৫৮ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১৪ মে, ২০২১ / ৩০ বৈশাখ, ১৪২৮
নিছক ‘ভলান্টিয়ার্স’ না, ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’
সৌম্যজিৎ রজক
কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ। ভয়াবহ, মারাত্মক। স্বাধীন ভারতে অভূতপূর্ব স্বাস্থ্যসঙ্কট। মেডিকেল এমারজেন্সি।
রাষ্ট্র পারছে মোকাবিলা করতে? পারছে না। হয় মোকাবিলা করার মুরোদ নেই এত বড়ো রাষ্ট্রের, অথবা করতে চাইছে না।
সেন্ট্রাল ভিস্তা নির্মাণে ২০,০০০ কোটি টাকা খরচ করার মুরোদ আছে। সব মানুষকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার নেই। বিরোধী রাজনৈতিক মতামত দাবিয়ে দেওয়ার জন্য মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আছে। বেলাগাম বিল যাতে হাঁকতে না পারে তারজন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার অওকাত নেই।
জনস্বাস্থ্যের দায়দায়িত্ব কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেছে আমাদের রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্র পরিচালনার দায় যাদের, তারা ভ্যাকসিন থেকে ওষুধ, অক্সিজেন - সব ছেড়ে দিয়েছে বাজারের হাতে। বাজারকে যারা নিয়ন্ত্রণ করে, বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা যাদের আছে - এখন লুঠের সুযোগ পেয়েছে তারা। মওকা, বাকিদের জন্য মৃত্যু।
একদিকে জমছে মুনাফা, অন্যদিকে মরছে মানুষ। একদিকে অক্সিজেনের কালোবাজারি, অন্যদিকে অক্সিজেনের খোঁজে বেরিয়ে যাচ্ছে প্রাণবায়ু। মাঝখানে সরকার, প্রশাসন। রাষ্ট্র। মানুষের বিপরীতেই তার পক্ষপাত।
নিছকই প্রাকৃতিক নয়, পুরোদস্তুর এক রাজনৈতিক সঙ্কট এটা। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
স্বাস্থ্যসঙ্কট মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে। বজায় রাখতে হবে শারীরিক দূরত্ব। কিন্তু কিছুতেই তা যেন ‘সামাজিক’ না হয়ে যায়। বরং আরও বেশি দৃঢ় করা দরকার সামাজিক সংহতি। সামাজিক সামূহিক বিপদের দিনকালে।
প্রতিবেশী, সহনাগরিকদের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ঝাঁপিয়ে পড়ছেন ওঁরা। শহরে গঞ্জে গ্রামে বাংলার তরুণ প্রজন্ম। যে প্রজন্মটা গোল্লায় গেছে বলে ক’দিন আগে পর্যন্ত কপাল চাপড়াতেন অনেকে, সেই প্রজন্ম আজ গড়ছেন সামাজিক সংহতির অনন্য নজির। তরুণেরা, ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতীরা।
অবশ্য ওঁরা কেবল তরুণ-ই নন, তরুণ কমিউনিস্ট কর্মী। নিছক ‘ভলান্টিয়ার্স’ নন, ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’।
তাই অসুস্থ রোগীর বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়ার পথে হামলাও হয়। টেনে হিঁচড়ে বাইক থেকে ফেলে দমাদ্দম লাথি ঘুষি। টিক টিক টিক খেলা হয় জান্তব উল্লাসে। তৃতীয়বারের জন্য মসনদে বসার জনাদেশ পেয়েছেন মাননীয়া। অভিনন্দন! এ বড়ো সুখের সময় বাংলায়, এ বড়ো আনন্দের সময়! প্রচণ্ড ডিজের শব্দ, মদের গন্ধ আর মাস্তানদের হুমকিতে কাঁপছে আকাশ, বাতাস, মাটিও। রেড ভলান্টিয়ার্স - যুবতী, ছাত্রী - ধর্ষণের হুমকি তাঁদের রুখতে পারেনি।
করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রবল, ঝুঁকি আছে অলিতে গলিতে বড়ো রাস্তায় তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হওয়ারও। পেছনে তাকালে খোদ মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছে। সহনাগরিকের জীবন বাঁচাতে তবু সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন রেড ভলান্টিয়াররা। ঘাড়ে অক্সিজেনের সিলিন্ডার। পকেটে হয়তো রেমডিসিভির। আইসোলেশনে থাকা প্রতিবেশীর বাজারের থলে কিংবা এটা-ওটা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী।
অসীম সাহসী ছেলেমেয়েগুলো, ইতিহাস লিখে রাখুক আজকে, হামলা-হুমকির মুখে একদিনের জন্যও বন্ধ রাখেনি কাজ। একটাই কারণে।
কারণ এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব বর্তেছে আজ তরুণ কমিউনিস্ট কর্মীদের উপরে। দুনিয়ার কোনো হামলা, কোনো হুমকি কি পেরেছে কখনো নিজ দায়বদ্ধতা থেকে কমিউনিস্টদের চ্যুত করতে?
আক্রমণের মুখে কীভাবে নিজেদের কাজ করে যেতে হয় তা বিলক্ষণ শিখে নিয়েছেন বাংলার বামপন্থী ছাত্র-যুব কর্মীরা গত এক দশকে। যৌবন অবিচল বামপথে।
বামপন্থায় বিশ্বাসী বলেই পথে চলতে চলতে প্রশ্নও জন্ম নেয়। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে পরবর্তী পথের সন্ধান।
কাজ করতে করতেই কী সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে মনে? কী প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে?
এভাবে সম্ভব আদৌ সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান? নিজেদের সমস্তটা নিঙড়ে দিয়েও যতটা করা সম্ভব তা প্রয়োজনের তুলনায় আসলে যে কতটা কম তা একাজের সাথে যারা যুক্ত তারা প্রত্যেকে জানেন। প্রতিদিন একের পর এক ফোন ধরতে ধরতে, আকাশ পাতাল ফুঁড়ে আইসিইউ-অ্যাম্বুলেন্স-সিলিন্ডার-ভালভ-ওষুধ খুঁজতে খুঁজতে নিজেদের অভিজ্ঞতায় অনুভব করছেন। অনুভূত হচ্ছে। শুধু রেড ভলান্টিয়াররাই বা কেন, আক্রান্ত সঙ্কটাপন্ন প্রতিটি মানুষ নিজের অভিজ্ঞতায় অনুভব করছেন এ সঙ্কট আদতে এক রাজনৈতিক সঙ্কট। মজুতদারি, কালোবাজারি, ভেঙে পড়া সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বেলাগাম মুনাফার লোভ, চূড়ান্ত সরকারি অব্যবস্থা - পুরোদস্তুর রাজনৈতিক সঙ্কট।
একদিকে কিছু লোকের হাতে পুঁজির কেন্দ্রীভবন, অন্যদিকে বিপুল জনতার জীবনে দুদর্শার সঞ্চয়ন। পুঞ্জীভূত হচ্ছে ক্ষোভ। এই ক্ষোভকে সংগঠিত করে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। অবশ্য কর্তব্য। করতেই হবে একাজ। সঙ্কটাপন্ন অসংখ্য যাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে তাদের জড়ো করে করে।
এটাই চ্যালেঞ্জ। আজকের কাজকে সংহত করে রাজনৈতিক সংগ্রামের পর্যায়ে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এই চালেঞ্জ গ্রহণে সক্ষম তরুণ কমিউনিস্ট কর্মীরা। নিশ্চিত!
কেননা নিছক ‘ভলান্টিয়ার্স’ নন, এঁরা ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’। বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মী!