E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১৪ মে, ২০২১ / ৩০ বৈশাখ, ১৪২৮

শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য ও সংগ্রামের আহ্বান

অরিন্দম কোঙার


তিনটে দিন

শ্রমজীবী মানুষের কাছে ২২ এপ্রিল, ১ মে, ৫ মে বছরের খুব কাছাকাছি এমন তিনটে তাৎপর্যপূর্ণ দিন যা সারা বিশ্বের দেশে দেশে উদ্‌যাপিত হয়। উদ্‌যাপিত হয় শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য মজবুত করার জন্য, সংগ্রামকে জোরদার করার জন্য। ১৮৭০ সালের ২২ এপ্রিল লেনিনের জন্ম, ১৮৯০ সালের ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবসের সূত্রপাত, ১৮১৮ সালের ৫ মে মার্কসের জন্ম। শ্রমজীবী মানুষ তো কেবল এই তিনটে দিনেই নয়, সারা বছর মার্কস-লেনিনের শিক্ষা (যার মাঝে আছেন মার্কসের সহযোদ্ধা এঙ্গেলস) কতটা আয়ত্ত করতে পেরেছে, শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য গড়ে তুলে সেই শিক্ষার কতটা প্রয়োগ ঘটাতে পেরেছে, তার পর্যালোচনা করে। তাছাড়া, গোটা মানব সমাজের কাছেই এই তিনটে দিন তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এই দিনগুলোর সঙ্গে মানবসমাজের অগ্রগমন, মানব সভ্যতার বিকাশ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

মার্কস ও লেনিন

মার্কসের নাম উচ্চারিত হলেই তাঁর সহযোদ্ধা এঙ্গেলসের নাম চলে আসে। কার্ল মার্কস (‍‌১৮১৮-৮৩) ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস (১৮২০-৯৫) ১৮৪৪ সাল থেকে ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত একসঙ্গে কাজ করেন এবং মার্কসের মৃত্যুর পর তাঁর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন এঙ্গেলস। শ্রমজীবী মানুষ পায় শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে তাদের, সেই সঙ্গে গোটা মানব সমাজের মুক্তির মতবাদ, ‘মার্কসবাদ’। সমাজতন্ত্রের মতবাদ। সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের মতবাদ।

‘‘দার্শনিকেরা কেবল নানাভাবে জগৎকে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু আসল কথা হলো তাকে পরিবর্তন করা।’’ (ফয়েরবাখ সম্বন্ধে থিসিসসমূহ) ১৯৪৫ সালে চিরায়ত জার্মান দর্শনের অন্যতম প্রতিনিধি ল্যুদভিগ্‌ ফয়েরবাখ (১৮০৪-৭২)-এর দর্শন সম্পর্কে আলোচনায় মার্কস এই মন্তব্য করেন। এই একটা বাক্যের মধ্য দিয়ে মার্কস ‘ব্যাখ্যা’ ও ‘পরিবর্তন’-এর মধ্যে মৌল পার্থক্য তুলে ধরেন। মার্কস যখন জীবিত ছিলেন তখন পুঁজিবাদ বেশ হৃষ্টপুষ্ট। পঞ্চদশ-‍‌ষোড়শ শতক থেকে সমুদ্র অভিযান, লুণ্ঠন, উপনিবেশ স্থাপন, দাস ব্যবসা, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক শিল্প গড়ে তোলা, বুর্জোয়া বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ ক্রমশ প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। মার্কসের মহাগ্রন্থ তিন খণ্ডে প্রকাশিত ‘ক্যাপিটাল’। প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৬৭ সালে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলসের সম্পাদনায় যথাক্রমে ১৮৮৫ ও ১৮৯৪ সালে। বইটার প্রথম খণ্ডে মার্কস সুষমামণ্ডিত ভাষায় লেখেন, ‘‘আজকাল শিল্পগত প্রাধান্য মানে হলো বাণিজ্যগত প্রাধান্য। সঠিকভাবে অভিহিত ম্যানুফ্যাকচারের আমলে ব্যাপারটা ছিল আলাদা; তখন বাণিজ্যগত প্রাধান্য দান করত শিল্পগত আধিপত্য। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা যে তখন প্রাধান্যপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করত, তার কারণও ছিল এই। ‘নবাগত ঈশ্বর’ তখন ইয়োরোপের পুরাগত ঈশ্বরদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ দিয়ে বেদি-মঞ্চে আসন পরিগ্রহণ করেন; তারপরে একদিন আচমকা এক ধাক্কা ও লাথি মেরে তাদের সকলকে এক জঞ্জালস্তূপে ছুঁড়ে ফেলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনই হলো মানবজাতির একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।’’ মার্কসের সময়ে ছিল প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদের যুগ এবং সেখান থেকে একচেটিয়া পুঁজিবাদে প্রবেশের যুগ। তারপর আসে লগ্নিপুঁজি। পুঁজিবাদের সর্বোচ্চস্তর হিসাবে দেখা দেয় সাম্রাজ্যবাদ। কিন্তু পুঁজিবাদই শেষ নয়। বুর্জোয়াদের আধিপত্য চূড়ান্ত নয়। মার্কস ও এঙ্গেলস দেখান যে, ‘‘বুর্জোয়াশ্রেণির অস্তিত্ব ও শাসনের মূল শর্ত হলো পুঁজির সৃষ্টি ও বৃদ্ধি; পুঁজির শর্ত হলো মজুরি-শ্রম। মজুরি-শ্রম সম্পূর্ণভাবে শ্রমিকদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার উপর প্রতিষ্ঠিত। যন্ত্রশিল্পের যে অগ্রগতি বুর্জোয়াশ্রেণি অন্ধের মতো বাড়ি‍‌য়ে চলে, তার ফলে শ্রমিকদের প্রতিযোগিতা-হেতু বিচ্ছিন্নতার জায়গায় দেখা দেয় সম্মিলন-হেতু বিপ্লবী ঐক্য। সুতরাং যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বুর্জোয়াশ্রেণি উৎপাদন করে ও উৎপন্ন বস্তু দখল করে, আধুনিক শিল্পের বিকাশ তার পায়ের তলা থেকে সেই ভিত্তিটাই কেড়ে নিচ্ছে। তাই বুর্জোয়া‍শ্রেণি সৃষ্টি করছে সর্বোপরি তারই নিজের কবর খনকদের। বুর্জোয়ার পতন ও প্রলেতারিয়েতের জয়লাভ, দু-ই সমান অনিবার্য।’’ (কমিউনিস্ট ইস্তাহার) এটাই সমাজের অভিমুখ। তবে বুর্জোয়ার পতন আপনা-আপনি হয় না। বুর্জোয়ার পতন ঘটাতে হয় এবং তার জন্য প্রলেতারিয়েতের সমাজতান্ত্রিক চেতনায় সমৃদ্ধ সংগঠন ও সংগ্রাম গড়ে তুলতে হয়। শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য তো অপরিহার্য।

লেনিনের জীবনকাল ৫৪ বছর, ১৮৭০-১৯২৪ সাল। এই সময়ের মধ্যে লেনিন মার্কসবাদ আয়ত্ত করেন, মার্কসবাদের বিকাশ ঘটান, মার্কসবাদের সফল প্রয়োগ করেন, কমিউনিস্ট পার্টি (রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি-বলশেভিক)-কে যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টিতে দাঁড় করান, বিপ্লবের স্তর স্থির করেন, বিপ্লবে নেতৃত্ব দেন, জারশাসিত রুগ্ন রাশিয়াকে বলিষ্ঠ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে নিয়ে যাওয়ার সূত্রপাত ঘটান। মার্কসবাদের ভিত্তিতে দেখান যে, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ-স্তর সাম্রাজ্যবাদ। দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলা ও ঔপনিবেশিক দেশগুলোর মুক্তি সংগ্রাম জোরদার করার জন্য লেনিন স্থাপন করেন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক বা তৃতীয় আন্তর্জাতিক। লেনিনের বিচারে মার্কসবাদ হচ্ছে, ‘‘এঙ্গেলস তাঁর নিজের এবং তাঁর সুপ্রসিদ্ধ বন্ধুর সম্পর্কে বলেছিলেন, আমাদের মতবাদ আপ্তবাক্য নয়, কর্মের দিগ্‌দর্শন। মার্কসবাদের যে দিকটা প্রায়শই দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায় এই চিরায়ত উক্তির মধ্যে সেই দিকটাকেই আশ্চর্য জোর ও স্পষ্টতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এবং এই দিকটাকে দৃষ্টির অগোচরে রাখার ফলেই আমরা মার্কসবাদকে একপেশে, বিকৃত ও প্রাণহীন করে তুলি, তার সজীব আত্মাটাকেই আমরা বাদ দিয়ে বসি, তার যে মৌলিক তাত্ত্বিক ভিত্তি - দ্বন্দ্বতত্ত্ব, বিরোধে ভরা এক সর্বাঙ্গীণ ঐতিহাসিক বিকাশের এ‍‌ই মতবাদকে আমরা খর্ব করি; ইতিহাসের প্রতিটি নতুন মোড় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে যুগের যে কর্তব্যকর্মেও বদল ঘটা সম্ভব, প্রতি যুগের সেই সুনির্দিষ্ট ব্যবহারিক কর্তব্য থেকে আমরা তার সম্পর্কচ্ছেদ করে বসি।’’ (মার্কসবাদের ঐতিহাসিক বিকাশের কয়েকটা বৈশিষ্ট্য) এই দৃষ্টিভঙ্গিতে রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণ করে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ‘মার্কসবাদ’ হয়ে ওঠে ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’।

মে দিবস

অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে প্রধান শোষণশ্রেণি হিসাবে দেখা দেয় শিল্পপুঁজির মালিক ‘বুর্জোয়া’, অপরদিকে প্রধান শোষিতশ্রেণি হয়ে দাঁড়ায় ‘প্রলেতারিয়েত’ বা আধুনিক শ্রমিকশ্রেণি। এ‍‌ই শ্রমিকদের একেবারে নিংড়ে নেওয়া হতো। দিনে ১৪-১৬ ঘণ্টা, এমনকি কোথাও কোথাও ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। জীবনযাত্রার মান অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্থাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থা ইত্যাদি ছিল অতি নিম্ন। অবর্ণনীয় জীবন। প্রতিবাদ-প্রতি‍‌রোধ হচ্ছিল, তবে তা স্বতঃস্ফূর্ত ও এখানে-ওখানে। এই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের রূপ নিতে থাকে ঊনবিংশ শতকে, মূলত কাজের ঘণ্টা কমানোর দাবিতে। শেষ পর্যন্ত দৈনিক কাজের ঘণ্টা কমানোর ক্ষেত্রে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি সামনে আসে।

ঊনবিংশ শতকে লুডাইড বিদ্রোহ, চার্টিস্ট আন্দোলন ইত্যাদি নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্ততার পরিবর্তে সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকে। দেশে দেশে গড়ে উঠতে থাকে ট্রেড ইউনিয়ন। অপরদিকে পুঁজির মালিকরাও বসে থাকে না। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পুঁজিবাদ প্রবেশ করে একচেটিয়া পুঁজিবাদের যুগে। শ্রমিকদের দমিয়ে রাখার জন্য তারা নানা পন্থা নিতে থাকে। আমেরিকায় একদিকে যেমন শ্রমিক মিছিলে স্লোগান ওঠে, ‘আট-ঘণ্টা জুতো’, ‘আট-ঘণ্টা চুরুট’, গান গাওয়া হয় -
কল-কারখানা-বন্দর থেকে
বাজাই যে রণডঙ্কাঃ
শ্রম, বিশ্রাম, আনন্দ - সবই
এক একটি আট ঘণ্টা।


অপরদিকে এই আমেরিকাতেই রেলপথ, টেলিগ্রাফ, জাহাজ ইত্যাদি কোম্পানির অন্যতম মালিক জে গোল্ড ১৮৮৬ সালে আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিম রেলপথের শ্রমিকদের ধর্মঘটের ঠিক আগে দম্ভভরে বলেন, ‘‘শ্রমিকশ্রেণির অর্ধেক অংশকে আমি ভাড়া করতে পারি বাকি অর্ধেককে খুন করার জন্য।’’ ধর্মঘট ভাঙার জন্য, মানুষ খুন করার জন্য কেবল একক গোল্ড নন, গুন্ডাবাহিনী তৈরি করার জন্য কোম্পানি খোলা হয় ‘পিংকার্টন এজেন্সি’ নামে। সংবাদপত্রকে ব্যবহার করা হয়। সেই সময়ে আমেরিকার এক বিখ্যাত সাংবাদিক জন সুইনটন। ১৮৮০ সাল নাগাদ এক প্রীতিভোজে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এই প্রীতিভোজে এক অতিথি স্বাধীন প্রেসের নামে স্বাস্থ্য পান করতেই সুইনটন ক্ষিপ্ত হয়ে যা বলেছিলেন, তার একটা অংশে আছে, ‘‘আপনারা এটা জানেন এবং আমিও জানি, অথচ ‘স্বাধীন প্রেসে’র স্বাস্থ্যকামনার এ কি নির্বুদ্ধিতা। পর্দার অন্তরালে যেসব বড়লোক আছেন, তাঁদেরই হাতিয়ার ও বাহন হলাম আমরা। আমরা খেলার পুতুল, তাঁরা সুতো টানেন, আমরা নাচি। আমাদের সুদক্ষ নৈপুণ্য, আমাদের সম্ভাবনা ও আমাদের জীবন সবই অন্যদের সম্পত্তি। আমরা হলাম বুদ্ধিজীবী গণিকা।’’

এর মধ্যেই ১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার (১৮৮৬ সালে এই নাম) প্রস্তাব নেয় যে, ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে সারা দেশে ৮ ঘণ্টা কাজ চালু করার দাবিতে শ্রমিকরা সংগঠিতভাবে লড়াই করবে। এ‍‌ই প্রস্তাব অনুযায়ী ১৮৮৬ সালের ১ মে সারা আমেরিকায় শ্রমিক-ধর্মঘট ছড়িয়ে পড়ে। ২ মে রবিবার, ছুটি। ৩ মে ধর্মঘট আরও বিস্তৃত হয়। ‍শিকাগোয় ‘ম্যাককর্মিক হার্ভেস্টিং কোম্পানি’ নামে একটা কারখানায় লকআউট চলছিল। মালিক দালালদের কারখানায় ঢোকাতে চাইছিল। ফলে শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। মালিক পুলিশ ডাকে এবং পুলিশের গুলিতে অনেকে হতাহত হয়। ৪ মে শিকাগোর হে মার্কেট স্কোয়ারে প্রতিবাদ সভা। শান্তিপূর্ণ সভা, কিন্তু পুলিশের সভা বন্ধ করার নির্দেশ। সভা চলে। শেষ বক্তার বক্তৃতা শেষ হওয়ার মুখে এক দালাল-প্ররোচকের বোমা নিক্ষেপ এবং সেই সূত্রে পুলিশের গুলি। অনেক শ্রোতা, সাধারণ মানুষ হতাহত হয়। কয়েকজন পুলিশও মারা যায় ও জখম হয়। এরই পরিণতিতে গ্রেপ্তার ও বিচার হয় ৮ জনের - অগাস্ট স্পাইস, স্যামুয়েল ফিল্ডেন, মাইকেল শোয়াব, জর্জ এঞ্জেল, এডল্‌ফ ফিসার, লুই লিংগ, অ্যালবার্ট পারসনস ও অস্কার নিবি। এঁদের মধ্যে ৩জন ছিলেন শ্রমিক পত্রিকার সম্পাদক, ৫জন শ্রমিক সংগঠনের নেতা। আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাঁরা অভিযোগের উদ্দেশ্য উন্মোচিত করে দেন। পারসন্‌স তাঁর ৬ ঘণ্টার বক্তব্যে বলেন, ‘‘এখন আমি খোলাখুলিভাবেই প্রকাশ করতে চাই যে, এই অভিযোগ আনার জন্য অভিযোগকারীরা, সরকারি প্রতিনিধি, আইনের বড়ো অফিসারেরা আইনশৃঙ্খলা মেনে চলা এবং তা রক্ষা করার জন্য জনসাধারণের কাছে যাঁরা দায়বদ্ধ - মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তাঁরা স্বেচ্ছায় বিদ্বেষপরায়ণ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আমেরিকার নাগরিকদের জন্য গ্যারান্টিযুক্ত সমস্ত অধিকারকে কেড়ে নিয়েছেন বলে আমি তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছি। স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকারকে তাঁরা কেড়ে নিয়েছেন। এ‍‌ই মামলা করতে গিয়ে তাঁরা প্রকাশনার স্বাধীনতাকেও ক্ষুণ্ণ করেছেন।’’ নিবিকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড ও অন্যান্যদের প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। ‍‌লিংগ রহস্যজনকভাবে জেলে মারা যান। শেষ পর্যন্ত ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর ফাঁসি হয় ৪ জনের - পারসন্‌স, ফিসার, স্পাইস ও এঞ্জেল-এর।

মার্কসের উদ্যোগে শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতি (প্রথম আন্তর্জাতিক, ১৮৬৪-৭৬) গড়ে ওঠে। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষে এঙ্গেলসের উদ্যোগে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক (১৮৮৯-১৯২৪)-এর প্রতিষ্ঠা কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয় যে, কেবল আমেরিকায় নয়, সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ ১৮৯০ সাল থেকে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস পালন করবে। সেই ১৮৯০ সাল থেকে ‘মে দিবস’ উদ্‌যাপন শুরু। তারপর থেকে মে দিবস হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস। ১৮৯৩ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের তৃতীয় কংগ্রেসের প্রস্তাবে লেখা হয়, ‘‘আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ১ মে তারিখে যে শ্রমিক সমাবেশ, তা শ্রমিকশ্রেণির সুদৃঢ় সংকল্পেরই অঙ্গীকার; এ‍‌ই সংকল্প হলো সামাজিক পরিবর্তনের মারফত শ্রেণি বৈষম্যের বিলোপ সাধন করা এবং এইভাবে শ্রেণি বৈষম্যের বিলোপের মাধ্যমে সকল জাতির শান্তির পথে, আন্তর্জাতিক শান্তির একমাত্র সড়কে পদার্পণ করা।’’ মে দিবসের সূচনা একটা দেশের ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিকে কেন্দ্র করে কিন্তু শ্রমিকশ্রেণির কাছে তা পরিণত হয় আন্তর্জাতিক সংহতির দিবস হিসাবে এবং মজুরি দাসত্বের অবসান ঘটানোর সংগ্রামের শপথে।

লেনিন রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে মে দিবসের এই তাৎপর্যই তুলে ধরেছিলেন। ১৯০১ সালে তিনি লেখেন, ‘‘৮ ঘণ্টা কাজের দিনের দাবি হচ্ছে সমগ্র সর্বহারার দাবি, যা তারা ব্যক্তিগত মালিকদের কাছে পেশ করে না, পেশ করে বর্তমান দিনের সমগ্র সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিনিধি হিসাবে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে, সমগ্র পুঁজিবাদী শ্রেণির কাছে, উৎপাদনের সমস্ত উপকরণের মালিকদের কাছে। ৮ ঘণ্টা কাজের দিনের দাবি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সোস্যালিস্ট আন্দোলনের সাথে সংহতির জন্য ঘোষণাপত্র। এই পার্থক্যটা আমাদের শ্রমিকদের বোঝাতে হবে, যাতে তারা যেন ৮ ঘণ্টা কাজের দিনের দাবিকে বিনা ভাড়ার রেল টিকিট বা দারোয়ানের কর্মচ্যুতির মতো দাবির পর্যায়ে নামিয়ে না আনে।’’ (মুখবন্ধ, খারকভে মে দিবস) লেনিন পেরেছিলেন রাশিয়ায় জনগণের মধ্যে এই তাৎপর্য নিতে যেতে। সংগঠন, আন্দোলন, রণনীতি ও রণকৌশল স্থির করতে, সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম গড়ে তুলতে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতে।

ভারতে আমরা

মার্কস-এঙ্গেলস, লেনিনের শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করার প্রক্রিয়া, ‘মে দিবস’-এর আহ্বান ভারতের শ্রমজীবী মানুষের কাছে নি‍‌য়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু হয় শতবর্ষ আগে। ১৯২০ সালে স্থাপিত হয় অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস। এআ‍‌ইটিইউসি’র প্রথম ইস্তাহারে ভারতের শ্রমিকদের কাছে আবেদন করা হয়, ‘‘কলেকারখানায় শ্রমিকদের শোষণ করাই পুঁজিবাদীদের একমাত্র লক্ষ্য। মানুষের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ আপনাদের লক্ষ্য হোক। আপনাদের সংগঠনের শক্তির উপরই আপনাদের মুক্তি নির্ভর করে। সেই সংগঠনের প্রতি অনুগত থাকুন। আপনাদের সমস্ত দুর্বলতা দূর করে ফেলুন এবং আপনারা নিশ্চয়ই ক্ষমতা এবং স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হবেন।’’ সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের উদ্যোগে ১৮২৩ সালে ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয় মাদ্রাজে। তখন দেশ ছিল ঔপনিবেশিক শাসনে। চলছিল ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের একটা ধারা হিসাবে এলো শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের ধারা। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে দেশ মুক্ত হয়। শ্রমজীবী মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জ্বল ভূমিকা গ্রহণ করে। দেশ ঔপ‍‌নিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হলো বটে, তবে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলো। ক্ষমতার হস্তান্তর হলো ব্রিটিশ শাসকদের হাত থেকে ভারতীয় বুর্জোয়া-জমিদার শ্রেণির প্রতিনিধিদের হাতে এবং সেটাই চলছে। তবে স্বাধীনতার পর সরকারের কাজে প্রগতিশীলতার যতটুকু ছাপ ছিল, বর্তমান সরকারের কাজে তা একেবারে উধাও। এই সরকারের কাজ স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্তসুলভ। সরকারের কাজে বিপন্ন দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয় সংহতি, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র।

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত করে সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রামের অন্যতম পুরোধা বি টি রণদিভে। দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে আরও প্রসারিত ও ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ১৯৭০ সালে স্থাপিত হয় সেন্টার অব ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস (সিআইটিইউ)। ইউনিয়নের প্রথম সম্মেলনে আলোচনার উপসংহারে রণদিভে বলেন, ‘‘ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে একথা ভুললে চলবে না যে, সমাজতন্ত্র এবং শোষণ থেকে মুক্তি কেবল কথার কথা হয়ে থাকবে যদি শ্রমিকশ্রেণি সচেতনভাবে ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম না করে এবং এই দিকে প্রথম পদক্ষেপ হবে বর্তমান বুর্জোয়া-জমিদার সরকারকে হটিয়ে প্রকৃত জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমান সরকারকে পরিবর্তনের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া, কৃষক সমাজের সঙ্গে মৈত্রীবদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম গড়ে তোলা ও তাতে অংশগ্রহণ করা, ভূমিবিপ্লব সম্পন্ন করার সংগ্রাম সমর্থন করা... এবং এই লক্ষ্য নিয়ে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তির একটা ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করা - এইগুলিই হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের জরুরি দায়িত্ব।’’ তিনিই সংগঠনের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন।

কিন্তু মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে পরিস্থিতি অনুযায়ী রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে কাজ করা যায় যদি তাহলে শ্রমজীবী মানুষ বিজয় অর্জন করে। কিছু দৃষ্টান্ত তো ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। এটা এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং সাফল্য-অসাফল্যের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়। সাফল্যে আত্মহারার যেমন অবকাশ নেই, তেমনি অসাফল্যে হতাশার স্থান নে‍‌ই। সেই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, সেই সমাজতান্ত্রিক শিবির নেই। কেন নেই, তার কারণ ইতিমধ্যে অনেকটা উদঘাটিত হয়েছে, আগামীদিনে আরও হবে।

কিন্তু পুঁজিবাদ স্বস্তিতে নেই। জাতীয় লগ্নিপুঁজি থেকে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি, সাম্রাজ্যবাদী-বিশ্বায়ন, নয়া-উদারবাদ, উৎপাদনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে পুঁজির বিনিয়োগ পুঁজিবাদকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না। কর্মসংস্থান বাড়ছে না, বাজারে মন্দা কাটছে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ২০০৮ সালে সৃষ্ট সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। ধনবৈষম্য বাড়ছে, মানুষের অসন্তোষ বাড়ছে। এই অসন্তোষকে দক্ষিণপন্থী শক্তি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছে। ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বাড়ছে। অথচ সম্ভাবনা তো শ্রমজীবী মানুষেরই। তাই শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য ও সংগ্রাম খুবই জরুরি। এই কাজ করায় আন্তরিক হওয়া আবশ্যিক। এই কাজে উদ্দীপিত হওয়ার মধ্যেই রয়েছে ২২ এপ্রিল, ১ মে, ৫ মে-র বি‍‌শেষ গুরুত্ব। ১৮৪৮ সালে মার্কস-এঙ্গেলস-এর আহ্বান - সকল দে‍‌শের শ্রমজীবী মানুষ এক হও! তাই আজও জীবন্ত এবং আগামীদিনেও জীবন্ত থাকবে।