E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৯ সংখ্যা / ১৪ অক্টোবর, ২০২২ / ২৭ আশ্বিন, ১৪২৯

কবি কৃষ্ণ ধরের জীবনাবসান


প্রবীণ কবি ও সাংবাদিক কৃষ্ণ ধরের জীবনাবসান হয়েছে ১২ অক্টোবর, বুধবার বিকালে। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি অসুস্থ ছিলেন ও উত্তর কলকাতার একটি নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এদিন বিকাল ৪টে ৫ মিনিটে সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বয়স হয়েছিল ৯৪। প্রয়াত কৃষ্ণ ধরের ইচ্ছানুসারে তাঁর মৃত্যুর পরেই চোখ দান করা হয়। এদিন তাঁর মরদেহ সংরক্ষিত রাখার পর ১৩ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পর গণদর্পণের মাধ্যমে তাঁর ইচ্ছানুসারে মরদেহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির জন্য ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দান করা হয়।

কৃষ্ণ ধরের প্রয়াণে শিল্প সাহিত্য জগৎ ও বামপন্থী আন্দোলনের নেতৃত্ব গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। উত্তাল গণসংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর সাহিত্য চর্চা এবং সাংবাদিকতায় অবদান। স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে তিনি সেই ধারায় সক্রিয় ছিলেন। তাঁর স্ত্রী প্রয়াত হয়েছেন কয়েক বছর আগেই, তাঁর দুই কন্যা বর্তমান।

ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন কবি কৃষ্ণ ধর। বিমান বসু গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছেন, কাকাবাবুর সঙ্গে কৃষ্ণ ধরের যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা ছিল এবং তখন থেকেই বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ। সেই সময় থেকে তিনি শুধু কাব্যজগতেই নয়, সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্র, সাংবাদিকতা ও অধ্যাপনার ক্ষেত্রেও অবদান রেখে গিয়েছেন। গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।

কবির প্রয়াণে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের রাজ্য সভাপতি পবিত্র সরকার ও সাধারণ সম্পাদক রজত বন্দ্যোপাধ্যায় এক শোকবার্তায় জানিয়েছেন, একালের বর্ষীয়ান কবি ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রগণ্য নেতা এবং সংগঠনের দীর্ঘকালের সহযোদ্ধা সভাপতি ও পথপ্রদর্শক ছিলেন তিনি। শিক্ষক সাংবাদিক সম্পাদক ও সর্বোপরি কবি হিসাবে চিরকাল গণমানুষের সহযাত্রী ছিলেন। সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর দীপ্ত প্রতিবাদী স্বর শোনা যেত।

ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গ’র রাজ্য সভাপতি হিরন্ময় ঘোষাল ও সম্পাদক দিব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় শোক বিবৃতিতে বলেছেন, কৃষ্ণ ধর ছিলেন কালের কণ্ঠস্বর। কবিতার মধ্য দিয়ে শোষিত নিপীড়িত মানুষের শ্রেণি সংগ্রামের কথা বলেছেন। এছাড়াও জনবাদী লেখক সঙ্ঘের রাজ্য সম্পাদক রামআহ্লাদ চৌধুরী, সারা ভারত শান্তি ও সংহতি সংস্থার পক্ষ থেকে অঞ্জন বেরা, গণশক্তি পত্রিকার সম্পাদক দেবাশিস চক্রবর্তী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক পীযূষকান্তি পাণিগ্রাহী প্রমুখ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি শোকজ্ঞাপন করেছেন কৃষ্ণ ধরের প্রয়াণে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন কৃষ্ণ ধর, পরবর্তীতে আটের দশকে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যাপনা ও গবেষণা পরিচালনাতেও ছাত্রদরদি শিক্ষক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ চালুর ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান ছিল।

অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার কমলপুর গ্রামে ১৯২৮সালের ১ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম। ছাত্রজীবনে নাম ছিল কৃষ্ণচৈতন্য ধর। পরবর্তীকালে তিনি কৃষ্ণ ধর নামেই সকলের কাছে পরিচিত হন। বাবা ছিলেন আইনজীবী। ১৯৪৩সালে গোটা বঙ্গদেশজুড়ে শুরু হয় কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। সেই বছরই কৃষ্ণ ধর কিশোরগঞ্জ মহকুমার বাজিতপুর হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। পরে চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজ ও পরে কলকতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কলেজ জীবন থেকেই রাজনীতির বই পাঠ করতে থাকেন। তাঁর কাব্যচর্চা ও লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবন থেকেই।

ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণ গড়ে ওঠে। উন্মেষ ঘটে রাজনৈতিক চেতনার। কলেজ জীবনে একই মেসে থাকতেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নীরদচন্দ্র চৌধুরী। আন্দামান ফেরত বিপ্লবী ইন্দুভূষণ দাস ও দীনেশ বণিকসহ নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার, ভূপেশ গুপ্ত এবং ত্রৈলোক্য মহারাজের প্রভাব ছাত্রজীবন থেকেই কৃষ্ণ ধরের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারে অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের সান্নিধ্য তাঁর মার্কসবাদী চিন্তার আরও বিকাশ ঘটায়।

কবি হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ এক উত্তাল সময়ে। তখন স্বদেশের মাটিতে শ্রমিক-মেহনতি মানুষের বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই। সেই সময় তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে ওই সময়ের মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা ও লড়াই-সংগ্রামের কথা। তেলেঙ্গানা আন্দোলনও তাঁকে নাড়া দেয়। এভাবেই ক্রমে পুষ্ট হয়েছে কৃষ্ণ ধরের কবিতার আবেগ। কখনো ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ, কখনো স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের ভারতীয় শাসক শ্রেণির শোষণ-নিপীড়নের ঘটনাগুলিও তাঁকে প্রভাবিত করেছে, তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কবিতায় সংগ্রামী মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কেন্দ্রিত হয়েছে সুগভীর সমাজ মনস্কতা নিয়ে। কবিতার বিপুল সম্ভার রয়েছে তাঁর। রয়েছে অসংখ্য কবিতা, কাব্য নাটক ও গদ্য সংকলন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলা আকাদেমি ২০০৪ সালে তাঁকে নজরুল স্মৃতি পুরস্কারে সম্মানিত করে। এছাড়াও তিনি মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ পুরস্কার, শিশিরকুমার পুরস্কার, সুধা বসু স্মৃতি পুরস্কার, পোয়েট্রি ইন্ডিয়া পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন।