৫৮ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১৪ মে, ২০২১ / ৩০ বৈশাখ, ১৪২৮
কোভিড পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে দেশজুড়ে তছনছ মানুষের জীবন
হাহাকার, আর্তনাদ, মৃত্যু মিছিলেও অদ্ভুত উদাসীন মোদী সরকার
হাসপাতালে শয্যা না জোটায় উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরে পরিজনের কোলেই মৃত্যু করোনা রোগীর।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সরকারের ব্যর্থতায় করোনার প্রকোপে দেশজুড়ে মানুষের অসহায়তা প্রতিদিন বাড়ছে। হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা থেকে টিকার অভাব, সংক্রমণ রোখা থেকে সৎকারের সমস্যা, ওষুধ থেকে অক্সিজেনের কালোবাজারি নিয়ে নাজেহাল মানুষ। হিন্দুত্ববাদীদের ‘পোস্টার বয়’ যোগী আদিত্যনাথের রাজ্য উত্তর প্রদেশ থেকে বিহারে কোভিড সংক্রমণের জেরে গঙ্গা নদীতে ভেসে আসছে একের পর এক লাশ। বিশ্বের অন্যতম সেরা মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট পত্রিকায় দেশের এই স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের অপদার্থতাকে। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প নিয়ে আড়ম্বর এবং তৎপরতা বেড়েই চলেছে। অতিমারীর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর উদাসীনতাকে দেশের মানুষ ধিক্কার জানাচ্ছেন। দেশ জোড়া ভয়াবহ করোনা বিপর্যয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে এবার নীরবতা ভেঙে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। এই প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বেহাল দশা এবং অসংবেদনশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সম্প্রতি চিঠি লেখা হয়েছে দেশের ১২টি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে। প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এবং সিপিআই সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা সহ ১০ জন বিরোধী নেতা। চিঠিতে তাঁরা বলেছেন, সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প নয়, এই মুহূর্তে দেশের প্রয়োজন বিনামূল্যে ভ্যাকসিন। এর পাশাপাশি, মহামারীতে ধসে পড়া অর্থনীতিতে বাড়তে থাকা বেকারি, দারিদ্র্য, অনাহারের পরিস্থিতিতে বিনামূল্যে চাল, ডাল সেই সঙ্গে বেকারদের অ্যাকাউন্টে ৬০০০ টাকা ভাতা দিতে হবে বলে দাবি জানিয়েছেন তারা। ১১ মে লেখা ওই চিঠিতে বিরোধী নেতারা কৃষি আইন প্রত্যাহার সহ পিএম কেয়ার্সের টাকা দিয়ে অক্সিজেন, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার জন্য কেন্দ্রকে পরামর্শ দিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের ১০ মে’র বুলেটিনে প্রকাশ, ৯ মে (২৪ ঘণ্টায়) ৩ লক্ষ ৬৬ হাজার ১৬১ জন আক্রান্ত হয়েছেন দেশজুড়ে। অর্থাৎ, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এই হার আগের চার লক্ষের থেকে বেশ অনেকটাই কমেছে। যদিও বাস্তব চিত্র অন্য কথা বলে। সাদা চোখে কম বলে মনে হলেও, সেই সংখ্যার ভিত্তিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির দৈনিক সংক্রমণের পরিসংখ্যানের তুলনা করলে দেখা যাবে, তা ভারতের একদিনের আক্রান্ত থেকে কম। আন্তর্জাতিক সংস্থা ব্লুমবার্গের পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বজুড়ে একদিনে আক্রান্ত ৬ লক্ষ ৩৮ হাজার ৯২ জন। আর ভারতে আক্রান্ত ৩ লক্ষ ৬৬ হাজার ১৬১ জন। অর্থাৎ বাকি অন্যান্য দেশ মিলিয়ে মোট সংক্রমিত এই এক দিনে ২ লক্ষ ৭১ হাজার ৫৯৮ জন। আবার দেখা যাচ্ছে, ভারতে একদিনে ৩৭৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রসঙ্গত, মে মাসের প্রথম আটদিনে দেশে গড়ে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৭ লক্ষের। ফলে দৈনিক সংক্রমণ কমলেও তা কোনো দিশা দেখাচ্ছে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এর পাশাপাশি অক্সিজেনের সঙ্কটে ধুঁকছে দেশ। হাসপাতাল উপচে পড়ছে। হাসপাতালে বেড না পেয়ে রাস্তায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন বহু আক্রান্ত। টিকার অভাব প্রকট হচ্ছে। মর্গে, শ্মশানেও জায়গা হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের মহামারী বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতে করোনায় আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যায় গরমিল রয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে। এই অভিযোগ আগেও বহুবার উঠেছে। বিভিন্ন রাজ্য সরকার নিজের মতো করে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও কেন্দ্রের পক্ষ থেকে কোনো লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি এখনও। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশবাসীর সমস্ত রকম দায়িত্ব নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশজোড়া লকডাউনের পথে হাঁটা উচিত কেন্দ্রের সরকারের।
এদিকে চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে উত্তর প্রদেশ-বিহার সীমান্তে। ১০ মে বিহার ও উত্তর প্রদেশ সীমানা লাগোয়া গঙ্গা তীরবর্তী বিহারের শহর চৌসার মহাদেব ঘাটে সকালে ঘুম ভেঙে গঙ্গার পারে দেহ জমতে দেখে শিউরে ওঠেন স্থানীয়রা। সোশ্যাল মিডিয়াতেও গঙ্গায় ভেসে ওঠা সারি সারি দেহের সেই ছবি পোস্ট করেন অনেকেই। খবর পেয়ে প্রশাসনিক আধিকারিকরা আসেন ঘটনাস্থলে। চৌসা জেলা প্রশাসনের আধিকারিকরা মহাদেব ঘাটে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘৪০-৪৫টি দেহ ভেসে উঠেছে। একশোর কাছাকাছি দেহ ভেসে এসেছে বলে অনুমান।’’ অন্তত পাঁচ থেকে সাত দিন দেহগুলি জলে রয়েছে। নাহলে এভাবে ফুলে উঠতে পারে না। আমরা দেহগুলির শেষকৃত্য করব। কিন্তু কোথা থেকে এই দেহগুলি ভেসে এলো তার সঠিক তদন্ত হবে।’’ পচে যাওয়া, ফুলে ওঠা সেই দেহগুলি করোনায় মৃতদের বলেই মনে করছে প্রশাসন। স্থানীয় প্রশাসনের বক্তব্য, উত্তর প্রদেশ থেকে দেহগুলি ভেসে এসেছে। এ নিয়ে দুই বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারের মধ্যে বাদানুবাদও চলছে। এর আগেও উত্তর প্রদেশের হামিরপুরে যমুনা নদীতে আংশিক পোড়া বেশ কিছু দেহ ভেসে ওঠে। বিরোধীদের অভিযোগ, বিজেপি সরকার মৃত্যু চেপে দিচ্ছে। দেহ জলে ভাসিয়ে দিয়ে প্রমাণ লোপাট করছে। আবার এলাহাবাদ হাইকোর্টে উত্তর প্রদেশ সরকারের পেশ করা রাজ্য ও জেলা প্রশাসনের করোনায় মৃতের সংখ্যার গরমিল থাকায় আদালত প্রবল সমালোচনা করে আদিত্যনাথের সরকারের ভূমিকার। অন্যদিকে, মহারাষ্ট্রে সংক্রমণ কিছুটা কমলেও অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে গোয়া, সর্বত্রই সরকারি হাসপাতালে রোগীদের আকস্মিক, ধারাবাহিক মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় হচ্ছে রাজ্য প্রশাসন। কর্ণাটকে সংক্রমণ বাড়ছে ভয়াবহভাবে।। অ্যাকটিভ রোগীর বাড়তে থাকা সংখ্যার প্রেক্ষিতে অক্সিজেনের জোগান নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে দিল্লির প্রশাসনের তরজা চলছে। তবে সীমিত ক্ষমতায় কেরালার বামপন্থী সরকার সুচিকিৎসার বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির নজির তৈরি করেছে।
দেশ জোড়া ভয়াবহ করোনা বিপর্যয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহকে এবার নীরবতা ভেঙে কাজ করার কথা বললেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। ১০ মে ফেসবুক পোস্টে তিনি একথা বলেন। তিনি বলেছেন, ‘‘দেশে মহামারীর যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করার সময় হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখন নীরব। আপনারা নীরব ভঙ্গির আশ্রয় নেবেন না। নীরব ভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসুন।’’ দেশের মহামারীজনিত বিপর্যয়ের ভয়াবহতা উল্লেখ করে ইয়েচুরি বলেছেন, ‘‘দেশে পরপর চার দিন ধরে ৪ লক্ষ মানুষ নতুন করে করোনা সংক্রমিত হয়েছেন। সোমবার, ১০ মে দেশে সংক্রমিত হয়েছেন ৩ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ। মোট আক্রান্তের সংখ্যা শুধু দ্বিতীয় মহামারীতে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২৬ লক্ষ। মারা গিয়েছেন ২ লক্ষ ৪৬ হাজার। কেন্দ্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রেই এই তথ্য পাওয়া গিয়েছে।’’ ইয়েচুরি বলেছেন, ‘‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আপনারা ‘নীরব ভঙ্গিতে’ লুকিয়ে আছেন। তা ছেড়ে বেরিয়ে আসুন। আপনাদের এখানে যে ক্রোনোলজি চলছে, তা আপনারা দু’জন বুঝতে পারছেন। আপনাদের ক্রোনোলজি মতো কুসংস্কার ও ঢঙ করে জনগণের অর্থ অপচয় করছেন, বৈজ্ঞানিক পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করছেন। আপনি জনগণের হাসপাতালের জন্য অর্থ খরচ না করে নিজের অহমিকা মেটাতে নিজের জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আপনি মহামারী সম্পর্কে সমস্ত সতর্কতা উপেক্ষা করেছেন । আপনি এই দ্বিতীয় তরঙ্গে সুপারস্প্রেডার ইভেন্ট এবং মেগা নির্বাচন সমাবেশের আয়োজন করার জন্য লোকজনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আপনি অক্সিজেনের সরবরাহ সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আপনি কয়েক সপ্তাহের জন্য গুদামে বিদেশি সাহায্যকে জমা রেখে দিয়েছেন। আপনি যথেষ্ট পরিমাণ ভ্যাকসিনও কিনলেন না। আপনি শুধুমাত্র আপনার নীতিমালা জপে গিয়েছেন। করোনা মোকাবিলায় পরিকল্পনার পরিবর্তে জনসংযোগ, অপপ্রচার এবং বিজ্ঞাপন করেছেন। আপনি আমাদের সবাইকে এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছেন, যেখানে আমরা শুধু বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছি। এর দায় আপনার, অন্য কারও নয়। আপনি লুকিয়ে থাকতে পারেন না। নীরব ভঙ্গিতে থাকতে পারেন না। যেহেতু আপনি আমাদের সংবিধানের শপথের অধীনে কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন, পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আপনি আপনার দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না। অবিলম্বে আপনাকে অবশ্যই যে কাজ করতে হবে তা হলোঃ
• বিশ্বের সমস্ত উৎস থেকে ভ্যাকসিন গ্রহণ করুন।
• ‘বাধ্যতামূলক লাইসেন্সিং’ প্রয়োগ করুন এবং দেশে ভ্যাকসিনের উৎপাদনকে প্রসারিত করুন।
• ভ্যাকসিনের জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ খরচ করুন।
• আপনার মেগালোমানিয়াক অহমিকা ছাড়ুন। সেন্ট্রাল ভিস্তা তৈরি বন্ধ করুন, অক্সিজেন ও ভ্যাকসিন প্রদানের জন্য সেই টাকা খরচ করুন।
• আপনার পিএম কেয়ার্সের টাকা অক্সিজেন ও ওষুধের জন্য খরচ করুন।
• সকল কর্মহীনকে মাসে নগদ সাড়ে ৭ হাজার টাকা দিন।
• কেন্দ্রীয় গুদামে এক কোটি টনের বেশি খাদ্যশস্য পচে যাচ্ছে, তা বিনামূল্যে বিতরণ করুন।
• আমাদের লক্ষ লক্ষ অন্নদাতাদের মহামারীর শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য নয়া খামার আইন সংশোধন করুন। যাতে আপনাদের দুইজন সহ আমাদের সবাইকে খাওয়ানোর জন্য খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারেন, তার ব্যবস্থা করুন।
দেশের সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বেহাল দশা আগে থেকেই। স্বাস্থ্যখাতে কেন্দ্রের বরাদ্দ দিনের পর দিন কমছে। বিশ্ব জুড়ে করোনা প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ার পরও স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ঢেলে সাজানোয় জোর দেয়নি মোদী সরকার। তার পরিণাম এখন সাধারণ মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। প্রতিদিনই বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন মানুষ। সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর লিখিত প্রশ্নের জবাবে জানা গিয়েছিল, দেশে করোনা মহামারী রুখতে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নির্মাণে মোদী সরকার রাজ্যগুলিকে বরাদ্দ করেছে মাথা পিছু মাত্র ৫১ টাকা। চিকিৎসা সরঞ্জামের খরচ ধরলে মাথাপিছু তা ৬০ টাকার বেশি হবে না। যা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ১ শতাংশ। এসব অব্যবস্থার প্রেক্ষিতে ভাইরাসের নতুন মিউট্যান্ট নিয়ে গবেষণার কাজে কেন্দ্রীয় সরকার নির্বিকার থেকেছে, তার ফল ভুগতে হচ্ছে। চলছে অক্সিজেন ও ওষুধ নিয়ে কালোবাজারি। দেশের স্বাস্থ্যখাতেনামমাত্র খরচের দরুন করোনা প্রকোপে দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বেহাল চিত্র প্রতিদিন বেআব্রু হচ্ছে। আর মানুষ প্রতিদিন জীবন দিয়ে মূল্য চোকাচ্ছে সরকারের উদাসীনতার।