E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৯ সংখ্যা / ১৪ অক্টোবর, ২০২২ / ২৭ আশ্বিন, ১৪২৯

মার্কসবাদী চিন্তাবিদ রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের জীবনাবসান


নিজস্ব প্রতিনিধিঃ বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তাবিদ ও প্রাবন্ধিক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের জীবনাবসান ঘটেছে। ২ অক্টোবর নিউটাউনের চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে সকাল আটটা পঞ্চাশ মিনিট নাগাদ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাজ্য বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এবং সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। সহ সারস্বত জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

১৯৪৭ সালের ১০ ডিসেম্বর কলকাতায় তাঁর জন্ম। স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে তিনি ভরতি হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর কলেজে। কলেজ জীবনে তিনি ছাত্র সংগঠন বিপিএসএফ-এর সঙ্গে যুক্ত হন। পরে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে মৌলিক গবেষণা পর্বেই রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর প্রভাবেই ইংরেজি সাহিত্য থেকে তিনি দর্শনশাস্ত্রে মনোনিবেশ করতে শুরু করেন। তিনি ছিলেন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। পার্টি ভাগ হওয়ার পর সিপিআই-এর সদস্য থেকে যান। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি সিপিআই-তে ছিলেন।

ভারতীয় দর্শন, বিজ্ঞানের ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব, রাষ্ট্রনীতি, সাহিত্য সমালোচনা, সংক্রান্ত তার ৩০ টির উপর লেখা বই রয়েছে। লিখেছেন শিশুদের জন্যেও। গোটা জীবনে তাঁর যাবতীয় লেখা প্রকাশিত হয়েছে লিটল ম্যাগাজিনে। দ্বিশতাধিক মৌলিক প্রবন্ধ লিখেছেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। ২০০৭ সালে তিনি আনন্দমোহন কলেজ থেকে অধ্যাপনা জীবনের অবসর গ্রহণ করেন। অধ্যাপনা জীবনে ওয়েবকুটা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সক্রিয়ভাবে।

তিনি অকৃতদার ছিলেন। এনআরএস হাসপাতালে তাঁর দেহ দান করা হয়েছে।

স্মরণসভা

১১ অক্টোবর রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হলো কলেজ স্ট্রিটের বই -চিত্র গ্যালারিতে। ঘণ্টা তিনেক ধরে চলা এই স্মরণসভা আগাগোড়া ছিল ভিড়ে ঠাসা। নবীন এবং প্রবীণদের পাল্লা দেওয়া উপস্থিতি এদিন স্থিতধী হয়ে শুনল শম্পা ভট্টাচার্য, রতন খাসনবিশ, শোভনলাল দত্তগুপ্ত, শুভেন্দু সরকার, সুনীশ দেব, চিন্ময় গুহ, অভ্র ঘোষ প্রমুখের স্মৃতিচারণ। এই অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন আশিস লাহিড়ী।

সঞ্চালনার শুরুতেই আশিস লাহিড়ী বলেন, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের জীবনের বিস্তৃতি নয় বিশেষ কিছু দিক ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে এই সভায়। পরবর্তী তিন ঘণ্টায় বক্তারা সেই আহ্বানকে অনুসরণ করেই তুলে ধরলেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের স্কেচ।

অধ্যাপক রতন খাসনবীস তার স্মৃতিচারণে বলেন, ঐতিহাসিকভাবে নিজেকে মার্কসবাদী পার্টির অঙ্গ হিসেবে কিভাবে ভেবে নিতে পারেন একজন মানুষ সে কথার পূর্বাপর। বিশ্ববিদ্যালয় ঢোকার আগেই রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের তৈরি হয়েছিল মার্কসবাদী মনন।

চিন্তা চেতনায় এমন অনেক মার্কসবাদী আছেন যাঁরা ঝান্ডা হাতে পথে নামেন না। উলটে যারা নামেন তাদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করেন, প্রয়োগের প্রশ্নে তাঁরা ভিন্নমত হন। কিন্তু ওটাই আসল কাজ। আমার এবং রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের মিলের জায়গা এইটা যে, দল ছাড়া মার্কসবাদ-এর রাজনীতি করতে পারিনি বলে আমরা কষ্ট পেয়েছি। স্বাধীন মার্কসবাদী হিসেবে এই যাতনার জায়গাটাকে ধরে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য লিখেছেন বেশ কিছু লেখা। এ বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত লেখা ‘একটি সাইনবোর্ড চাই-ই’। দলে থাকাটা সবচেয়ে ভালো, দল না থাকলেও ঐতিহাসিকভাবে মার্কসের মতো মার্কসবাদী থাকা যায় কিছু প্রকরণ মেনে - লিখেছিলেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। তাঁর সমস্ত লেখার মতোই এই লেখাগুলো বেশি করে পড়া দরকার।

অধ্যাপক শোভনলাল দত্তগুপ্ত রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের সহপাঠী হিসেবে তুলে ধরলেন সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকার কথা। সাহিত্য সংস্কৃতিতে তাঁর ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য মূলত ছিলেন সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের মানুষ। সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে মার্কসবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে কীভাবে দেখা দরকার সে সম্পর্কে তাঁর পরিষ্কার অবস্থান ছিল।

অধ্যাপক শুভেন্দু সরকার তাঁকে বাংলার অন্যতম সেরা গদ্যকার হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ছিল ঈর্ষণীয় ঐতিহ্যবোধ এবং পরম্পরাবোধ।

অধ্যাপক চিন্ময় গুহ বলেন, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের জ্ঞান আকাঙ্ক্ষা ছিল অত্যন্ত তীব্র। তিনি ছিলেন একজন অ্যাকাডেমিক ইন্টেলেকচুয়াল। তাঁর ঘরে টাঙানো থাকতো স্তালিনের ছবি, তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন স্তালিনের প্রতি। কী করে কোনো লেখা নিখুঁতভাবে পড়তে হয় সেটা তাঁর কাছে শিক্ষণীয় ছিল।

সন্দীপন সেন অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের জীবনাবসানকে উল্লেখ করেন একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ক্ষতি এবং জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে সংকটের বিষয় হিসেবে। তিনি বলেন, তাঁর শিরদাঁড়া ছিল ঋজু। উচিত কথা বলতে তিনি পিছপা হতেন না।

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অভ্র ঘোষ তাঁর লেখার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন স্মরণসভায়।

তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুজ সুনীশ দেব তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন পঠন পাঠন সম্পর্কে নিখুঁত হওয়ার ওপর অধ্যাপক ভট্টাচার্য কতটা জোর দিতেন সেই বৃত্তান্ত। হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি লেখা সম্পর্কে মতবিনিময়ের সময় লেখাটির মান সম্পর্কে ছাত্র সুনিশ বিস্ময় প্রকাশ করলে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য কেমন অবলীলায় বলেছিলেন, ওর লেখা তো ভালো হবেই কারণ ও লাল ঝান্ডার লোক। এদিন স্মরণসভা থেকে এমনই বহু দিকের কথা জানল ঘরের ভেতরের জমায়েত এবং সোশ্যাল মিডিয়ার আওতায় থাকা অগণিত মানুষ।