E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৯ সংখ্যা / ১৪ অক্টোবর, ২০২২ / ২৭ আশ্বিন, ১৪২৯

নিয়োগ দুর্নীতির শিকার শিক্ষক ও বঞ্চিতদের অবস্থান আন্দোলনের পাশে সিপিআই(এম)-বামফ্রন্ট সহ বিভিন্ন গণসংগঠন


নিজস্ব প্রতিনিধিঃ এসএসসি-টেট সহ গ্রুপ-ডি স্তরের বিভিন্ন পদের পরীক্ষায় পাশ করে তালিকাভুক্ত কিন্তু নিয়োগ বঞ্চিতদের লড়াই এবং অবস্থান আন্দোলন পেরিয়ে গেল ৫৭০ দিন। রাজ্য সরকারের অপদার্থতায় পরপর দু’বছরেও পুজোতে ওঁদের ঠিকানার পরিবর্তন হলো না। খোদ শিক্ষামন্ত্রী সহ শিক্ষা দপ্তরের রথী-মহারথীসহ সদ্য প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তরের চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্য গ্রেপ্তার হয়েছেন, তবু সরকার দুর্নীতির দায় স্বীকার করছে না। ইদ থেকে শারদ উৎসবের হাজার হাজার ওয়াটের আধুনিকতম আলোও ওঁদের জীবনের আঁধার ঘোচাতে পারছে না। হাসি ফোটাতে পারল না ওঁদের সন্তানদের মুখেও। রাজ্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রীর তরফে প্রতারণা এবং ভুয়ো প্রতিশ্রুতি ছাড়া জোটেনি কিছুই। উলটে মুখ্যমন্ত্রী চাকরি বিক্রির এই চক্রের কথা জানতেন - তদন্তের ভিত্তিতে উঠে আসছে এমন খবরও। এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের চাপে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি যোগ আরও বেআবরু হয়েছে। একের পর এক তৃণমূল নেতা, মন্ত্রী থেকে আমলা-বিধায়করা এখন আদালতের রায়ে জেলে। উৎসবের দিনগুলিতে তাঁদের অবস্থান আন্দোলনস্থলে গিয়ে এই নির্ণায়ক লড়াইয়ের পাশে থাকার বার্তা দিল সিপিআই(এম)সহ বামফ্রন্ট এবং বিভিন্ন বামপন্থী গণসংগঠন। আর কার্নিভালের জাঁকজমকে কালো দাগ লেগে যাবার আতঙ্কে মমতা ব্যানার্জির সরকার কাপড়ের ঘেরাটোপে ঘিরেও শেষে অগণতান্ত্রিকভাবে তুলে দিল ওদের।

কলকাতা ময়দানে গান্ধীমুর্তি এবং মাতঙ্গিনী হাজরার মুর্তির নিচেই ওঁদের অবস্থান আন্দোলন চলছে পুলিশ ও প্রশাসনের নিয়মিত নজরদারি আর চোখ রাঙানির মধ্যেই। মাঝেমধ্যেই জুটছে তুলে দেবার হুমকি। তা সত্ত্বেও অনড় ওরা। এসএসসি-এসএলএসটি থেকে মমতা ব্যানার্জির সদর দপ্তর খোদ নবান্নের পারসোনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিফর্মস দপ্তর, টেট, আপার প্রাইমারি - সর্বত্র দুর্নীতি আর অনিয়মের চাঞ্চল্যকর অভিযোগ। বঞ্চনার সেসব অভিযোগ নিয়েই ওঁদের আন্দোলন আদালতে এবং জনআদালতে। নিয়োগ পরীক্ষায় সফল এই হবু শিক্ষকরা রাইট টু এডুকেশন ফোরাম-এর আধ্যাপক প্রতিনিধিদের, সিপিআই(এম)রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এবং বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর কাছে রাগ আর চাপা কান্নার মিশেলে উগড়ে দিলেন তাঁদের প্রতি সীমাহীন বঞ্চনার কথা। প্রতিকার পরিত্রাণ চাইলেন এই দীর্ঘ অনিশ্চয়তা থেকে।

৩ অক্টোবর নিয়োগ বঞ্চিত এসএসসি সহ শিক্ষকতার বিভিন্ন পরীক্ষায় পাশ করা প্রকৃত যোগ্য নথিভুক্ত শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা এবং সংহতি জানিয়ে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অবস্থানস্থলে বলেন, হকের দাবি আদায়ের আন্দোলনের সঙ্গে আমরা আছি, যতদিন আপনারা লড়াইয়ে থাকবেন। এই উৎসবের দিন আমি আপনাদের সঙ্গে কাটাব, আপনাদের দাবির কথা শুনব বলে আজ আবার এসেছি। রাজ্য সরকারের ৬ লক্ষ পদ ফাঁকা। রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার দুই সরকারের দপ্তরগুলিতেই লক্ষ লক্ষ পদ ফাঁকা কেন। কেন চুরিতে পারদর্শী লোকেরা সরকার চালাচ্ছে। সরকারের কাজ উৎসব করা নয় স্কুল চালানো, ঠিকমতো পরীক্ষা নেওয়া, যোগ্যদের চাকরি দেওয়া। যোগ্য এবং মেধাসম্পন্নদের সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করার মানে হলো গরিব এবং প্রান্তিক মানুষের বাঁচার এবং ওপরে ওঠার সিঁড়ি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, চারিদিকে যখন জাত-পাতের ধর্মের নামে বিভাজন করা হচ্ছে তখন আপনারা উৎসবের সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে উদাহরণ তৈরি করছেন। আপনাদের ন্যায্য দাবির সঙ্গে আছি। পরের প্রজন্মকে যাতে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি না হতে হয় তাই দুর্নীতির তন্ত্রটাকে ভাঙতে হয়। সেই লড়াই চলবে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মহম্মদ সেলিম বলেন, যোগ্যতা মেনে যদি এই সরকার চলতো তাহলে আজকে যাদের স্কুলে থাকার কথা, চাকরি করার কথা, মাইনে নিয়ে পোশাক আশাক কিনে পরিবার পরিজনদের সঙ্গে পূজা উদযাপন করার কথা, তাদের রাস্তায় বসে থাকার কথা নয়। যারা লুটতন্ত্র করল তারাই কার্নিভালের জন্য প্যান্ডেল বানাচ্ছে। অনেকে বলেন ‘উনি’ এসব জানেন না। পার্থ চোর কী অমুক চোর। কিন্তু চোরেদের যে সিন্ডিকেট আছে তার মাথায় মুখ্যমন্ত্রী আছেন।

আন্দোলনকারীদের বাধা এবং হুমকি দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই সরকার চায়না কেউ সংগ্রাম করুন, মিছিল করুক মিটিং করুন, প্রতিবাদ করুন। এমনকী কেউ সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে রায় দিক সেটাও চায় না এরা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, নিয়োগ পরীক্ষার উত্তরপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, আর এখন প্রতিদিন ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আদালতে লড়াই হবে,জন আদালতেও লড়াই হবে। তবেই এই সরকারকে সরতে বাধ্য করা যাবে।

রাইট টু এডুকেশন ফোরামের পক্ষ থেকে ৩ অক্টোবর গান্ধী মূর্তি এবং মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি স্থলে গিয়ে নিয়োগ বঞ্চিতদের প্রতি সহমর্মিতা জানান রাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা।

তাঁরা বলেন, এই লড়াইটা আপনাদের চালিয়ে যেতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপনাদের লড়াইয়ের জন্যই যারা আপনাদের নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করেছেন সেই রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরের নিয়োগকর্তারা এবং প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী আজকে জেলে। আপনাদের এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না দাবি পূরণ হচ্ছে। আমরা আপনাদের পাশে আছি।

সংগঠনের পক্ষ থেকে উৎসবের দিনকে মনে রেখে নিয়োগ বঞ্চিতদের হাতে খাবারের প্যাকেট তুলে দেওয়া হয়। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে নিয়োগ বঞ্চিতদের প্রতি সংহতি জানাতে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক মহালয়া চ্যাটার্জি, ঈশিতা মুখার্জি, নন্দিনী মুখার্জি, শুভোদয় দাশগুপ্ত, শ্যামল চক্রবর্তী প্রমুখ।

বামফ্রন্ট এবং সিপিআই(এম) নেতৃত্বকে সামনে পেয়ে বহু তরুণ তরুণী আবেগ উদ্বেল হয়ে পড়েন। সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে যাঁরা এই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন সেই মায়েরা বলেন, উৎসবের দিনে পরিবারের সঙ্গে বাড়িতে না থাকতে পারার যন্ত্রণার কথা। তুলে ধরেন জীবনের ৭ থেকে ৮ বছর মেধা এবং যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সংসারের পাশে দাঁড়ানোর প্রশ্নে চাকরি পেয়েও তাতে যোগ দিতে না পারার হাহাকারের কথা। নেতৃবৃন্দ এবং গণসংগঠনের সমব্যথীরা শোনেন সেসব কথা।

বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু ৫ অক্টোবর আন্দোলনরত শিক্ষকদের অবস্থানস্থলে গিয়ে বামফ্রন্টের সব শরিক দলের পক্ষ থেকে এই লড়াইকে সংহতি জানান। তিনি বলেন, আপনাদের জীবনের ৬ বছর নষ্ট করা হলো। আপনারা দীর্ঘ লড়াই করছেন। পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তালিকায় নাম ছিল, কিন্তু নিয়োগপত্র পাননি। ২০১৯ সালে প্রেস ক্লাবের সামনে আপনাদের আন্দোলনে আমরা বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে সমর্থন জানাতে এসেছিলাম। তার তিনদিন পরে মুখ্যমন্ত্রী আপনাদের কাছে গিয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে দেখার। বলেছিলেন, আপনারা প্রত্যাহার করুন বিক্ষোভ অবস্থান। আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু তখন আমরা জানতাম না টাকার বিনিময়ে চাকরিগুলো বিক্রি হচ্ছে। কে দায়ী কারা দায়ী এসব প্রশ্ন এখন এসে হাজির হয়। আপনাদের আন্দোলনকে আমরা অভিনন্দন জানাচ্ছি। আপনারা উৎসবের দিনে বঞ্চিত হচ্ছেন উৎসবের আনন্দে শামিল হওয়া থেকে। আপনাদের কেউ কেউ চোখের জল ফেলছেন। বাংলায় অধিকারের দাবিতে এত দীর্ঘ লড়াই অতীতে আগে কখনো দেখিনি। বাংলার আন্দোলন সংগ্রামে এক নয়া ইতিহাস লিখছেন আপনারা।

বামফ্রন্ট প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে এদিন বিমান বসুর সঙ্গে নটি বিভাগের নিয়োগ বঞ্চিতদের সঙ্গে দেখা করেন সিপিআই রাজ্য সম্পাদক স্বপন ব্যানার্জি, সিপিআই(এম) নেতা রবীন দেব, সহ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ, কলতান দাশগুপ্ত, আরএসপি নেতা অশোক ঘোষ, মার্কসবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকের জয়হিন্দ সিং, ফরোয়ার্ড ব্লকের বাংলা কমিটির সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জি প্রমুখ।

এদিন বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে মিষ্টির প্যাকেট তুলে দেওয়া হয় আন্দোলনকারীদের হাতে।

১১ অক্টোবর এবিটিএ’র এক প্রতিনিধি দল ময়দানে আন্দোলনরত হবু শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করে তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানান।