


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ১০ জুলাই ৬৯৬টি বুথের পুনর্নিবাচনেও গ্রাম বাংলার বেশ কিছু এলাকায় অব্যাহত থাকল শাসকদলের হিংসা এবং ভোট কারচুপি। রাজ্য নির্বাচন কমিশন বিরোধীদের যাবতীয় দাবি এবং অভিযোগ নস্যাত করে পুনর্নিবাচনের তালিকা প্রকাশ করলেও এদিন ভোটগ্রহণ পরিস্থিতির সামগ্রিক কোনো উন্নতি হয়নি। ৯ তারিখ তালিকা বেরনো মাত্রই পুনর্নিবাচনের নির্ধারিত বুথ সংলগ্ন এলাকায় নেমে পড়ে শাসকদল। মানুষকে সন্ত্রস্ত্র করতে রাত থেকেই একাধিক জেলার বিভিন্ন এলাকায় চলে বাড়ি বাড়ি হামলা, তৃণমূলকে ভোট না দিলে দেখে নেবার হুমকি, ভীতি প্রদর্শন, বোমাবাজি। পরদিন সকালে কোনও কোনও জায়গায় ভোট চলাকালীন টহলরত রাজ্য পুলিশের ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর নাকের ডগায় মুড়ি মুড়কির মতো বোমা পড়েছে। কোথাও কোথাও ভোটদাতাদের লাইন থেকে ভোটারকে গ্রেফতার করার ঘটনাও ঘটেছে। ৮ তারিখ প্রবল সন্ত্রাস এবং ছাপ্পার জেরে পুনর্নির্বাচনের দিন ঘটেছে ভোট বয়কটের ঘটনাও। আতঙ্ক অগ্রাহ্য করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ পৌঁছে গেছেন ভোট কেন্দ্রে, প্রয়োগ করেছেন ভোটাধিকার।

এদিকে ভোটের দিন ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধা দান, এবং বিভিন্ন এলাকায় ভোট প্রক্রিয়া বানচাল করার বিরুদ্ধে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

পুনর্নির্বাচনের আগে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি দিয়ে বলেন, যে সমস্ত বুথে পুনর্নির্বাচন হবে, সেখানে যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা যেন করা হয়।

নির্বাচন কমিশন ৯ তারিখেই জানিয়েছিল রাজ্যের যে সমস্ত বুথে ৮ জুলাই ভোট গ্রহণে বাধা পড়েছে এবং যেখানে মানুষ ভোট দিতে পারেননি এমন বুথগুলিতেই পুনরায় ভোট গ্রহণ হবে। তবে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে জেরবার কমিশনের তরফে রাজ্যস্তরে দায় এড়াতে পুনর্নিবাচনের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হয়নি, বরং বিচ্ছিন্নভাবে জেলাওয়াড়ি তালিকা প্রকাশ করেই দায় সারা হয় ৯ জুলাই। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানানো হয়, জেলা থেকে রিটার্নিং অফিসাররা যে তথ্য পাঠিয়েছেন তা স্ক্রুটিনি করে কমিশন সিদ্ধান্ত নেয় কতগুলি বুথে পুনরায় ভোট গ্রহণ করা হবে। এ প্রসঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ক্ষোভে সোচ্চার হন বিভিন্ন জেলার সিপিআই(এম) নেতৃত্ব। আশ্বাস সত্বেও ১০ তারিখেও একাধিক জায়গায় ছাপ্পা রিগিং, ভোট লুঠের এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর অনুপস্থিতি ও রাজ্য পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার ছবির কোনো পরিবর্তন হয়নি।

কমিশনের তালিকা অনুযায়ী মুর্শিদাবাদ জেলাতেই সবচেয়ে বেশি ১৭৫ টি বুথে পুনরায় ভোট গ্রহণ করা হয়। এ প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরের সিপিআই(এম) মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক জামির মোল্লা বলেন, পুনর্নির্বাচনের বুথ চিহ্নিত করানো হয়েছে তৃণমূলকে সুবিধা করে দিতে। অনেক লুটের বুথেই মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি। প্রশাসনকে আন্দোলনের রাস্তাতেই এর জবাব দেওয়া হবে।

পুনর্নির্বাচনের বুথ বাছাই সম্পর্কে কোচবিহারের সিপিআই(এম) জেলা সম্পাদক অনন্ত রায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘...দিনহাটা মহকুমার প্রতিটি বুথেই পুনর্নিবাচন হওয়া উচিত। পুনর্নির্বাচন চলাকালীন এই জেলার দিনহাটাতে শিবেশ্বরের ২৬৮ নম্বর বুথের কাছেই পাট ক্ষেতের আড়াল থেকে ব্যাপক বোমাবাজি করে তৃণমূলীরা। কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং রাজ্য পুলিশের টহলের মধ্যেই এই ঘটনা ঘটে, তারই ফাঁকে সাধারণ মানুষ ভোট দিয়েছেন। আটই জুলাই এখানে নিশ্চিত হা্র বুঝে কংগ্রেস প্রার্থীর মাথা ফাটিয়ে দিয়ে ব্যালট বক্স তুলে নিয়ে গিয়েছিল তৃণমূলীরা। অন্যদিকে, দিনহাটা ভিলেজ ২’র ২৭৬ নম্বর বুথে প্রথম খন্ড ভাঙ্গিনি গ্রামের বাসিন্দা পরিযায়ী শ্রমিক চিরঞ্জিত আর্যি, ভোট দিতে বাড়ি এসেছিলেন, ৮ তারিখ তৃণমূলের ছোঁড়া গুলিতে জখম হয়ে পরে নার্সিংহোমে মারা যান। এখানেও এদিন পুনর্নির্বাচন হয়।

কমিশনের তালিকায় আলিপুরদুয়ার ১টি, দক্ষিণ ২৪পরগনা জেলার ৩৬ টি, বীরভূম জেলার ১৪ টি, পুরুলিয়ার ৪টি বুথে, পূর্ব মেদিনীপুরের ৩১ টি বুথে মালদহে ১০৯ টি বুথে দক্ষিণ দিনাজপুরের ১৮টি, বাঁকুড়ায় ৮টি, হুগলি জেলায় ২৯ টি হাওড়া জেলায় ৮টি, জলপাইগুড়ি জেলায় ১৪ টি, নদীয়া জেলায় ৮৯টি, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় ৪৬টি, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ১০টি, পূর্ব বর্ধমানের ৩টি, উত্তর দিনাজপুরের ৪২ টি এবং কোচবিহারের ৫৪ টি বুথে পুনরায় ভোট নেওয়া হয়।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সবচেয়ে বেশি ডায়মন্ড হারবারে দশটি বুথে পুনরায় ভোটগ্রহণ করা হয়। এখানে পুনর্নির্বাচনের ভোট কর্মী হিসেবে তৃণমূল নেতা কাউন্সিলরদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জেলা নির্বাচন আধিকারিক তথা জেলাশাসকের এই ভূমিকায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন সিপিআই(এম) দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়ী।

উত্তর ২৪ পরগনার বেশিরভাগ বুথগুলিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলেও বুথের বাইরে ছিল তৃণমূলীদের দাপাদাপি। বহু কেন্দ্রে ভোটারদের ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পৌঁছেতে দেওয়া হয়নি, চলেছে দেদার ছাপ্পা ভোট।

পূর্ব বর্ধমান জেলার তিনটি বুথে পুনর্নির্বাচন হয়েছে। এখানে ভাতারে শাসক দল ছাপ্পা দিলে গ্রামের মানুষ ব্যালট বাক্স তুলে নিয়ে পুকুরে জলে ফেলে দেয়।

পূর্ব মেদিনীপুরের ৩১টি বুথে পুনরায় ভোটগ্রহণ হয় তার মধ্যে ময়না ব্লকেরই ১৪টি বুথ। দেশপ্রাণ ব্লকে ১০টি বুথে ভোট হয়। এখানে পুনর্নির্বাচন বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন ৫৫ নম্বর আমতলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৯ নম্বর বুথের গ্রামবাসীরা। এখানে বেশ কিছু মানুষ ঘরছাড়া, ৮তারিখে ভাঙচুর হয়েছে বেশ কিছু বাড়ি। আতঙ্ক এবং সন্ত্রাসের ছাপ এলাকায় স্পষ্ট। এখানে গ্রামের রাস্তার মোড়ে মোড়ে মহিলারা ঝাঁটা বটি হাতে কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে ছিলেন পুরুষরা যুবকরা পাহারা দিচ্ছেন যাতে ফের কোন ছাপ্পা বাহিনী ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে না পারে দেশপ্রাণ ব্লকের বিডিও ভোট দেওয়ার আবেদন জানান গ্রামবাসীদের কিন্তু গ্রামের মানুষ এক কাট্টা অনড় থাকে।

বাঁকুড়া জেলায় ৮টি বুথে পুনর্নির্বাচন হয় মোটামুটি নির্বিঘ্নে।

হুগলি জেলায় ২৯টি বুথের পুনর্নির্বাচনের বেশিরভাগেই ছাপ্পা ভোট চলেছে দেদার।

উত্তর দিনাজপুর জেলার ইটাহার কাপাসিয়া, জয়হাট সহ বেশ কিছু বুথের পুনর নির্বাচন হয় কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে। অনুব্রত মণ্ডল না থাকলেও ‘উন্নয়ন বাহিনী’ বীরভূমের বুথগুলিতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে পাড়ায় পাড়ায়। উদ্দেশ্য, মানুষের মনে ভয় ঢোকানো। প্রার্থীকে দেওয়া হয়েছে খুনের হুমকিও । সেই চোখ রাঙানি উপেক্ষা করি মানুষ দাঁড়িয়েছেন বুথের লাইনে।

পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে চলছে বাইক বাহিনীর দাপট। যে পুলিশ ভোট লুটেরা ধরতে পারে না, তারাই ভোটের লাইন থেকে গ্রেপ্তার করছে ভোটদাতাদের। পশ্চিম মেদিনীপুরেরই মোহনপুরে রয়েছে সেই অভিযোগ।

অন্যান্য জেলাগুলিতে পরিস্থিতি প্রায় একইরকম থেকেছে।