৬০ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৪ জুলাই, ২০২৩ / ২৮ আষাঢ়, ১৪৩০
রাজনীতির জগতে নীতিহীনতা ও স্বেচ্ছাচারের নিদর্শন তৈরি করে চলেছে বিজেপি
অর্ণব ভট্টাচার্য
বিজেপি’তে যোগ দেওয়ার পর দেবেন্দ্র ফড়নবিশের সাথে প্রফুল প্যাটেল ও অজিত পাওয়ার।
ভারতীয় রাজনীতিকে চরম নীতিহীনতা ও একাধিপত্যের পাঁকে ডুবিয়ে দিচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টি। কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই দল নানারকম কূটকৌশল অবলম্বন করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিতে ভাঙন ধরিয়ে চলেছে। বিজেপি’র ওয়াশিং মেশিনে অন্য দলের নেতাদের ‘শুদ্ধিকরণের’ কাজ চলছে। সম্প্রতি মহারাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি বা এনসিপি-তে যে ভাঙন ধরল তা বিজেপি’র এই নিকৃষ্ট রাজনৈতিক রণকৌশলকে আরেকবার দেশের মানুষের কাছে উন্মোচিত করেছে। এই এনসিপি-কেই কিছুদিন আগে বিজেপি ‘‘ন্যাচারালি করাপ্ট পার্টি’’ বলেছিল। এই দলেরই অন্যতম শীর্ষ নেতা অজিত পাওয়ারের বিরুদ্ধে কয়েক সপ্তাহ আগেই তোপ দেগেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। মহারাষ্ট্রের একটি সেচ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে সরব হন নরেন্দ্র মোদি। অজিত পাওয়ারের সম্পর্কে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করবার জন্য এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি সক্রিয় হচ্ছে বলে জানা যায়। সেই অজিত পাওয়ার যাকে বিজেপি এতকাল দুর্নীতিগ্রস্ত বলে এসেছে তাকেই এখন মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী পদে বসানো হয়েছে। অজিত পাওয়ার দুর্নীতিগ্রস্ত কীনা তা তদন্ত সাপেক্ষ। কিন্তু বিজেপি যে চরম নীতিহীন এবং দ্বিচারিতায় পরিপূর্ণ সেটা বুঝতে গেলে কোনো তদন্ত লাগে না, সাদা চোখেই তা স্পষ্ট। অন্যদিকে অজিত পাওয়ারের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি এতকাল বিজেপি’র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন, তিনি হঠাৎ করে উপলব্ধি করে ফেললেন যে, নরেন্দ্র মোদি সেই ব্যক্তি যিনি ভারতের নেতৃত্ব দিতে পারেন! এখন আর বিজেপি’র ধর্মান্ধতা ও ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে তার কোনো বক্তব্য নেই। এই চরম সুবিধাবাদ, ক্ষমতার লোভ ও ভোলবদল রাজনৈতিক দলগুলি সম্পর্কে মানুষের আস্থা আরও শিথিল করছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করছে এবং চরম মতাদর্শগত অবক্ষয়কে উৎসাহিত করছে।
গত বছর মহারাষ্ট্রে বিজেপি বিরোধী জোট সরকারের পতন এইভাবেই ঘটানো হয়েছিল। দলবদল করা একনাথ শিন্ডেকে মুখ্যমন্ত্রী করে উপমুখ্যমন্ত্রী পদে বসানো হয় বিজেপি নেতা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশকে যিনি প্রকাশ্যেই বলেছিলেন যে, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি এই রাজনৈতিক কূটকৌশল অবলম্বন করেছেন। এই নির্লজ্জ ঘোষণা কি প্রমাণ করে দেয় না যে বিজেপি কোনো নীতি নৈতিকতার ধার ধারে না? এখন একনাথ শিন্ডেকে মাঝে রেখে, আর একপাশে অজিত পাওয়ারকে দ্বিতীয় উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেবেন্দ্র ফড়নবিশ বাগাড়ম্বর করে বলেছেন যে, মহারাষ্ট্রকে তিনজন একত্রে পরিচালনা করবেন। এটাই নাকি সেই রাজ্যে উন্নয়নের ‘ত্রিশূল’! আসলে ত্রিশূল নয়, এ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাশুল যা মানুষকে দিতে হচ্ছে। এই ত্রিশূল আসলে হত্যা করছে গণতন্ত্রকে। রাজ্য ও কেন্দ্রে একই দলের ডবল ইঞ্জিন সরকার প্রতিষ্ঠা করবার স্লোগান দিয়ে গণতন্ত্রের মর্মবস্তু যে বহুত্ববাদ তাকে এভাবে পরিহাস ও অস্বীকার করছে বিজেপি। এর আগে মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস দলের তৎকালীন নেতা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে নিজেদের দলে টেনে, কেন্দ্রের মন্ত্রিত্ব দিয়ে সরকার ভেঙেছিল বিজেপি। কর্ণাটকে, গোয়াতেও তারা একই কাজ করেছিল। অর্থাৎ জনগণ নির্বাচনে নিজেদের রাজনৈতিক পছন্দের বহিঃপ্রকাশ যেভাবেই করুক না কেন তাকে ছলেবলে বদলে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা ভোগ নিশ্চিত করার জন্য বেপরোয়া বিজেপি।
আসলে ভারতের বুকে তাদের সাম্প্রদায়িক অ্যাজেন্ডাকে বলবৎ করার জন্য বিজেপি’র একচেটিয়া রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করা জরুরি হয়ে পড়েছে। গোটা দেশে যেভাবে অর্থনৈতিক সংকট বিশেষত বেকারি এবং মূল্যবৃদ্ধি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপি দলের পক্ষে জনসমর্থন আদায় করা কঠিন হয়ে উঠছে। এমতাবস্থায় যেখানেই সুযোগ আছে সেখানেই রাজনৈতিকভাবে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে, প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে জনমনে প্রভাব খাটাতে চাইছে সাম্প্রদায়িক শক্তি। আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে এগোচ্ছে বিজেপি, আর সেই কাজ সফলভাবে করার জন্য বিভিন্ন দলকে বিশেষত আঞ্চলিক দলগুলিকে দুর্বল করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার চেষ্টায় তারা প্রবলভাবে লিপ্ত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন যে, দল ভাঙানোর রাজনীতির ফলে যারা নতুনভাবে ক্ষমতার আস্বাদ পাচ্ছেন তারা আর সরকারের নীতি এবং জনকল্যাণ নিয়ে কোনো মাথাই ঘামাচ্ছেন না, বরং বিজেপি’র কাছে আরও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করে ক্ষমতার ফল ভোগ করার জন্য নির্বিচারে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিকে প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে জনগণ, কেননা সুশাসনের অ্যাজেন্ডা এক্ষেত্রে আরও অর্থহীন হয়ে যাবে। লক্ষ করা দরকার যে, মহারাষ্ট্রে একনাথ শিন্ডের সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ও ঘৃণা পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। পেছনে চলে যাচ্ছে রুটি-রুজির প্রশ্ন। দল ভাঙানোর এই রাজনীতি যত সফল হবে ততো সমাজে বিভাজন তীব্রতর হবে এবং বিজেপি’র রাজনৈতিক আধিপত্য করপোরেট শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হবে। তাই পাটনার বৈঠকে বিজেপি বিরোধী দলগুলির মধ্যে যে প্রাথমিক বোঝাপড়া হয়েছে তাকে আগামীদিনে আরও বলিষ্ঠ করে তুলতে হবে এবং সুবিধাবাদীদের চিহ্নিত করে বিরোধী শিবিরে অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনাকে অবলুপ্ত করতে হবে।
গত ন’বছর ধরে সুশাসন এবং দুর্নীতিমুক্ত ভারত তৈরি করার কথা বলে চলেছেন নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার। কিন্তু এই সময়কালে আমাদের দেশে সামাজিক অস্থিরতা আরও বেড়েছে এবং দুর্নীতি আরও বেশি প্রাতিষ্ঠানিক আকার পেয়েছে। দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এবং দলিতদের উপর নির্যাতন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সংবেদনশীলতার যে চরম অভাব গত দু’মাসে মণিপুরের চলমান হিংসা ও নৈরাজ্যের ঘটনায় দেখা গিয়েছে তা অনেকেই কল্পনা করতে পারেননি। এখনো মণিপুর নিয়ে কোনো কথা বলেন নি প্রধানমন্ত্রী। এখনো সে রাজ্যে মানুষ খুন হচ্ছেন, ঘরছাড়া হচ্ছেন। উল্টে কেন্দ্র ও রাজ্যের বিজেপি সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে যারা আওয়াজ তুলছেন তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির এই গণতন্ত্র বিরোধী স্বৈরাচারী চরিত্র আমজনতার কাছে ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে।
বিজেপি দল এবং তাদের রাজনৈতিক অভিভাবক আরএসএস গোটা দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে উদগ্রীব। আর সেই কাজ করতে গিয়ে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপরে লাগাতার আক্রমণ সংঘটিত করা হচ্ছে। সম্প্রতি দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকার The Government of National Capital Territory of Delhi (Amendment) Ordinance নামে যে অর্ডিন্যান্স জারি করেছে তার ফলে সেই রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যাপকভাবে খর্ব হতে চলেছে। এদিকে সুপ্রিম কোর্ট ১১ মে রায় দিয়ে বলেছিল যে, দিল্লিতে নির্বাচিত সরকারের আওতাধীন এলাকায় জনগণের জন্য আইন প্রণয়ন এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্ণ অধিকার আছে। অতীতে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকার যে সমস্ত অধিকার প্রয়োগ করত তা এখন প্রয়োগ করার প্রচেষ্টা সংবিধান সম্মত নয়। যেহেতু আপ দলের সাথে বিজেপি’র রাজনৈতিক স্বার্থ সংক্রান্ত সংঘাত ঘটছে তাই নিজেদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে নস্যাৎ করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে মোদি সরকার। রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের বদলে কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করার এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেছে দিল্লির রাজ্য সরকার। আগামী ১৭ জুলাই তার শুনানি হবে।
ইতিমধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গিয়েছে দেশের রাজধানীতে। দেশের মানুষ সাক্ষী যে দেশের মহিলা কুস্তিগীরদের ওপর জাতীয় কুস্তি ফেডারেশনের শীর্ষকর্তা তথা বিজেপি এমপি ব্রিজ ভূষণ দীর্ঘকাল ধরে যৌন নির্যাতন চালানোর প্রতিবাদে বিগত কয়েক মাস যাবত যে বিক্ষোভ আন্দোলন চলছিল তাকে নানাভাবে দমন করা ও কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। অনেক বাধা পেরিয়ে দিল্লি পুলিশকে যে এফআইআর নিতে বাধ্য করা হয়েছিল অবশেষে তার ভিত্তিতে যে চার্জশিট তৈরি করেছে দিল্লি পুলিশ তাতে ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে আইপিসি ৫০৬, ৩৫৪, ৩৫৪ এ এবং ৩৫৪ ডি ধারায় যৌন হেনস্তা, নির্যাতন, ভীতি প্রদর্শন এবং পিছু নেওয়ার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এতকাল বিজেপি নেতৃত্ব ব্রিজ ভূষণ সিং-কে নানাভাবে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন এবং গত ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারি কমিটির সামনে মহিলা কুস্তিগীররা এই সমস্ত অভিযোগ করলেও সেগুলিকে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। শেষপর্যন্ত তীব্র বিক্ষোভ ও প্রতিরোধের সামনে নতি স্বীকার করে দিল্লি পুলিশ চার্জশিট দিয়েছে। দেখতে হবে এই জঘন্য অপরাধীরা যেন রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে সাজা এড়িয়ে যেতে না পারে।
সব মিলিয়ে বিজেপি’র যে কলঙ্কিত চেহারা দেশবাসীর সামনে ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে তাতে এই দল সম্পর্কে মোহভঙ্গ ঘটার মতো অনুকূল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে এই সময়ে কার্যকরী রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করতে হবে।