৫৮ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১৪ মে, ২০২১ / ৩০ বৈশাখ, ১৪২৮
শিল্পী ঈশাদা স্মরণে
রবীন দত্ত
গত ১১ মে, মঙ্গলবার, ভোর পাঁচটায় আমাদের অত্যন্ত প্রিয় পরিচিত চিত্রশিল্পী ইশা মহম্মদ করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে নিভে গেল রং ও তুলির জগতে এক বিশেষ ব্যক্তিত্বের জীবনদীপ।
১৯৩৩ সালে হুগলি জেলার কোন্নগরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। স্কুলের পাঠ শেষ করে উত্তরপাড়া কলেজ থেকে আইএসসি। কিন্তু কলেজের পরবর্তী শিক্ষা সমাপ্ত না করে কলকাতায় সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে যাওয়ার তাঁর ছিল প্রবল ইচ্ছা। সমস্ত বাধা অতিক্রম করে খুব সহজেই ভরতি হয়ে গেলেন। মহাবিদ্যালয়ের সঙ্গে গড়ে উঠল আত্মার সম্পর্ক, যা অটুট থাকল প্রায় শেষ জীবন পর্যন্ত।
১৯৫৮ সালে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন মহাবিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায়। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন’ পাস।
কিছু সময়ের ব্যবধানে চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়েই অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আস্তে আস্তে নিজেকে প্রমাণ করতে লাগলেন। বিশেষ করে ‘ফিগার ড্রইং’-এর ক্ষেত্রে ইশাদা’র সাবলীল বিচরণে ছাত্রছাত্রীরা আকৃষ্ট হতে থাকল।
তার সঙ্গে চলল নিজের ছবি আঁকার চর্চা। দীর্ঘ সেই পথ। সময়ের সাথে সাথে চাকুরি জীবনে চারুকলা মহাবিদ্যালয়েই অধ্যাপক থেকে হলেন সম্মানীয় অধ্যক্ষ।
সেই সময়ে প্রায় প্রথম থেকেই যুক্ত হলেন ক্যালকাটা পেইন্টারস গ্রুপ-এর সাথে। সঙ্গে রবীন মণ্ডল, বিজন চৌধুরী, ওয়াসিম কাপুর, বিপিন গোস্বামী প্রমুখ শিল্পী বন্ধু সহ আরও অনেকে। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস, দেশের বিভিন্ন শহরে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে চলল সেই সব চিত্র প্রদর্শনী। অচিরেই এলো বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ। ১৯৬৮ সালে পরবর্তী শিক্ষালাভের জন্য ফেডারেশন রিপাবলিক অব জার্মানি, সেখান থেকে লন্ডন, প্যারিসের লু’ভর মিউজিয়াম-এর সাথে সাথে ইয়োরোপের বিভিন্ন শহর ও সেখানকার মিউজিয়াম এবং আর্ট গ্যালারি। নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে ফিরলেন দেশে।
সাথে সাথে ব্যক্তিগত চিত্রপ্রদর্শনী করেছেন ভারতের বিভিন্ন বড়ো বড়ো শহরে। ১৯৬০ সালে দার্জিলিঙে, ১৯৬৭ এবং ‘৬৯ সালে এআইএফএসিএস নয়াদিল্লিতে, কলকাতার আলিয়াঁজ ফ্রাঁসো, লন্ডনের বেডফোর্ড হিল গ্যালারিতে ১৯৮৭ সালে, জেনেসিস আর্ট গ্যালারিতে ১৯৯০ সালে, নয়াদিল্লির ভাদেরাতে ১৯৯২ সালে, ১৯৯৪ সালে জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিতে, কলকাতার চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে, ১৯৯৭ সালে তাজ গ্যালারি মুম্বাইতে। এর মাঝে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে পুরস্কৃত হয়েছেন ১৯৭৩ সালে।
ঈশাদা’র বেশিরভাগ ছবিকেই কিছুটা বাস্তবধর্মী ছবি হিসেবেই দেখতে পেয়েছি আমরা। যদিও অনেক ছবিতেই বাস্তবতার সাথে প্রতীকের ব্যবহারও করেছেন অত্যন্ত কুশলী হাতে। আবার কখনো মানুষের অবয়বকে সরলীকরণ (সিম্প্লিফিকেশন) করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। ছবিতে দেখা গেছে নারী-পুরুষ, জীবজন্তু, প্রকৃতি এবং সমাজের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের বিষয়বস্তুকে। বিশেষ কোনো রীতি অথবা বলা যেতে পারে বিমূর্ততার (অ্যাবস্ট্রাক্ট) আশ্রয় নেননি কখনও।
তিনি ভারত সরকারের বিভিন্ন অফিস, আদালত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মনীষীদের প্রতিকৃতি করে নিজের নামের প্রতি সুবিচার এবং সুনাম অর্জন করেছেন, তা আমরা প্রায় সকলেই জানি।
আমরা গর্বিত বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে গঠিত ‘রাজ্য চারুকলা পর্ষদ’-এর তিনি একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে, পরিচালন কমিটির দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। পর্ষদের ব্যবস্থাপনায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছোটো ছোটো শহরে, গ্রামে-গঞ্জে যুবক-যুবতীদের চিত্রশিক্ষার কর্মশালায় ইশাদা’র স্নেহ ভালোবাসা এবং চিত্রশিল্প প্রশিক্ষণ পেয়ে বহু ছাত্রছাত্রী ধন্য হয়েছে।
এছাড়াও দেখেছি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইশাদা’র গভীর আত্মিক সম্পর্ক। ১৯৮৬ সালে ট্রেন্ডস ইন বেঙ্গল শীর্ষক এক শিল্প প্রদর্শনী সংগঠিত হয়েছিল ইয়োরোপে। সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি শিল্পীদের মধ্যে ইশা মহম্মদ ছিলেন অন্যতম।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বহু বড়ো বড়ো শিল্প প্রদর্শনীর অন্যতম বিচারক হিসেবেও আমন্ত্রিত হয়ে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। ইশাদা ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের আর্ট অ্যাডভাইসরি কমিটির সদস্য। পরবর্তীকালে বিগত বেশ কয়েক বছর এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। সোসাইটির আর্ট গ্যালারির রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ইশাদা’র অবদান, উপদেশ মনে রাখার মতো।
তিনি রেখে গেলেন স্ত্রী, পুত্র-কন্যা আর গুণমুগ্ধ অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী এবং শিল্পরসিকদের।