৬০ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৪ জুলাই, ২০২৩ / ২৮ আষাঢ়, ১৪৩০
সে-দিন কী হবে ভাবুন...
সুদিন চট্টোপাধ্যায়
গণতন্ত্রের শরীর বোমা বারুদ, ছুরি ও ছাপ্পা ভোটে ছেঁড়াখোঁড়া কাগজের টুকরোর মতো গ্রাম বাংলার রাস্তার ধুলোয় উড়ে বেড়াচ্ছে। মৃত মানুষের আত্মজনেরা শোকে পাথর, হাহাকারে গড়াগড়ি দিচ্ছেন বাড়ির উঠোনে, গ্রামের মন্দিরে সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বলেনি, কাঁসর ঘণ্টা শব্দহীন, মসজিদের আজানে আওয়াজ নেই। ভোটের বাক্স দিঘির জলে, ভোটপত্রের হরির লুট, পাইক-পেয়াদা আর ভোট-বাবুরা হাসপাতালের শয্যায় যন্ত্রণা ও কান্নায় কাতরাচ্ছে, রক্ত এবং ক্ষতে ছিন্নভিন্ন শবের পাহাড় লাশ চেরাই ঘরে আর প্রভুর হুকুম তামিলে কৃতকার্য এক বিক্রি হয়ে যাওয়া ভোট বাহাদুর কলকাতার অফিসের নিরাপদ তকতে বসে নির্লজ্জ হাসিতে ঝুলন্ত গোঁফের ডগা ভিজিয়ে ঘোষণা করলেন, দুটো একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া পশ্চিমবাংলার ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে কোনো অশান্তির খবর নেই।
গতকালের নির্বাচন সারা দেশে ও বিশ্বের চোখের সামনে প্রমাণ করেই ছাড়ল যে পশ্চিমবঙ্গে অবাধ দুর্বৃত্ততন্ত্র চলছে। ফেলে আসা গত একটি মাসে দুচোখ মেলে হতভাগা রাজ্যবাসী দেখেছে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার লুটে নেওয়ার জন্যে আদালতে দৌড়দৌড়ি করছে রাজ্য সরকার আর মহামান্য আদালত সাংবিধানিক রক্ষাকবচের আওতায় সাধারণ মানুষের অধিকার বাঁচাতে একটির পর একটি আদেশ জারি করে চলেছেন। খবরের কাগজে পড়লাম রাজ্যে আদালততন্ত্র জারি। কিন্তু পরম পরিতাপের সঙ্গে গতকাল সারাদিন দূরদর্শনের পর্দায় দেখলাম সব চেষ্টা ও সদিচ্ছা নিষ্ফল এবং নিরর্থক করে দিয়ে স্বেচ্ছাতন্ত্রের দয়াহীন কামড়ে রক্তাক্ত গণতন্ত্রের নিথর নিস্পন্দ, সাদা কাপড়ে ঢাকা শবদেহ শেষশয্যায় শায়িত।
।। দুই ।।
একমাস ধরে গ্রামীণ মানুষের ন্যায়সঙ্গত সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার স্বার্থে কলকাতা হাইকোর্টের অনলস প্রয়াস দেখে সম্ভ্রমে মাথা নত করেছি, অন্যদিকে একটি রাজনৈতিক দলের কোচবিহার থেকে ক্যানিং পর্যন্ত ‘নবজোয়ার' কর্মসূচিতে আসন্ন এগারোই জুলাই জয়োল্লাস করার আগাম ধ্বনির অসংযত ঔদ্ধত্যে মাঠঘাট কাঁপানো সন্ত্রাসে আতঙ্কিত হয়েছি। আজ এই নির্বাচনোত্তর সন্ধ্যায় সেই ঘোষিত ‘সম্ভাব্য বিজয়োল্লাসের’ নির্মম মুখচ্ছবি দেখে ভাবছি - এ বাংলা কী আমার বাংলা? এই বাংলার স্বপ্ন দেখে কী আমার পিতৃদেব ব্রিটিশ কারাগারে বন্দিত্ব বরণ করেছিলেন? কবি লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা’? গানের সুরে সুরে আকাশ ভরেছিল ‘সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’। আর বাংলার যৌবন মুখর হয়েছিল ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি'র আবেগভরা উচ্চারণে?
এই বাংলা আমার অপরিচিত। আমি যে বাংলার যৌবনকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের, লুমুম্বা হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পথ তোলপাড় করতে দেখেছি, গণগায়ক পিট সিগারের গান শোনার ব্যাকুল প্রতীক্ষায় অধৈর্য প্রহর গুনতে দেখেছি, উৎপলের ‘কল্লোল’ দেখার জন্যে মিনার্ভা থিয়েটারের দরজায় উৎক্ষিপ্ত ইটের ঘা মাথায় নিয়েও হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখেছি, যাদের ক্রুদ্ধ গর্জনে যুদ্ধবাজ ম্যাকনামারা দমদম বিমানবন্দর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল, যাদের ভালো ছায়াছবি দেখার আবেগ বিহ্বলতায় কলকাতার নন্দন চত্বর, ভালো কবিতা শোনার আহ্বানে বাংলা আকাডেমি ভবন গমগম করে, বাংলার সেই যৌবন কোথায় হারিয়ে গেল?
এরা কারা, মাথায় ফেট্টি বেঁধে ছুটন্ত বাইক থেকে বোমা বারুদে মৃত্যু ছড়িয়ে ছড়িয়ে গ্রামে গ্রামে জয়ের বার্তা ঘোষণা করে যাচ্ছে? ৩১টি জীবনের অকারণ অপচয়ের মূল্যে এ কী ভয়ঙ্কর গণতন্ত্রের উৎসব? শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের নামে বাংলা জহ্লাদের বধ্যভূমি হয়ে দাঁড়াল।
চারিদিকের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যে ক্রমাগত আগুনে ঘি ঢেলে চলেছেন বাংলার রাজ্যপাল। তিনি তাঁর পদের মর্যাদাকে রাস্তার ধুলোয় এনে নামিয়েছেন। রাজ্যপালেরা চিরকালই কেন্দ্রীয় সরকারের বশংবদ, আজ্ঞাবহ। কিন্তু শ্রী ধনখড় এবং তাঁর উত্তরাধিকারী শ্রীযুক্ত বোস বোধহয় তার চেয়েও বেশি কিছু। দলীয় রাজনীতির যে নোংরা, নগ্ন খেলা এঁরা খেলে চলেছেন তা শুধু অভাবনীয়ই নয়, অদৃষ্টপূর্বও। তাঁর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা তিনি জানেন, তবুও তিনি চমক তৈরির লালসায় পথে পথে হুঙ্কার ও মিথ্যা আশ্বাসের বন্যায় ভাসিয়ে চলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগে তিনি নিজেই তুঘলকি কাণ্ডকারখানা চালিয়ে দূষিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রাজ্যের শিক্ষা পরিবেশকে নষ্ট করেছেন। এ রাজ্য কী এমন বন্ধ্যা, সারস্বত শস্যহীন হয়ে পড়েছে যে হাতের কাছে যখন যাকে পাচ্ছেন, সরকার বা রাজ্যপাল তাঁকেই উপাচার্যের আসনে বসিয়ে দিচ্ছেন?
।। তিন ।।
গত ৮ জুলাই ১৮২২, ছিল ইংরেজ কবি শেলির প্রয়াণবার্ষিকী। তাঁর বিশ্বাস ছিল একমাত্র কবিরাই পারেন ন্যায়হীন, নির্যাতনে ত্রস্ত মানবসমাজকে পথ দেখাতে। কবিরাই মানবজাতির পতাকাবিহীন বিধায়ক। ‘কবি’ বলতে খালি কবিকে বোঝাননি, লেখক সাহিত্যিক, সারস্বত, গোটা সুশীল সমাজকে ইঙ্গিত করেছিলেন।
ম্যানচেস্টার-এর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় নিজে লিখেছেন ক্ষুরধার কবিতা ‘The Mask of Anarchy’। অনুপ্রাণিত করেছিলেন আক্রান্ত ও নিপীড়িত মানুষকে। হাতের শৃঙ্খল ছুঁড়ে ফেলতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, তোমরা জাগলে, ওরা পালাবে। তোমাদের সংখ্যা অনেক, ওরা তো হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র।
‘‘Shake your chains to earth like dew
You are many, they are few...’’
আজ এমন কথা বলবার মতো কোনো কবি বাংলায় নেই। উদ্ধত ব্রিটিশ সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেনঃ
‘‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে,
মোদের ততই বাঁধন টুটবে।
ওদের যতই আঁখি রক্ত হবে মোদের আঁখি ফুটবে,
ততই মোদের আঁখি ফুটবে।।’’
নজরুল গলার উত্তরীয় আকাশে উড়িয়ে দিয়ে গর্জন করেছিলেনঃ
‘‘কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট
রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী...’’
কবি সুকান্ত অপশাসনের ‘জঞ্জাল’ সরিয়ে সুস্থ সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিলেনঃ
‘‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’’
আজ এঁরা কেউ নেই। হাতে গোনা দু'চারজন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সারস্বত ছাড়া, অধিকাংশই, রম্যাঁ রল্যাঁর কথায়, ‘‘পদক ও পদবি’র পদতলে বিক্রিত, বিনত এবং বিসর্জিত।’’ নোয়াম চমস্কি’র ব্যখ্যায়, ‘‘একালের বুদ্ধিজীবীরা অধিকাংশই বসন্তের কোকিল, ঝড় ঝঞ্ঝা ও তুষারপাতে পলাতক পিপীলিকার দল’’।
।। চার ।।
জীবনের শেষ নববর্ষে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘সভ্যতার সংকট’... বললেন, ‘‘ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারতসাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু কোন্ ভারতবর্ষকে সে পিছনে ত্যাগ করে যাবে? কী লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনাকে। (এদের) শাসনধারা যখন শুষ্ক হয়ে যাবে, তখন এ কী বিস্তীর্ণ পঙ্কশয্যা দুর্বিষহ নিষ্ফলতাকে বহন করতে থাকবে।... পিছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ!’’ - এই কথাটিই আমার মনের তন্ত্রীতে আজ বেজে চলেছে, ভাগ্যচক্রে নয়, গণতন্ত্র ও ইতিহাসের নিয়মেই একদিন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকারকে অনিবার্যভাবে বাংলা ছাড়তেই হবে, সেদিন কোন হাহাকারের, হতদরিদ্র, নিঃস্ব ও নিষ্ফল বাংলাকে তারা পেছনে ফেলে যাবে? গ্রিসের সভ্যতা, রোমের সাম্রাজ্য টেঁকেনি, ইংল্যান্ডের প্রবল প্রতাপান্বিত টিউডর-স্টুয়ার্টরা, ভারতের ক্ষমতাশীল মুঘলরাও ইতিহাসের চাকার তলায় গুঁড়িয়ে গেছে, তৃণমূল তো কোন ছাড়?
জঘন্য জিঘাংসায় লিপ্ত, বলদর্পী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সেদিন রবীন্দ্রনাথ সতর্ক ও সাবধান করে গিয়েছিলেন যে ভাষায়, পশ্চিমবাংলার বর্তমান সরকারকেও সেই ভাষা শুনিয়ে দেওয়া দরকারঃ
‘‘এই কথা আজ বলে যাব, প্রবলপ্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে... অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে।’’ সেদিন কী হবে ভাবুন...।