৬০ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৪ জুলাই, ২০২৩ / ২৮ আষাঢ়, ১৪৩০
২০২৩ পঞ্চায়েত ভোট - লড়াইটা মুখোমুখি
ঈশিতা মুখার্জি
ভোটের দিন সন্ত্রাস ও ভোট লুটের প্রতিবাদে বিক্ষোভ টাকিতে।
২০২৩ সালের পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ভোট সমাপন হলো। দেশের মধ্যে সর্বপ্রথম পঞ্চায়েতের নিদর্শন রেখেছিল যে রাজ্য, যে রাজ্যের প্রবাদপ্রতিম মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গ্রামে মানুষের হাতে ক্ষমতা দিয়েছিল, যে বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা ব্যবস্থা দেখে দেশে সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনী আনা হয়, সেই রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন সমাপ্ত হলো। তৃণমূল কংগ্রেস দলের সরকারের শাসনে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন সারা দেশে এমনকী বিশ্বেও নজর কেড়েছিল শাসকদলের নামিয়ে আনা হিংসার জন্য। ২০১৮ সালে মনোনয়ন পর্ব থেকেই শুরু হয়েছিল হিংসা, গ্রামের মানুষ ভোট দিতে পারেননি। বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত গঠন করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস দল। ২০২৩ সালে রাজ্য দেখল বেনজির হিংসার নিদর্শন। মনোনয়ন পর্ব, ভোট পর্ব, গণনা পর্ব জুড়ে চললো বেনজির হিংসা। এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে ৪৭ জন গ্রামবাসীর। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
গ্রামবাংলার ত্রিস্তরীয় নির্বাচনে গ্রাম পঞ্চায়েতে কতজন ভোটদাতা? কী ক্ষমতা থাকে গ্রাম পঞ্চায়েতে নির্বাচিত প্রার্থীদের? শাসকদল এই পঞ্চায়েত কবজা করতে কেন এত মরিয়া? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে সকলের মনে। কী আছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায়? ঘটনার পরম্পরা দেখলে দেখা যায় যে, গ্রামের মানুষ যত মরিয়া ভোট দিতে এবং গুন্ডা বাহিনী প্রতিরোধ করতে, শাসকের গুন্ডাবাহিনী সেভাবেই নেমে পড়েছে মানুষকে আক্রমণ করতে। ২০১৮ সালে বুথে বামপন্থীদের এজেন্টকে বসতে দেয়নি, এবারও তার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু গ্রামের শ্রমজীবী, কৃষিজীবী মানুষ ২০১৮ থেকে ২০২৩ - এই কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় অনেক তথ্য জেনে গেছেন। এই কয়েক বছরের মধ্যে ঘটে যাওয়া কোভিড অতিমারীর সময়ে তাঁরা জেনেছেন যে, বিপদের সময়ে পাশে এগিয়ে আসেন বামপন্থীরা। দেশজোড়া কৃষক আন্দোলনের সময়ে কৃষিজীবী মানুষ জেনেছেন যে, ফসলের দাম পাওয়ার জন্য লড়ছেন বামপন্থীরা। কৃষিজীবীরা জেনেছেন যে, ন্যূনতম মজুরির জন্য, শ্রমিকের অধিকার রক্ষার জন্য শ্রম কোডের বিরুদ্ধে লড়ছেন বামপন্থীরা। গ্রামের পরিযায়ী শ্রমিক যাঁরা ভোটের জন্য গ্রামে ফিরে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে বামপন্থীদের পক্ষে প্রচার সংগঠিত করেছেন, ভোটে দাঁড়িয়েওছেন। গ্রামের মহিলারা আর স্বনির্ভর গোষ্ঠী কাজ পাচ্ছে না, বেসরকারি ক্ষুদ্র ঋণসংস্থা থেকে তাঁদের ঋণ নিতে হচ্ছে এবং টাকা শোধ দিতে না পারার জন্য তাঁদের অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে। ঋণের ভারে জর্জরিত গ্রামীণ পরিবারগুলি এবং বেশির ভাগ ঋণ দেওয়া হয় মহিলাদের নামে। তাই রাজ্য সরকারের প্রকল্প দিয়ে যে সংসার চালানো যাবে না - এই কথা হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন গ্রামের মহিলারা। তাই তাঁরা দাড়িয়ে গেছেন পঞ্চায়েত ভোটে বামপন্থী দলগুলির প্রতীকে। গ্রামীণ গরিব পরিবারগুলি বাঁচার তাগিদে লালঝান্ডার পতাকার তলায় একজোট হয়ে গেছে। এই লালঝান্ডাকে চরম শত্রু মনে করে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি। তাই যেভাবেই হোক এই শক্তিকে প্রতিহত করবার জন্য এই দুই শাসকদল মরিয়া।
রাস্তা অবরোধ দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে।
তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র হাতে শাসন ক্ষমতা। যেহেতু এই দুই দলের পিছনেই রয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ, তাই এই বামপন্থীদের কীভাবে পর্যুদস্ত করবে তা নিয়ে এই দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েতে এই দুই দলকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেখা গেল। তাই পুলিশ প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী সকলের বিরুদ্ধে নিজেদের ভোটদান করার জন্য লড়াই করতে হলো গ্রামবাসীদের। এই লড়াইয়ে শ্রেণিদ্বন্দ্ব নেই? এই লড়াই কি শুধু দুই দলের মধ্যে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা? এ কি শুধু ভোট ঘিরে তাণ্ডব এবং হিংসা? এই লড়াই খুব ক্ষুদ্র পরিসরে গ্রামের গলিতে শুরু হলেও এই লড়াইয়ের ভিত্তি তৈরি হয়েছে দেউচা পাঁচামির খোলা মুখ কয়লা খনি নির্মাণের বিরুদ্ধে, এই লড়াই শুরু হয়েছে আবাস যোজনার দুর্নীতির বিরুদ্ধে, এই লড়াই শুরু হয়েছে গ্রামের স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে। দিনের আলোর মতো শাসকের দুর্নীতি স্পষ্ট; শাসকদলের নেতা মন্ত্রীরা গারদের ওপারে। এপারে দাঁড়িয়ে মানুষ তো তার দশকের বঞ্চনার বদলা নিতে চাইবেই ভোটের মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত তো গ্রামের মানুষকে ভোটের মর্ম বুঝিয়েছিল শুরুর থেকেই। ১৯৭৮ থেকে ২০০৮ যে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছিল তাতে মানুষ দেখেছিল যে, ভোটে অংশগ্রহণ করার ফলাফল কী হয়। বর্তমান ভোটদাতাদের অনেকের তখন জন্ম না হলেও, সেই সময়ের অভিজ্ঞতা স্মরণে না থাকলেও বর্তমান এক দশকের বেশি গ্রামে যে গ্রামবাসীরাই কোণঠাসা তা তো তাঁরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জেনেছেন। তাই ২০২৩ সালের নির্বাচনে স্পষ্টই শ্রেণিভিত্তিক লড়াই। গ্রামের প্রান্তিক মানুষ, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষকে প্রতিহত করতে তাই তৃণমূল কংগ্রেস দলের দলীয় শক্তি সক্ষম নয়। তাই নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করা হলো রাষ্টযন্ত্রকে। এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রণ করে আদানির মতো বৃহৎ শিল্পপতিরা। আদানিদের হাতে যাতে দেউচা পাঁচামি তুলে দেওয়া যেতে পারে, বেসরকারি হাতে, করপোরেটের হাতে যাতে জলা জমি ভরাট করে নির্মাণ করা যেতে পারে, জঙ্গল কেটে সাফ করে যাতে নির্মাণ করা যেতে পারে অর্থাৎ পঞ্চায়েতে সিদ্ধান্ত যেন নিতে পারে একমাত্র কেন্দ্রীয়ভাবে শুধুমাত্র শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। গ্রাম পঞ্চায়েতেও যাতে কোনভাবেই অন্য দলের কোনো প্রতিনিধি না থাকে, এরকম ব্যবস্থা আনতেই হবে - এটাই শাসকের কথা। গ্রামে যত সম্পদ আছে - সম্পদের অর্থ প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষি সম্পদ সব লুঠ করতে হবে। এই লুঠের ভাগ বাঁটওয়ারা হবে; পঞ্চায়েত চাই বিরোধীশূন্য। স্পষ্টতই শ্রেণির লড়াই। মেহনতি মানুষ আজ দুর্নীতির আকর, করপোরেট পোষিত শ্রেণিশত্রুর সঙ্গে মুখোমুখি সঙ্ঘর্ষে।
কী এমন আছে এই গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতির আসনে? কী এমন ঘটবে আগামী দিনে এই পঞ্চায়েতে, যে ক্ষমতায় না থাকলে অসুবিধায় পড়বে শাসকদল বা কোনোভাবে বামপন্থীরা ক্ষমতায় কোথাও এসে গেলে অসুবিধায় পড়বে শাসকদল? অতীতের লুঠ চোখের সামনে আসবে তো বটেই এমনটি হলে। জাতীয় সমস্ত জনকল্যাণকর প্রকল্প এমনকী বিশ্ব ব্যাংক সহ সব আন্তর্জাতিক প্রকল্প এখন সরাসরি চলে আসে গ্রামের পঞ্চায়েতে। সুতরাং প্রকল্প রূপায়ণের কাজ হয় সরাসরি; তাই প্রকল্প ঘিরে আর্থিক দুর্নীতির সুযোগ এখানে বেশি। বেসরকারি এবং করপোরেটকে জায়গা ছেড়ে দিলে শাসকদলের আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে তারা মাথা ঘামাবে না। তৃণমূল কংগ্রেস দলের সঙ্গে থাকার অর্থ এই দুর্নীতির, লুঠের ভাগ পাওয়া। এই লুঠের জন্য গ্রামের পর গ্রাম তারা বোমা বারুদের স্তূপে ঢেকে দিয়েছে। প্রচুর পরিমাণ বোমা, অস্ত্র মজুত করে গেছে এবং গ্রামের মধ্যেই লুম্পেন বাহিনী তৈরি করেছে।
বামপন্থীদের আটকানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে বিজেপি দলও। তাই বামপন্থী দলের ভোট বাড়লেও গণমাধ্যম, যার বেশির ভাগ মালিক বিজেপি’র সান্নিধ্যে আছে, দেখাবে না বা বলবে না যে, এই হিংসার পরেও বামপন্থীদের ভোট বাড়ছে। বিজেপি দলকে দ্বিতীয় স্থানে রাখার জন্য মরিয়া মিডিয়াকুল। শয়ে শয়ে জয়ী বামপন্থী প্রার্থীকে জয়ের সার্টিফিকেট না দিয়ে হেরে যাওয়া তৃণমূল কংগ্রেসকে জেতার সার্টিফিকেট দেওয়া হলো। গণনা কেন্দ্র সম্পূর্ণ এলোমেলো করে দেওয়া হলো। জেতা প্রার্থীদের আক্রমণ করে হাসপাতালে পাঠানো হলো। এর মারাত্মক নিদর্শন হলো ভাঙড়, যেখানে জিতে যাওয়া প্রার্থী সহ সমর্থকেরা গুলিবিদ্ধ হলেন, প্রাণ চলে গেল। এতদূর যেতে হলো কেন তৃণমূল কংগ্রেসকে? এভাবেই অতি দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী আক্রমণ নেমে আসে মানুষের উপর - এ অভিজ্ঞতা ইতিহাসে আছে। তার ছায়াই কি আমরা দেখতে পেলাম এই নির্বাচনে? কেন পুলিশ-প্রশাসন, মিডিয়া, তৃণমূল কংগ্রেস আজ ঐক্যবদ্ধভাবে গ্রামের মানুষের বিরুদ্ধে? গ্রামের সব হারানো মানুষ যে একজোট হচ্ছে। গ্রামের প্রান্তিক পরিবারগুলি যে তাঁদের হকের পাওনার লড়াই শুরু করে দিয়েছে। একবার তারা একজোট হলে তো শাসকের সর্বনাশের দিন ঘনিয়ে আসে। এ কথা শাসক জানে আর তাই শাসক মরিয়া। প্রান্তিক মানুষ একজোট হচ্ছে, সম্পদ, দুর্নীতির ভাগ হাতছাড়া হচ্ছে - তাই তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি বামপন্থীদের একমাত্র শত্রু মনে করছে।
গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধের যে ভাষ্য তৈরি হচ্ছে, যে আগুন জ্বলে উঠেছে, তা আগামীদিনে দাউ দাউ করে জ্বলবে। হকের পাওনার লড়াই সবহারা মানুষের মতো কেউ লড়তে পারে না। ২০২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচন এক লম্বা মিছিলের ডাক দিয়েছে আসলে। গ্রামের সবহারা মানুষজন তাঁদের জীবন দিয়ে জীবনকে বাজি রেখে তাঁদের প্রাণের বিনিময়ে সেই দিন বদলের মিছিলের পুরোভাগে থেকে রাজ্যবাসীকে ডাক দিচ্ছে। এই মিছিল আরও লম্বা হবে। আসলে এই নির্বাচন শাসকের অত্যাচার, নির্যাতনকে উলঙ্গ করে প্রকাশ্যে এনেছে। শাসকের বিরুদ্ধ ভাষ্য তৈরি হওয়ার পথ প্রশস্ত হচ্ছে।