E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৪ জুলাই, ২০২৩ / ২৮ আষাঢ়, ১৪৩০

পরিবেশ আলোচনা

টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের দেশ এবং রাজ্যঃ পরিবেশের কিছু প্রসঙ্গ

তপন মিশ্র


দেশের ২৮টা রাজ্যের মধ্যে জাতিসঙ্ঘ নির্ধারিত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য (Sustainable Development Goal) বা এসডিজি’র মাপকাঠিতে আমাদের রাজ্য দেশের মধ্যে ১১ তম স্থানে। আমাদের দেশও এই মাপকাঠিতে পেছনের দিকে। গত বছরের তুলনায় আমাদের দেশ ৯টি স্থান পিছিয়ে বিশ্বের মধ্যে ১২১তম স্থানে। আমাদের রাজ্য এবং দেশ উভয়ই পেছনের দিকে দ্রুত এগোচ্ছে। এই খবর দিচ্ছে দিল্লির Centre for Science and Environment-এর ২০২৩ সালে প্রকাশিত State of India’s Environment Report-2023। পরিতাপের বিষয় যে, এই মাপকাঠিতে আমাদের পাশের ৪টি দেশ যেমন বাংলেদেশ, ভুটান, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কা থেকে আমরা পেছনে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য কী কী?

২০১৫ সালে জাতিসংঘের জেনেরেল কাউন্সিল পৃথিবীর মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নের জন্য ১৭ টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজি নির্ধারণ করে। আমাদের দেশ এই প্রক্রিয়ার সাক্ষরকারী। এগুলি বিশ্বব্যাপী লক্ষ্য হিসাবেও পরিচিত। আজেন্ডা ২০৩০ নামে গৃহীত সিদ্ধান্তের অংশ হিসাবে ১৭ টি লক্ষ্যের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে ১৬৯টি উপলক্ষ। এগুলিকে উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবেও দেখা যায়। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত ১৯৩টি সদস্য দেশ একত্রিত হয়ে এই লক্ষ্য অর্জন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসঙ্ঘের জেনেরেল অ্যাসেম্বলিতে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর ঠিক হয় যে, ২০১৬ সালে ১ জানুয়ারি থেকে এই প্রক্রিয়া কার্যকর হবে। এই সিদ্ধান্তের মুল স্লোগান ছিলঃ ‘Leave No One Behind’ - অর্থাৎ কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে।

আমাদের দেশের সরকার ঠিক করে যে, দেশের নীতি (National Institution for Transforming India) আয়োগ, যা দেশের মুখ্য থিংক ট্যাঙ্ক হিসাবে পরিচিত, এই বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। এই লক্ষ্যগুলির মধ্যে রয়েছে - দারিদ্র্য দূরীকরণ, ক্ষুধার অবসান, সকলের জন্য সুস্বাস্থ্য, সকলের জন্য শিক্ষা, লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান, সকলের জন্য পানীয় জল এবং পরিচ্ছন্নতা, সাশ্রয়ী এবং পরিচ্ছন্ন শক্তির জোগান, সবার জন্য কাজ এবং আর্থিক উন্নয়ন, শিল্প, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং পরিকাঠামো, অর্থনৈতিক বৈষম্যের হ্রাস, টেকসই শহর জীবন, দায়বদ্ধ ব্যবহার এবং উৎপাদন ব্যবস্থা, সুস্থ জলবায়ু উপযোগী কর্মকাণ্ড, জল এবং স্থলভাগের জৈব বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ইত্যাদি।

সবটা একসঙ্গে করলে দাঁড়ায় যে, এই আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থা বজায় রেখে টেকসই উন্নয়নের পরিমাপকগুলি যথাযথ হলেও ২০৩০-এর মধ্যে এই লক্ষ্য অর্জনের ধারণা সোনার পাথরবাটির মতো। অর্থাৎ একটি ভঙ্গুর আর্থ-সামাজিক এবং পরিবেশ বিরোধী ব্যবস্থার মধ্যে টেকসই উন্নয়নের ভাবনা জোর করে চাপিয়ে দিলে যা হবার তাই হয়েছে। এই পরিকল্পনা গ্রহণের পর থেকে ৮ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। হাতে আর মাত্র ৭টি বছর। বিশ্বজুড়ে যেমন টেকসই উন্নয়নের ভাবের ঘরে চুরি হয়েছে ঠিক তেমনই হয়েছে আমাদের দেশে এবং আমাদের রাজ্যে। এসব সত্ত্বেও বলা যায় যে, জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়নের সিদ্ধান্ত হলো সকলের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ অর্জনের ইতিবাচক পরিকল্পনা। আপাতভাবে এই ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে কোনো মানুষই যেন ক্ষুধার্ত না থাকে, শিক্ষা এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয় - এটাই এই পরিকল্পনার লক্ষ্য।

আমাদের দেশ কোথায় দাঁড়িয়ে?

আমাদের দেশ ১৭টি এসডিজি’র মধ্যে ১১টির ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে আমরা পিছিয়ে রয়েছি - এসডিজি ২ (ক্ষুধার অবসান), এসডিজি ৩ (সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতা), এসডিজি ৫ (লিঙ্গসমতা) এবং এসডিজি ১১ (টেকসই শহর পরিকল্পনা) ইত্যাদি। রিপোর্টে বেশ কয়েকটি ভয়ঙ্কর উদাহরণের কথাও বলা হয়েছে। আমাদের দেশে বিগত বছরে ৩০,০০০টি জলাভূমি দখল করে ভরাট করা হয়েছে। প্রতিদিন এদেশের শহরগুলিতে ১৫০,০০০ টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হয় এবং তার আর্ধেকেরও বেশি জমি ভরাট করার জন্য ব্যবহার করা হয়। বাকি কঠিন বর্জ্য এমনি পড়ে থাকে বা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতি পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। নির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে এই বর্জ আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনছে। দেশে সীমাহীন বায়ুদূষণের কারণে প্রায় প্রত্যেকটি নাগরিকের গড় আয়ু ৪ বছর ১১ মাস কমে যাচ্ছে। গ্রাম ভারতে শহরগুলির তুলনায় এই পরিমাণ অনেক বেশি। বর্তমানে যে পরিমাণে গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা অন্যান্য ব্যবস্থা আছে তার আরও ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটাতে না পারলে সুস্থ ভারতের কথা বলা যাবে না। মূলত সরকারি সংস্থা, বিভিন্ন আধা সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উপর পরিবেশ সংক্রান্ত যে মামলা জমা হয়েছে, প্রতিদিন যদি ২০০-এর বেশি মামলার শুনানি হয় তাহলে ১ বছরে বকেয়া মামলা শেষ করা যাবে।

ইতিমধ্যে ২০২৩ সালের দাবদাহ শুরুর মধ্যদিয়ে চরম আবহাওয়ার পরিস্থিতি আমরা অনুভব করছি। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর এই ৩০৪ দিনের মধ্যে দেশের কোথাও না কোথাও মোট ২৭১ দিন চরম আবহাওয়ার অবস্থার তৈরি হয়েছে। এর ফলে ২৯০০ মানুষের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়েছে। এর সুদূরপ্রসারী ফলে প্রভাবিত হয়েছে আরও অনেক মানুষ।

একটু আগের কথা বলি। ২০২১ সালের ৫ জুন জাতিসঙ্ঘ সেবারের এসডিজি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্টের ভারতের অংশটি বিশদভাবে আলোচনা করেন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা গুরিন্দর সিং কাউর। সে বছর এসডিজি ইনডেক্সে আমাদের দেশের স্থান ছিল ১১৭ (এবছর ১২১তম স্থানে)। সেবারেও ২০২০ সালের তুলনায় ৫ পয়েন্ট কমে যায় এবং ফলে দেশের স্থান ১১৫ থেকে ১১৭-তে নামে। সেই বছর ভারত ১০০ পয়েন্টের মধ্যে ৬১.৯ স্কোর করে এবং তার সাত প্রতিবেশী - চীন (৭৩.৯), ভুটান (৬৯.৩), মালদ্বীপ (৬৭.৬), শ্রীলঙ্কা (৬৬.৯), নেপাল (৬৫.৯), মিয়ানমার (৬৪.৬) এবং বাংলাদেশ (৬৩.৫) ভারতের থেকে এগিয়ে ছিল। টেকসই উন্নয়নের মাপকাঠিতে পৃথিবীতে সুইডেনের ছিল সর্বোচ্চ স্কোর (৮৪.৭)। এই প্রতিবেদনে টেকসই উন্নয়নে ভারতের পতনের জন্য দায়ী করা হয়েছে ক্ষুধা নিবারণের ক্ষেত্রে ঘাটতির চ্যালেঞ্জ এবং খাদ্য নিরাপত্তার অভাব। এছাড়াও লিঙ্গ বৈষম্য, পরিকাঠামো নির্মাণ, টেকসই শিল্পায়ন এবং উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে উদ্যোগের অনুপস্থিতি ভারতের স্থান পতনের কয়েকটি কারণ।

এনভায়রনমেন্টাল হেলথ ইন্ডিকেটর হলো আরেকটি মানদণ্ড যা পরিবেশগত সমস্যার কারণে স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষেত্রে ঝুঁকির কথা বলে। এই ইন্ডিকেটর জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি, বায়ু এবং জলদূষণ, স্যানিটেশন, পানীয় জল সরবরাহ, বাস্তুতন্ত্রের পরিষেবা (ecological services), জীববৈচিত্র্য ইত্যাদির সূচকগুলির উপর ভিত্তি করে দেশগুলির র্যাসঙ্কিং তৈরি করেছে।

এ ক্ষেত্রে ১৮১টি দেশের মধ্যে ভারত পরিবেশগত স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ১৪৮তম স্থানে রয়েছে এবং পাকিস্তানের স্থান ১২৭। ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট ২০২০ অনুসারে, ভারতের রাজধানী দিল্লি টানা তিন বছর বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত রাজধানী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে এবং পৃথিবীর ৩০টি সবচেয়ে দূষিত শহরের মধ্যে ২২টি ভারতের। প্রতি বছর বায়ুদূষণের কারণে আমাদের দেশে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। ভারত সরকার টেকসই উন্নয়নের পরিবর্তে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির নামে করপোরেটদের তাঁবেদারি করার পরিকল্পনা অব্যাহত রেখেছে।

কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৬ সালের এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট বা পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের নীতির বেশ কিছু পরিবর্তন করেছে এবং ২০২০ সালে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের একটি খসড়া প্রকাশ করেছে। ২০০৬ সালের এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতিতে এই ধরনের পরিবর্তন করায় দেশের পরিবেশের উপর আরও ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে।

আমাদের রাজ্যের কথা?

পশ্চিমবাংলার অবস্থা তথৈবচ। এসডিজি-৬ (বিশুদ্ধ পানীয় জল এবং পরিচ্ছন্নতা), এসডিজি-৮ (অর্থনৈতিক উন্নয়ন), এসডিজি-১০ (অর্থনৈতিক বৈষম্য), এসডিজি- ১৫ (স্থলভাগের জৈব বৈচিত্র্য বা life on land) ইত্যদি ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ অনেকটাই পিছিয়ে।

২০২১ সালের এসডিজি তথ্য অনুযায়ী ‘স্থলভাগের জৈব বৈচিত্র্য’ বা ‘life on land’-এর ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে এই রাজ্য। এই বিভাগে রাজ্যের অরণ্য এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে স্কোর হলো ৫৩, যখন এক্ষেত্রে জাতীয় গড় হলো ৬৬। ভারতের জাতীয় গড়ও এ ক্ষেত্রে ২০১৯-এর স্কোর ৮৮ থেকে নেমে এসেছে। লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল ৪১, যখন জাতীয় গড় হলো ৪৮। এই সমস্ত স্কোরের হিসেব হয় ১০০-র মধ্যে।

এ বছর কেরল দেশের ২৮টি রাজ্যের এসডিজি’র বিচারে সর্বোৎকৃষ্ট এবং এই বিচারে বিহার সবার নিচে স্থান পেয়েছে। উপরের তথ্যগুলি বলছে যে, আমাদের দেশ সামগ্রিকভাবে লাগাতার পেছনের দিকে যাচ্ছে। পরিবেশ-অর্থনীতিবিদদের কথায় - “বাংলা সহ অধিকাংশ রাজ্য সরকার এসডিজি স্কোরকে গুরুত্ব সহকারে নেয় না এবং সেই অনুযায়ী তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলি সংশোধনও করে না।” এই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যেও উন্নয়নের সমস্ত ধাপে অধিকাংশ মানুষকে, বিশেষকরে সবচেয়ে দুর্বল এবং প্রান্তিক মানুষদের যুক্ত করার মধ্যদিয়ে যে পরিকল্পনা তৈরি করা দরকার সে ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। এই অবস্থায় কেবল অর্থনৈতিক আজেন্ডার উপর নজর দেওয়া যথেষ্ট নয়। বরং এর সাথে পরিবেশ রক্ষার সমস্ত দিকের উপর লক্ষ রাখা জরুরি।