৫৮ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১৪ মে, ২০২১ / ৩০ বৈশাখ, ১৪২৮
ফিরে দেখাঃ বিশ্বকবির বিশ্ব পরিচয়
তপন মিশ্র
রবীন্দ্রনাথের তখন ৭৬ পেরিয়ে ৭৭ বছর। তাঁর মনে হলো বিজ্ঞানের এক বই লেখার। নোবেল জয়ী তখন খ্যাতির চূড়ায়। তবুও সাহিত্য ছেড়ে কেন বিজ্ঞান? ১৯০৮ সালে প্রকাশিত হলো ‘বিশ্ব পরিচয়’। ১৪৪ পাতার এই বইটির সমস্ত কিছু তিনি উৎসর্গ করলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। আচার্য সত্যেন্দ্রনাথের তখন বয়স প্রায় ৪৪। এতো মানুষ থাকতে কেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু - সে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু একথা সত্য যে, অনন্তকালের জন্য বাংলা ভাষায় এক অমূল্য সম্পদ তৈরির উৎস সৃষ্টি করলেন তিনি। ১৯৪৮ সালে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের প্রতিষ্ঠা করেন সত্যেন্দ্রনাথ। মূল উদ্দেশ্য বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা। পাঠকরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন বিশ্বকবির এই ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে। বইটির তৃতীয় সংস্করণে ভূমিকা লিখতে গিয়ে কবিগুরু লেখেনঃ ‘‘যে বয়সে শরীরের অপটুতা ও মনোযোগশক্তির স্বাভাবিক শৈথিল্যবশত সাধারণ সুপরিচিত বিষয়ের আলোচনাতেও স্খলন ঘটে সেই বয়সেই অল্প পরিচিত বিষয়ের রচনায় হস্তক্ষেপ করেছিলেম। তার একমাত্র কারণ সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার ছাঁচ গড়ে দেওয়ার ইচ্ছা আমার মনে ছিল।’’
পাঠকদের দ্বিতীয় লাইনটির উপর মনোনিবেশ করতে অনুরোধ করব। ‘‘সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা’’ অর্থাৎ নিশ্চিতভাবে আমাদের কাছে বিজ্ঞানের যুক্তির খেই ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছিল বিশ্বকবির মূল উদ্দেশ্য। তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়নি। তবে পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধের আবহ তৈরি হয়ে গেছে। জার্মানিতে হিটলারের হুঙ্কার মানুষের মধ্যে জাতিগত বিভাজন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে শাসকেরও এই প্রত্যয় হতে শুরু করেছে যে, জাতীয়তাবোধের নামে কীভাবে কিছু মানুষকে উন্মাদ বানিয়ে যুদ্ধের আবহ তৈরি করা যায়। তেমন একটা সময়ে জার্মানি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন বা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন আলবার্ট আইনস্টাইন, জেমস ফ্রাঙ্ক এবং ইরউইন শডিঙ্গারের মতো নোবেল জয়ী বিজ্ঞানীরা। ফিলিপ সোয়ার্জ (Philip Schwartz) নামে একজন জার্মান স্নায়ু চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ বিতাড়িত ১৮০০ জনের এক তালিকা তৈরি করেন। এমন এক অশান্ত সময়ে বিশ্বকবির সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা করার প্রয়াস ছিল অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ এই সময়েই জাতপাতের ভিত্তিতে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের কাজ সারা বিশ্বে এক অসহনীয় অবস্থা তৈরি করেছিল। জার্মান সরকার ১৯৩৩ সালে ‘Law for the restoration of the profession Civil services’ তৈরি করে যার মূল কথা ছিল, নাজি সরকার বিরোধী সমস্ত ব্যক্তি এবং ইহুদিকে সমস্ত সরকারি পদ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। ফলে অনেকেরই স্থান হয়েছে হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে না হয় অন্য দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে। এর প্রভাব যে এদেশে পড়েনি তা নয়। একারণে সম্ভবত মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চর্চা ও যুক্তিবোধ তৈরিতে সচেষ্ট হন বিশ্বকবি।
রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে লেখা ওই চিঠিতে বলছেনঃ ‘‘কিন্তু মানুষ আর যাই হোক সহজ মানুষ নয়। মানুষ একমাত্র জীব যে আপনার সহজ বোধকেই সন্দেহ করেছে, প্রতিবাদ করেছে, হার মানাতে পারলেই খুশি হয়েছে। মানুষ সহজ শক্তির সীমানা ছাড়াবার সাধনায় দূরকে করেছে নিকট, অদৃশ্যকে করেছে প্রত্যক্ষ, দুর্বোধকে দিয়েছে ভাষা। প্রকাশলোকের অন্তরে আছে যে অপ্রকাশলোক, মানুষ সেই গহনে প্রবেশ করে বিশ্বব্যাপারের মূলরহস্য কেবলই অবারিত করেছে।’’
সময়টার কথা আবার মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। জার্মানি ও ইতালি থেকে বিতাড়িত বিজ্ঞানী সহ আরও এক ঝাঁক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষক পরমাণু শক্তির বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন। ইতালীয় বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মিং এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হন। তৈরি করেন চিকাগো পাই-১ নামে এক পরমাণু চুল্লি। তিনি ইতালি থেকে ১৯৩৮ সালে বিতাড়িত হয়ে আমেরিকায় আশ্রয় নেন এবং ওই বছরই তাঁর নোবেল প্রাপ্তি। স্কটল্যান্ডের আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ১৯২৮ সালে যে পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন তা ১৯৩০-এর পর সারা বিশ্বে জীবনে নতুন স্পন্দন সৃষ্টি করে। মানুষের হাতে দূরারোগ্য রোগ নিরাময়ের নতুন অস্ত্র এসে যায়। এগুলি সহ আরও নিত্য নতুন আবিষ্কার, মহাবিশ্বের রহস্য সন্ধানে মানুষের প্রয়াস বিশ্বকবিকে ‘‘অপ্রকাশ লোক’’-এর স্বাদ জুগিয়েছে। কিন্তু আবার তিনি লিখছেনঃ ‘‘যে সাধনায় এটা সম্ভব হয়েছে তার সুযোগ ও শক্তি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষেরই নেই। অথচ যারা সাধনার শক্তি ও দান থেকে একেবারেই বঞ্চিত হল তারা আধুনিক যুগের প্রত্যন্তদেশে একঘরে হয়ে রইল।’’
রবীন্দ্রনাথের যে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি এক সহজাত টান ছিল তা তিনি প্রকাশ করেছেন সোচ্চারে। স্যার রবার্ট স্টাওয়েল বল-এর বেশ কয়েকটি বইও তিনি মন দিয়ে পড়েছেন বলে সত্যেন্দ্রনাথকে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করেন। আয়ারল্যান্ডের মহাকাশবিজ্ঞানী বল তখন স্ক্রুউ তত্ত্ব আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন মহাজাগতিক গঠন (গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদির) সমূহের মধ্যেকার শক্তির ব্যাখ্যা করেন। ‘স্টারল্যান্ড অ্যান্ড দ্য স্টোরি অফ হেভেনস’ তাঁর এক বিখ্যাত বই। এছাড়াও যাঁদের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে প্রাণীবিজ্ঞানী জুলিয়ান হাক্সলে-র নাম উল্লেখযোগ্য। হাক্সলে কলিঙ্গ পুরস্কার প্রাপ্ত যিনি ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের গবেষক এবং প্রচারক ছিলেন। অভিব্যক্তি বিজ্ঞানের এই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তি নব্য-ডারউইনবাদ (New Darwinism)-এর প্রবর্তক। বিশ্বকবি লিখছেনঃ ‘‘এক সময়ে সাহস করে ধরেছিলুম প্রাণতত্ত্ব সম্বন্ধে হক্সলির এক সেট প্রবন্ধমালা।’’
আচার্য সত্যেন্দ্রনাথকে লেখা চিঠির আর একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার মনে করছি। বিজ্ঞানের বিষয় সহজ-সরল করে হাজির করার অর্থ বিজ্ঞানের তথ্যকে লঘু করা নয়। কেউ কেউ মনে করেন বিজ্ঞানের প্রবন্ধকে সহজপাচ্য করতে জটিল বিষয়গুলিকে বাদ দেওয়াই শ্রেয়স্কর। রবীন্দ্রনাথ লিখছেনঃ ‘‘এই বইখানিতে একটি কথা লক্ষ্য করবে-এর নৌকাটা অর্থাৎ এর ভাষাটা যাতে সহজে চলে সে চেষ্টা এতে আছে, কিন্তু মাল খুব বেশি কমিয়ে দিয়ে একে হালকা করা কর্তব্য বোধ করিনি। দয়া করে বঞ্চিত করাকে দয়া বলে না। আমার মত এই যে, যাদের মন কাঁচা তারা যতটা স্বভাবত পারে নেবে, না পারে আপনি ছেড়ে দিয়ে যাবে, তাই বলে তাদের পাতটাকে প্রায় ভোজশূন্য করে দেওয়া সদ্ব্যবহার নয়।’’ আমরা যারা বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কাজে ব্রতী তাদের জন্য এটি একটি আলোকবর্তিকার মতো।
অধ্যায়গুলিতে ‘বিশ্ব পরিচয়’-এর সূচিতে উপসংহার বাদ দিলে মোট পাঁচটি অধ্যায় আছে। প্রথম অধ্যায়টি হলোঃ ‘পরমাণুলোক’। এই অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছেন সৌর সংসার দিয়ে। সূর্যের চারপাশে গ্রহদের ঘুর্ণন দিয়ে। পরেই আসছেন গ্রহ-নক্ষত্রের দূরত্বের কথায়। তিনি লিখছেনঃ ‘‘এই বিরাট দূরত্ব থেকে নক্ষত্রদের অস্তিত্বের খবর এনে দিচ্ছে কিসে। সহজ উত্তর হচ্ছে আলো। কিন্তু আলো যে চুপচাপ বসে খবর আউরিয়ে যায় না, আলো যে ডাকের পেয়াদার মতো খবর পিঠে করে নিয়ে দৌড়ে চলে, বিজ্ঞানের এই একটা মস্ত আবিষ্কার।’’
এই গভীর অনুভূতি ছড়িয়ে দেওয়ার ভাবনার কোনো তুলনা হয় না। তখন জার্মানির বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্ক ১৯০০ সালে এবং তারপর আলোর স্বভাব এবং গতি নিয়ে অনেক আবিষ্কার করেন। প্লাঙ্ককে বলা হয় যে, তিনি পদার্থবিদ্যার জগতে বিপ্লব আনেন। রবীন্দ্রনাথ এই বিপ্লবের আঁচ পেয়েছিলেন। প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিশ্বে সমস্ত কিছুর গতির ধারণাই বদলে দিল, এমনকি আলোর গতির ধারণা। তাই আলোর গতি বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ আরও বললেনঃ ‘‘চলা বলতে সামান্য চলা নয়, এমন চলা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আর কোনো দূতেরই নেই।’’
এখানে ম্যাক্স প্লাঙ্কের কথা যখন এলো তখন একটু বলতে ইচ্ছে করে। এই বিশাল মাপের মানুষের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির শোচনীয় দশার পর আহ্বান ছিলঃ ‘‘দেশ গঠনের কাজ চালিয়ে যাও’’। জার্মান পিপলস্ পার্টি নামে একটি দলেরও সদস্য ছিলেন তিনি যাদের নীতি ছিল, ‘আর যুদ্ধ নয় - শান্তিই দেশের জন্য কাম্য’। নাজিদের উত্থান তাঁকে বিব্রত করেছিল। ১৯৩৩-এ যখন নাজিরা তথা হিটলার ক্ষমতায় আসে তখনও তাঁর স্লোগান ছিল, এক স্থিতিশীল অবস্থার জন্য লড়াই করতে হবে। ১৯১৮ সালে তিনি নোবেল পান।
সৌরমণ্ডলের গ্রহদের ঘূর্ণনের সঙ্গে তিনি পরমাণু গঠনের তুলনা করেছেন বার বার। রবীন্দ্রনাথ এখানেই পরমাণুতে বিপরীতধর্মী কণার কথা উল্লেখ করে বলেছেনঃ ‘‘তর্জমা করলে দাঁড়ায় হ্যাঁ ধর্মী আর না ধর্মী। এদের মেজাজ পরস্পরের উলটো, এই বিপরীতকে মিলিয়ে দিয়ে হয়েছে সমস্ত যা কিছু। অথচ পজিটিভের প্রতি পজিটিভের, নেগেটিভের প্রতি নেগেটিভের আসক্তি নেই, এদের টানটা বিপরীত পক্ষের দিকে। ...এই দুই জাতের সূক্ষ্ম বিদ্যুৎ কণা জোট বেঁধেছে পরমাণুতে। এই দু’পক্ষকে নিয়ে প্রত্যেক পরমাণু যেন গ্রহে সূর্যে মিলন-বাঁধা।’’ বৈপরীত্যের মধ্যে এই স্থিতাবস্থাকে এমনভাবে কে বা বোঝাতে পারে। অথচ দেখুন ভিন্ন ধর্মের হলেই আমাদের ইদানীংকালের মুরব্বিরা যেন আঁতকে ওঠেন। বৈপরিত্যের মধ্যে ঐক্য যে বিশ্বের মর্মবস্তু তা গোঁড়াদের বোঝার মতো মেধা কই।
এছাড়াও এই অধ্যায়ে তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত মৌলিক পদার্থ, তেজস্ক্রিয়তা, কস্মিক রশ্মি ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা। পরের অধ্যায়টি ‘নক্ষত্রলোক’। এই অধ্যায়ে এক জায়গায় তিনি লিখছেনঃ ‘‘একদিন মানুষ ঠিক করেছিল বিশ্বমণ্ডলের কেন্দ্রে পৃথিবীর আসন অবিচলিত, তাকে প্রদক্ষিণ করছে সূর্যনক্ষত্র। মনে যে করেছিল, সে জন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না - সে দেখেছিল পৃথিবী-দেখা সহজ চোখে। আজ তার চোখ বেড়ে গেছে, বিশ্ব দেখা চোখ বানিয়ে নিয়েছে।’’ এই পরিবর্তন যার হয় না সে গোঁড়া। গোঁড়াদের আধিপত্য বৃদ্ধি পেলেই সমূহক্ষতি। যেমনটা হয়েছিল ব্রুনোকে পুড়িয়ে; জার্মানি বা ইতালির ফ্যাসিস্তদের জমানায় এবং আজকে ভারত সহ অন্যান্য বেশ কিছু দেশে। এই অধ্যায়ে তিনি আলোকবর্ষের ধারণা, আলোর বর্ণালীর এবং আলোর ঢেউয়ের দূরত্ব (wave length), নীহারিকা, মহাকর্ষ শক্তি ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
পরের অধ্যায়টি ‘সৌরজগৎ’। এখানে সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলির ঘূর্ণন, সৌরজগতের সৃষ্টি, নিজের কক্ষপথে পৃথিবীর ঘূর্ণন ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করেন। এই বর্ণনা করতে গিয়ে এক অত্যন্ত জটিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের কথা বলেছেন তিনি। এক জায়গায় তিনি লিখছেনঃ ‘‘সূর্যের এই সব দাগের কমা-বাড়ার প্রভাব পৃথিবীর উপরে নানারকমে কাজ করে। যেমন আমাদের আবহাওয়ায়। প্রায় এগারো বছরের পালাক্রমে সূর্যের দাগ বাড়ে কমে। পরীক্ষায় দেখা গেছে বনস্পতির গুঁড়ির মধ্যে এই দাগি বৎসরের সাক্ষ্য আঁকা পড়ে।’’ এখানেই তিনি আরিজোনার এক বিশালাকৃতি গাছের গুঁড়ির মধ্যে যে বর্ষবলয় থাকে সে সম্পর্কিত ডেভিড ডগলাস নামে এক উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর এক আবিষ্কারের কথা বলেছেন। পরের অধ্যায়ে ‘গ্রহলোক’। এখানে সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলির সজ্জা এবং এদের অবস্থানের কথা উল্লেখ আছে। গ্রহ ও নক্ষত্রসমূহের ওজন সম্পর্কিত গবেষণা, ধূমকেতু এবং এর মধ্যে পৃথিবী সৃষ্টির আদি মুহূর্ত থেকে শুরু করে আধুনিককাল পর্যন্ত বিশ্লেষণ করেছেন। পৃথিবীপৃষ্ঠে উদ্ভিদজগতের উপস্থিতির কারণে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার জন্য আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টিও উল্লেখ করতে ভোলেননি।
উপসংহার টানার আগের অধ্যায়টি হলো ‘ভূলোক’, পৃথিবী সৃষ্টির আদি মুহূর্ত থেকে এ পর্যন্ত বর্ণনা করেছেন তিনি এই অধ্যায়ে। পৃথিবী পৃষ্ঠের জল, স্থল ও বায়ুমণ্ডলের বিবর্তনের কথা বর্ণিত আছে তাঁর লেখায়। এখানে তিনি বলেছেনঃ ‘‘নানারকমের প্রচণ্ড আঘাতে তাদেরই উলটপালট করে জোড়াতাড়া দিয়ে নদী-পাহাড়-সমুদ্রের রচনা ও অদলবদল চলছিল। এমন সময়ে এই বিরাট জীবনহীনতার মধ্যে দেখা দিল প্রাণ, আর তার সঙ্গে মন। এর পূর্ববর্তী পদার্থরাশির সঙ্গে এর কোনোই মিল নেই।’’ বিবর্তনের এই ব্যাখ্যা সত্যই অবাক করার মতো। ডারউইনের সৃষ্টিতত্ত্বের আঘাত সঞ্চারিত হয়েছে সমস্ত জ্ঞানপিপাসুর মধ্যে। হাক্সলের বই পড়ে সেই তত্ত্বের আস্বাদ পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। বিজ্ঞানের এই অমোঘ অস্ত্র প্রয়োগের একটুও ঘাটতি করেননি বিশ্বকবি। তিনি আরও বলছেনঃ ‘‘বিশ্বরচনার মূলতম উপকরণ পরমাণু; সেই পরমাণুগুলি অচিন্ত্যনীয় বিশেষ নিয়মে অতি সূক্ষ্ম জীবনকোষরূপে সংহত হল। প্রত্যেক কোষটি সম্পূর্ণ এবং স্বতন্ত্র, তাদের প্রত্যেকের নিজের নিজের ভিতরেই একটা আশ্চর্য আছে যাতে করে বাইরে থেকে শক্তি খাদ্য নিয়ে নিজেকে পুষ্ট, অনাবশ্যককে ত্যাগ ও নিজেকে বহুগুণিত করতে পারে।’’ পাঠকদের লক্ষ করতে অনুরোধ করব যে, কোষের শারীরবৃত্তীয় কাজের বর্ণনার সময় কোথাও কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কথা ভাবেননি। বস্তুর পরমাণু থেকে কোষ, অর্থাৎ জীবন এবং প্রত্যেক কোষের স্বতন্ত্র গ্রহণ ও বর্জনের ক্ষমতার উপর জোর দিয়ে প্রাণের অভিব্যক্তি ও বিপাকক্রিয়ার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। কেন ভাববাদী দর্শনের কথা ‘‘তথা শরীরানি বিহায় জীর্নাঃ, ন্যান্যানি সংয়াতি নবানি দেহী’’ (ভগবত গীতা, ২য় অধ্যায়, শ্লোক নং ২২) এখানে স্থান পায়নি। অংশই দেহের সবকিছু নিয়ন্ত্রক, এমন ধারণার বিরুদ্ধ মত, যা বিজ্ঞানের যুক্তিবোধ তৈরি করে, সেটাই প্রতিষ্ঠা করেছেন বিশ্বকবি।
আর একটি জায়গায় তিনি লিখছেনঃ ‘‘এই জীবাণুকোষ প্রাণলোকে প্রথমে একলা হয়ে দেখা দিয়েছে। তারপর এরা যত সংঘবদ্ধ হতে থাকল ততই জীবজগতে উৎকর্ষ ও বৈচিত্র্য ঘটতে লাগল।’’ ডারউইনের সময়কাল থেকে এ পর্যন্ত অভিব্যক্তি বিজ্ঞানের বহু প্রতিষ্ঠিত সত্যের মধ্যে একটি হলো বিবর্তনের মূল লক্ষ্য ‘‘উৎকর্ষ এবং বৈচিত্র্য।’’ কখনও কখনও বিবর্তনের পথ ভুল পথে এগোয়, কিন্তু সময়সাপেক্ষ হলেও প্রকৃতি/সমাজ তাকে ঠিক পথে নিয়ে আসতে বাধ্য করে।
উপসংহার
এই বিশাল ভাবনার সবকিছু ব্যাখ্যা করা এই প্রবন্ধে সম্ভব নয়। বিশ্বকবির এই সৃষ্টির উপসংহারে তাঁরই কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরা জরুরি মনে করছি। সৃষ্টিতত্ত্ব বিশ্বাসীরা বলেন যে, শরীর না হয় বস্তুর বিবর্তিত রূপ কিন্তু মন? মানুষের বা মনুষ্যেতর প্রাণীদের মন, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলির চালিকাশক্তি হলো অদৃশ্য এক শক্তি (designer)। Intelligent Designer (বুদ্ধিমান নকশাকার)-এর তত্ত্ব খাড়া করে এই সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলির বিকাশের কথা ভাববাদী দর্শনের প্রবক্তারা বলতে শুরু করল।
রবীন্দ্রনাথ আর এক জায়গায় লিখছেনঃ ‘‘অপ্রাণ বিশ্বে যে-সব ঘটনা ঘটছে তার পিছনে আছে সমগ্র জড়জগতের ভূমিকা। মন এই-সব ঘটনা জানছে, এই জানার পিছনে মনের একটা বিশ্বভূমিকা কোথায়। পাথর-লোহা-গ্যাসের নিজের মধ্যে তো জানার সম্পর্ক নেই। এই দুঃসাধ্য প্রশ্ন নিয়ে বিশেষ একটা যুগে প্রাণ মন এল পৃথিবীতে - অতিক্ষুদ্র জীবকোষকে বাহন করে।’’
এই বিশ্লেষণ ছাড়াও অনেক প্রশ্নের উল্লেখ আছে তাঁর এই সৃষ্টিতে। এটাই তো স্বাভাবিক। প্রশ্ন করতে ভুলে গেলে বা ভয় পেলে আমাদের সমস্ত অস্তিত্বের উপর ভর করবে ভাববাদীরা। বিজ্ঞান চরম সত্যে বিশ্বাসী নয়। তাই প্রশ্ন করাই বিজ্ঞানের ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্ব পরিচয় লিখছেন, তার প্রায় ৮০ বছর পর আমরা অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি। আরও উত্তর আমরা খুঁজতে ব্যস্ত। যা কিছু অধরা, তার উত্তর খুঁজতে হবে যুক্তির ওপর ভর করে, কোনো ঐশ্বরিক শক্তির উপর নয়। এ কারণেই তো আমরা এই চলমান বিশ্বে নিত্য নতুন সত্যের সন্ধান পাচ্ছি।