৬০ বর্ষ ৯ সংখ্যা / ১৪ অক্টোবর, ২০২২ / ২৭ আশ্বিন, ১৪২৯
চেতনাকে আরও শানিত করল শারদীয়া বুক স্টল
অর্ণব ভট্টাচার্য
পশ্চিমবঙ্গে শারদোৎসবের দিনগুলির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বামপন্থীদের প্রগতিশীল বইয়ের স্টল। ১৯৫২ সালে প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফ্ফর আহম্দ যে ট্রাডিশনের সূত্রপাত করেছিলেন তা এখনো বহমান। এবছর রাজ্যে কেবলমাত্র সিপিআই(এম)’র উদ্যোগেই ১৩০০-র বেশি বুক স্টল হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় শ'দুয়েক বেশি। শিলিগুড়িতে পাহাড়ের তলদেশেই হোক কিংবা সাগর সংলগ্ন পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী এলাকায় অথবা কলকাতা মহানগরীর উত্তাল জনকল্লোলে আলোড়িত রাজপথের পাশে কিংবা শাল-মহুয়ার ছায়াঘেরা পুরুলিয়ায়, এমনকী এক সময়ে মাওবাদী ও তৃণমূলের হিংস্র সন্ত্রাস কবলিত ঝাড়গ্রামের বাঁশপাহাড়ি - সর্বত্রই মার্কসীয় সাহিত্য সহ শিশু-কিশোর সাহিত্য, ইতিহাস-বিজ্ঞান-রম্যরচনা-ভ্রমণ কাহিনি ইত্যাদি রকমারি সম্ভার নিয়ে হাজির থাকেন এ রাজ্যের প্রগতিশীল বামপন্থী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হাজার হাজার কর্মী। আনন্দ-উচ্ছ্বাস-বিনোদনের সাথে জ্ঞানচর্চার এই সাবলীল সহাবস্থান বাঙালির অন্যতম জনপ্রিয় পার্বণে নিঃসন্দেহে বাড়তি মাত্রা যুক্ত করে। তাছাড়া বাৎসরিক এই আনন্দ উৎসবের সময় লাল শালুতে মোড়া স্টলগুলো হয়ে ওঠে মণ্ডপমুখী জনতার সাথে গণআন্দোলনের সংগঠকদের নিবিড় যোগাযোগের ক্ষেত্র।
চেতনায় শান দেওয়ার এই সংগঠিত আয়োজনকে নিয়ে দক্ষিণপন্থীদের বরাবরের গাত্রদাহ। আর এখন তা কেবলমাত্র তির্যক মন্তব্য বা বাঁকা হাসিতে থেমে নেই। প্রশাসনিক অসহযোগিতার সাথে সাথে হুমকি ও হামলার ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে এ'বছর শারদোৎসবে এমন কিছু নিন্দনীয় ঘটনার সাক্ষী থাকল আমাদের রাজ্য।
২০০০ সাল থেকে একটানা মালদা শহরের ফোয়ারা মোড়ের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মার্কসবাদীদের বুক স্টল হয়। এ'
বছর যথারীতি নিয়ম মেনে পৌরসভার কাছে আবেদনপত্র জমা করা হলেও রাজনৈতিক বৈরিতার বশবর্তী হয়ে স্টলের স্থানটি এমন একটি জায়গায় বদল করে দেওয়া হয় যেখানে জনসমাগম হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই অন্যায় ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের প্রতিবাদে ব্যাপক সংখ্যক পার্টিকর্মী ও পার্টিদরদিরা সমবেত হন এবং পূর্ব নির্ধারিত স্থানে রাস্তার ওপর বুক স্টল উদ্বোধন করা হয়। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে চার দিন বুক স্টল চলে। তবে কেবলমাত্র প্রশাসনিক অসহযোগিতা নয়, গুন্ডামি করে স্টল বন্ধ করবার চেষ্টা হয়েছে রাজ্যের বেশ কয়েকটি জায়গায়। পয়লা অক্টোবর হাওড়ার শিবপুরে চ্যাটার্জিহাট বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন আয়োজিত বুক স্টলে হামলা চালায় শাসকদলের গুন্ডাবাহিনী। স্টলে টাঙানো ব্যানারে লেখা ছিল ‘আমরা চাকরি বিক্রি করি না - বই বিক্রি করি’। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে থাকা তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীদের আঁতে ঘা লাগায় তারা স্টল চুরমার করে দেয়। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা কাটার আগেই ওই একই জায়গায় যুব ফেডারেশনের কর্মীরা প্রতিবাদ সভা করে পুনরায় স্টল চালু করে। বামপন্থী কর্মীদের জেদ ও মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে আর ধারে কাছে ঘেঁষতে সাহস দেখায়নি শাসকদলের দুর্বৃত্তরা।
দুর্নীতির একের পর এক অভিযোগে জেরবার শাসক দলের নেতাদের জেল যাত্রায় রাজ্যজুড়ে কোণঠাসা তৃণমূলীরা এ বছরে কলকাতা মহানগরীতেও প্রবল আক্রোশ থেকে বুক স্টলের ওপর হামলা চালিয়েছে। রাসবিহারী এলাকায় রাজা প্রতাপাদিত্য রোডে সিপিআই(এম)-এর পক্ষ থেকে আয়োজিত মার্কসীয় ও প্রগতিশীল সাহিত্য বিক্রয় কেন্দ্রে সপ্তমীর রাতে মদ্যপ তৃণমূল কর্মীরা হামলা চালায়। এই স্টলে ‘চোর ধরো, জেল ভরো’ ব্যানার দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে যায় শাসকদলের লুম্পেন বাহিনী। এক্ষেত্রেও প্রতিরোধে শামিল হন পার্টি কর্মী-সমর্থকরা। অষ্টমীর দিন বিকেলেই আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় আসা জনতার ওপর তৃণমূলীরা হামলা করতে এলে পালটা প্রতিরোধে দুর্বৃত্তরা পিঠটান দিতে বাধ্য হয়। এই সময় দুষ্কৃতীদের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে পুলিশ প্রশাসন। স্টলের উপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করার বদলে সভায় উপস্থিত পার্টির জেলা সম্পাদক কল্লোল মজুমদার সহ অন্যান্য পার্টিনেতৃত্ব এবং বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার কমলেশ্বর মুখার্জিকে গ্রেফতার করা হয়। তৃণমূল কংগ্রেস এবং পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে তীব্র প্ররোচনামূলক পদক্ষেপের পরেও স্টলের কাজ বন্ধ থাকেনি। পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, বিশিষ্ট আইনজীবী ও রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে শাসকদলের হামলা ও পুলিশের দলদাসত্বের তীব্র নিন্দা করেন। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হন এবং অশোক কুমার গাঙ্গুলি, অর্ধেন্দু সেন, রাজা সেন, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, অনীক দত্ত, চন্দন সেন, অম্বিকেশ মহাপাত্র, শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার, শুভেন্দু মাইতি সহ সৃজিত মুখোপাধ্যায়, ঋত্বিক চক্রবর্তী প্রমুখ রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সরকারের এই ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে তাঁদের অসন্তোষ প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেন। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটাতেও পার্টি পরিচালিত বুক স্টলে ভাঙচুর চালিয়ে বানচাল করার চেষ্টা করে তৃণমূলের দুর্বৃত্তরা, যদিও তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। রাজ্যের নানা জায়গায় এহেন হুমকি, হামলার বিরুদ্ধে পার্টিকর্মীরা যেমন প্রশংসনীয় দৃঢ়তা ও প্রতিরোধের মনোভাব দেখিয়েছেন, তেমনই জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন মিলেছে। এছাড়াও রাজ্যের নানা জায়গায় অনেক প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে বুকস্টলের আয়োজন করেছেন পার্টি ও গণসংগঠনের কর্মীবৃন্দ।
উৎসবের মাঝেও এই সমস্ত হুমকি, হামলা দক্ষিণপন্থীদের প্রগতিশীল সাহিত্যের প্রতি তীব্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। এরাজ্যে আরএসএস-র কর্মীরা তৃণমূলীদের সুরে সুর মিলিয়ে বলেছে শারদ উৎসবের সময় বইয়ের স্টল কেন? আসলে সমাজে যুক্তিতর্কের সংস্কৃতি লালিত হোক এবং চেতনার উন্মেষ ঘটুক, তা চায়না এইসব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। এদের মতাদর্শগত অনুপ্রেরণা আসে যে ফ্যাসিস্ট রাজনীতি থেকে, তার কুশীলবরা আজ থেকে প্রায় নব্বই বছর আগে ১৯৩৩ সালের ১০ মে জার্মানির রাজধানী বার্লিন শহরে প্রায় পঁচিশ হাজার বই পুড়িয়ে ছারখার করেছিল। কার্ল মার্কস, কার্ল কাউটস্কি, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, হেলেন কেলার, এমনকী রবীন্দ্রনাথ সহ বিভিন্ন প্রখ্যাত দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সমাজতত্ত্ববিদ, সাহিত্যিকদের বই ওরা নির্বিচারে পুড়িয়ে ফেলে। এরপর কয়েক মাস ধরে জার্মানির বিভিন্ন শহরে এই বহ্ন্যুৎসব চলেছিল। যে সমস্ত বই নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের দর্শনের সরাসরি বিরোধিতা করে সেগুলি তো বটেই, কোনোরকম যুক্তিবাদী, বৈজ্ঞানিক, মুক্তচিন্তার বার্তাবাহী বইকে রেয়াত করেনি সে সময়ের ফ্যাসিস্ট জল্লাদ বাহিনী। আজকে তাদের উত্তরসূরিরা সবুজ-গেরুয়া জামা পড়ে এই ভয়ঙ্কর সংস্কৃতি আমদানি করতে চাইছে। আমাদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে যে, ১৯৯৮ সালের ৩১ অক্টোবর, তৃণমূল কংগ্রেসের বয়স যখন মাত্র দশ মাস, তখন হুগলির খানাকুলের বলপাইতে এই দলের আশ্রিত দুর্বৃত্তরা একটি পাঠাগার পুড়িয়ে দিয়েছিল। পুনেতে ভান্ডারকর লাইব্রেরি পোড়ানো আরএসএস এই তৃণমূলেরই স্বাভাবিক মিত্র।
এখন তৃণমূল বাইশ বছরের লুম্পেন। তার হাতে সরকারি ক্ষমতা। আর সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজ্যে মনন-চর্চাকে বন্ধ করতে চাইছে । এর পাশাপাশি মানুষের যে বিপুল অংশগ্রহণ ঘটেছে বামপন্থীদের আয়োজিত স্টলগুলোতে তাতে তারা আতঙ্কিত। তৃণমূল কংগ্রেসের রক্তচাপ বাড়িয়ে বুক স্টলগুলি সফলভাবে আয়োজিত হয়েছে। আগামীদিনেও হবে। সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ের অন্যতম হাতিয়ার বইকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর লড়াই জারি থাকবে। ১৯৯৮ সালে আমরা স্লোগান দিয়েছিলাম ‘‘বই পোড়াতে নয়, পড়তে হয়।’’ এখন মানুষ বলছে ‘‘চোর ধরো, জেল ভরো, মার্কসবাদী বই পড়ো।’’