৫৮ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১৪ মে, ২০২১ / ৩০ বৈশাখ, ১৪২৮
কেরালায় এলডিএফ’র জয়ের কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক
বিশেষ প্রতিনিধিঃ বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এলডিএফ) এই বিধানসভা নির্বাচনে ২০১৬ সালের তুলনায় শুধু আটটি বেশি আসনেই জয়ী হয়নি ভোটও বেড়েছে দুই শতাংশের মতো। এলডিএফ পেয়েছে ৯৯টি আসন এবং ৪৫.৩ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ) পেয়েছে ৪১টি আসন এবং ৩৯.৪ শতাংশ ভোট। বিজেপি কোনো আসন পায়নি, তাদের প্রাপ্ত ভোট ১২.৪ শতাংশ। ১৯৭৭ সালের পর এই প্রথম কোনো বিদায়ী সরকার কেরালায় পুনর্নির্বাচিত হলো। কেরালা রাজ্য গঠিত হবার পর কোনো বাম নেতৃত্বাধীন সরকার পর পর দু’বার নির্বাচিত হয়নি।
বর্তমান দেশের রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে নানাদিক থেকেই কেরালায় এলডিএফ’র এই জয় তাৎপর্যপূর্ণ। কেরালা রাজ্য গঠন হবার পর প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৫৭ সালে। ওই নির্বাচনে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি জয়ী হয় এবং ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে সরকার গঠন হয়। কেন্দ্রের জওহরলাল নেহরুর সরকার মাত্র ২৯ মাস পর এই সরকারকে খারিজ করে। ১৯৬৭ সালে তৈরি বাম নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকারও তার পুরো মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেনি। ১৯৮০ সালের নির্বাচনের পর গঠিত ই কে নায়ানারের নেতৃত্বাধীন বাম সরকারও ছিল স্বল্পমেয়াদি। ১৯৮৭, ১৯৯৬ এবং ২০০৬ সালের এলডিএফ সরকারগুলি পূর্ণ মেয়াদে কাজ করতে পেরেছিল, কিন্তু পুনর্নির্বাচিত হয়নি। কেরালার বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের এই ধারার পরিবর্তন ঘটিয়ে ২০২১ সালে নয়া-ইতিহাস তৈরি করল এলডিএফ। ২০১৬ সালে এলডিএফ জয়ী হয়ে সরকার গড়ে, মুখ্যমন্ত্রী হন পিনারাই বিজয়ন। সেই সরকারই দ্বিতীয়বারের জন্য জনাদেশ পেয়েছে। এই জনাদেশ গতবারের তুলনায় আরও ব্যাপক, কেননা এলডিএফ’র আসন সংখ্যা ও ভোট উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি কংগ্রেস এবং বিজেপি নিজেদের মধ্যে ভোট চালাচালি না করত তা’হলে এই জয়ের ব্যবধান আরও বড়ো হতো। কমপক্ষে ১০টি আসনে বিজেপি’র ভোট স্থানান্তরণের ফলে ইউপিএ জয় পেয়েছে।
এই নির্বাচনে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো কেরালার উন্নয়নের মডেল। এই মডেল বাম দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিকল্পিত অর্থনীতি দ্বারা পরিচালিত। এই উন্নয়নের মডেলই এলডিএফ সরকার রূপায়ণ করেছে। দেখা গেছে এই নীতি কেরালার ব্যাপক অংশের মানুষের দ্বারা গৃহীত হয়েছে।
কেরালাই হচ্ছে দেশের মধ্যে একমাত্র সরকার যারা যোজনা পরিষদের বিলুপ্তির পরও ‘পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা’ এবং ‘বাৎসরিক পরিকল্পনা’র প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। এই মডেলে সরকার এমন নীতি-কাঠামো তৈরি করেছে যা সামাজিক উন্নয়নে রাজ্যের যে ঐতিহ্য বিশেষকরে, জনশিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, সামাজিক কল্যাণ, সামাজিক ন্যায়ের মতো বিষয়গুলি শক্তিশালী হয়। গত পাঁচ বছরে এলডিএফ সরকার মানবোন্নয়নের এই ক্ষেত্রগুলিকে শক্তিশালী করার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করেছিল তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্জিত হয়েছে। এই সাফল্যকে ভিত্তি করেই পরিকাঠামোয় বিনিয়োগে আরও নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির পরিকল্পনা নেয় সরকার। প্রায় সারা দেশে যখন জনশিক্ষা, জনস্বাস্থ্যের মতো ক্ষেত্রগুলিতে বেসরকারিকরণের স্রোত বহে যাচ্ছে সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই ক্ষেত্রগুলিতে সরকারি বিনিয়োগ নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পরিকাঠামো উন্নয়নের এইসব কাজে অর্থের সমস্যা ছিল। এই সমস্যা কাটাতে সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে সম্পদ সংগ্রহে জোর দেয় এবং তা কেরালা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড বোর্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হয়। এলডিএফ সরকারের উন্নয়ন-নীতির আরেকটি বৈশিষ্ট্যমূলক দিক হচ্ছে, এই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় ও পরিকল্পনায় জনগণের অংশগ্রহণ এবং স্থানীয় স্বশাসিত সংস্থাগুলির ভূমিকা। কুদম্বশ্রী মহিলা গোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের কাজকর্মের মধ্য দিয়ে আয় সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে। সর্বোপরি ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান নেওয়ায় এলডিএফ সরকার সারাদেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
গত পাঁচ বছর কেরালা একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। ২০১৭ সালে সাইক্লোন ওখি, ২০১৮ সালে বন্যা ও ধস এবং ২০১৯ সালে বন্যায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে কেরালা। এর সাথে রয়েছে ২০১৮ সালে নিপা ভাইরাস এবং ২০২০ সাল থেকে শুরু হওয়া কোভিড ১৯ অতিমারী। পিনারাই বিজয়নের নেতৃত্বে এলডিএফ সরকার কৃতিত্বের সাথে এই সব সঙ্কটের মোকাবিলাই শুধু করেনি রাজ্যের জনগণের জীবন-জীবিকা রক্ষায় নজিরবিহীন পদক্ষেপ গ্রহণ করে যা দেশে-বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন সারাদেশে অক্সিজেনের ভয়াবহ সঙ্কট চলছে তখন কেরালায় এক ব্যতিক্রমী ছবি লক্ষ করা যাচ্ছে। সেখানে এখন অক্সিজেন উদ্বৃত্ত এবং তারা প্রতিবেশী রাজ্য কর্নাটক, তামিলনাডুকে তা সরবরাহ করতে পারছে। প্রথম ঢেউ যখন একটু স্তিমিত হয়েছিল তখন এলডিএফ সরকার অতিমারী মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর সাথেই যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তরল অক্সিজেনের উৎপাদন বাড়ানো। যার সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। গতবছর অক্সিজেন উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে বৈঠকে ডেকে অক্সিজেন উৎপাদনের হিসাব নেওয়া হয়। সব হাসপাতালকে অক্সিজেন লিকেজের ব্যাপারে সতর্ক হতে বলা হয়। রাজ্যের বেসরকারি উৎপাদকদের বলা হয়, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের পাশাপাশি ১০ শতাংশ মেডিকেল অক্সিজেন তৈরি করতে হবে। বর্তমানে কেরালায় সরকারি ও বেসরকারি উৎপাদন মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে অক্সিজেন উৎপাদন হচ্ছে ২০৪ টন। আর রাজ্যের চাহিদা ৭৯ টনের মতো।
কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ এবং বিজেপি উভয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে এই নির্বাচনে এলডিএফ জয়ী হয়েছে। এই দুই শক্তিই এলডিএফ সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার মিথ্যা ও ক্ষতিকর প্রচার চালায়। এমনকি সরকারকে বিশেষ করে সিপিআই(এম)-কে হেয় করতে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকেও কাজে লাগিয়েছিল মোদী সরকার। রাজ্যের একশ্রেণির সংবাদমাধ্যমও এই মিথ্যা বামবিরোধী প্রচারে সঙ্গত প্রদান করেছে। বামবিরোধী জোট হিসেবে ১৯৮০ সালে ইউডিএফ’র আত্মপ্রকাশ। কিন্তু বর্তমানে ইউডিএফ রাজনৈতিক দেউলিয়া অবস্থায় পৌঁছেছে। বিজেপি নির্বাচনে বিশাল টাকা ব্যয় করেছে, তাসত্ত্বেও তারা গতবারে জেতা একমাত্র আসনটিকেও ধরে রাখতে পারেনি।
কিছু সংবাদমাধ্যম এই রাজনৈতিক জয়কে খাটো করে এটাকে শুধু পিনারাই বিজয়নের ভূমিকা ও তাঁর ব্যক্তিত্বের জয় বলে বর্ণনা করেছে। তারা বিজয়নকে ‘সর্বোচ্চ নেতা’, ‘শক্তিশালী মানব’ হিসেবে তুলে ধরেছে। এবং এটাকেই এলডিএফ’র জয়ের প্রধান কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছে। তাদের দাবি একজন মানুষই সরকার এবং পার্টির ওপর কর্তৃত্ব করছে।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পিনারাই বিজয়ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব দান থেকে শুরু করে নীতি নির্ধারণ পর্যন্ত সবক্ষেত্রেই একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছেন; জনগণের স্বার্থকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে এবং নীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দক্ষতা প্রদর্শন করে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। এতদ্সত্ত্বেও কেরালার এই বিজয় ব্যক্তি এবং তার সাথে সম্মিলিত প্রচেষ্টারই ফল। সিপিআই (এম) এবং এলডিএফ জোরের সাথেই মনে করে, নবাগত মন্ত্রিসভা পূর্বের মতোই সম্মিলিত কাজ এবং ব্যক্তিগত দায়বোধের ঐতিহ্যকেই অনুসরণ করে চলবে।
একটা বিরুদ্ধ রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে গত পাঁচ বছর এলডিএফ সরকারকে কাজ করতে হয়েছে। সারাদেশেই দক্ষিণপন্থী আক্রমণ বেড়েছে। বামেরা তাদের শক্তিশালী দূর্গ পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় পরাজিত হয়েছে। লোকসভায় বামপন্থীদের শক্তি সর্বনিম্ন হয়েছে। দক্ষিণপন্থী ও বামবিরোধী শক্তি গতবছর এলডিএফ সরকারকে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু এই পরিস্থিতির মধ্যেও এলডিএফ সরকার তার জনমুখী উন্নয়নের কর্মসূচিকে রূপায়ণ করে গেছে।
এলডিএফ সরকারের পুনর্নির্বাচন বর্তমান সময়ে দেশের রাজনীতিতে বামেদের প্রাসঙ্গিকতাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। এই সরকারের নীতিসমূহ দেশে নয়া-উদারনৈতিক হিন্দুত্ববাদী শাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছে। এই নীতিসমূহের মধ্যদিয়েই আগামীদিনে এলডিএফ সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে ও সুন্দর আধুনিক কেরালা গড়ে তুলবে।