E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৯ সংখ্যা / ১৪ অক্টোবর, ২০২২ / ২৭ আশ্বিন, ১৪২৯

লাল সেলাম কমরেড কোডিয়ারি

সীতারাম ইয়েচুরি


পলিট ব্যুরো সদস্য কমরেড কোডিয়ারি বালকৃষ্ণনের জীবনাবসান হয়েছে। তিন বছরের বেশি সময় ধরে তিনি বীরত্বের সাথে দূরারোগ্য ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেছেন। এই শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও এ সময়কালে, যেখানে গত কয়েক যুগের কেরালার নির্বাচনী ইতিহাসে কোনো ক্ষমতায় থাকা সরকারের ফের ক্ষমতায় না ফেরার ঘটনাকে নাকচ করে দিয়ে বিধানসভা নির্বাচনে এলডিএফ’ র অসাধারণ জয় অর্জনে তিনি প্রশংসনীয়ভাবে রাজ্য সম্পাদক হিসেবে কেরালায় পার্টিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর সাথেই তাঁর নেতৃত্বেই পার্টির রাজ্য কমিটি ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে কান্নুরে সিপিআই(এম)’র ২৩তম কংগ্রেস সংগঠিত করে। এত নিখুঁতভাবে এর আয়োজন হয়েছিল এবং সার্বিকভাবে সমস্তদিকে নিবিড় মনোযোগের ফলশ্রুতিতে সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে এবং কার্যকরভাবে ছদিন ধরে পার্টি কংগ্রেস তার কাজ পরিচালনা করতে পেরেছে। পার্টি কংগ্রেসের সমাপ্তি সমাবেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের অংশগ্রহণে কান্নুর শহর জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। এই সুবিশাল সমাবেশ রাজ্যে পার্টি কমিটিগুলির সামগ্রিক কাজকর্মেরই সাক্ষ্য বহন করেছে, যা এই ধরনের গণউদ্দীপনা তৈরি করেছিল।

ফের একবার এই জনসমুদ্র কান্নুরে প্রত্যক্ষ হয়েছে গত ৩ অক্টোবর, যেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ শোকতপ্ত মনে তাদের প্রিয় নেতার শেষযাত্রায় শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন।

ইস্পাতদৃঢ় সংগ্রামী

আমি যখন এসএফআই-তে যুক্ত হই সেই ১৯৭৩-৭৪ সালে কমরেড কোডিয়ারি কেরালা এসএফআই’র সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৯ সালে এসএফআই’র তৃতীয় সর্বভারতীয় সম্মেলন পর্যন্ত তিনি এদায়িত্ব পালন করেন। ওই সর্বভারতীয় সম্মেলনে আমি যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম। এই সময়েই কেরালায় সবচেয়ে জঙ্গি ও শক্তিশালী বামপন্থী ছাত্র সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এসএফআই। ১৯৭৫ সালে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারির সাথে সাথেই কুখ্যাত মিসা (এমআইএসএ) আইনে কমরেড কোডিয়ারি গ্রেপ্তার হন। জরুরি অবস্থা পরাভূত হওয়ার সময় পর্যন্ত আঠারো মাস তিনি জেলে ছিলেন। কেরালায় পার্টির নেতৃত্বে জরুরি অবস্থার প্রতিরোধ এবংএই লড়াইয়ে এসএফআই’র গৌরবজনক ভূমিকা লিপিবদ্ধ আছে। এবং আগামীদিনে সেই লড়াইয়ের ইতিহাসে আরও অনেক তথ্য যুক্ত হবে।

অননুকরণীয় গুণাবলি

কমরেড কোডিয়ারির জীবন এবং কাজের অসংখ্য গুণাবলির মধ্যে তিনটি বিষয়কে তুলে ধরা খুবই জরুরি। এইগুলিকে শুধু কেরালা নয়, সারা ভারতের বর্তমান কমিউনিস্ট প্রজন্মের অনুকরণ করা দরকার। প্রথমত, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিপ্লবী তত্ত্বের প্রতি তাঁর দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা। এই মতাদর্শিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধতাই কমরেড কোডিয়ারির ব্যক্তিত্বকে গড়ে তুলেছিল। সমস্তরকম বিচ্যুতির বিরুদ্ধে তিনি সচেতনভাবে লড়াই করেছেন। তিনি মনে করতেন, সাফল্য অর্জনে কোনো শর্টকাট পথ নেই। আন্দোলন সংগ্রাম এবং মতাদর্শের প্রতি এই দৃঢ়তা থেকেই তিনি বুঝেছিলেন, চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়েই সমস্ত শোষণ থেকে মুক্ত সমাজ নির্মাণ।

দ্বিতীয়ত, কমরেড কোডিয়ারির জীবনে আরেকটি গুণ হলো তাঁর অসম্ভব সাহস। তিনি সাহসিকতার সাথে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারতেন।অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থার সময় তীব্র পুলিশি নির্যাতন ও স্বৈরাচারী আক্রমণ এবং পরবর্তী সময়ে আরএসএস’র মতো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির আক্রমণ কমরেড কোডিয়ারিকে কেরালা জুড়ে গণকার্যক্রমসমূহের পরিকল্পনা তৈরি করা, তাকে সংগঠিত করা ও নেতৃত্ব দেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এইসব কার্যক্রমের মধ্যদিয়েই শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে কাজ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের আদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, সাম্প্রদায়িক সংহতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে কেরালা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এবং মানবোন্নয়ন সূচকগুলিতে দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে কেরালায় এক ব্যতিক্রমী সমাজ নির্মিত হয়েছে।

তৃতীয়ত, কমরেড কোডিয়ারির এক অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল। তিনি যৌথ কার্যক্রম এবং ব্যক্তিগত দায়িত্বের সাংগঠনিক নীতিকে সবসময় ঊর্ধ্বে তুলে ধরতেন। এই অনুশীলন শুধু পার্টি সংগঠনকেই শক্তিশালী করেনি, আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, তা কেরালায় জনগণের সঙ্গে পার্টির সম্পর্ককে মজবুত করেছে।

উপরের বিষয়গুলি এবং আরও অন্যান্য কারণে কমরেড কোডিয়ারির চলে যাওয়া বিপ্লবী আন্দোলনের কাছে এক বড়ো ক্ষতি। শেষযাত্রায় লক্ষ লক্ষ জনতা শোকপ্রকাশের সাথেই তারা এই ঐতিহ্য ও কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তা পার্টিকে আগামীদিনে আরও শক্তিশালী করবে।

গত ২৮ আগস্ট কমরেড প্রকাশ কারাতের সাথে আমি পার্টির রাজ্য কমিটির সভায় উপস্থিত থাকার সময়েই আসা কমরেড কোডিয়ারির মেডিকেল রিপোর্টে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতির বিষয়টা ছিল। পলিট ব্যুরো সদস্য ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কমরেড পিনারাই বিজয়নের সাথে আমি কমরেড কোডিয়ারি ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে তাঁদের বাড়ি যাই। আমরা কমরেড কোডিয়ারির আরও ভালো চিকিৎসা ও পরিচর্যার জন্য তাঁকে চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার পরামর্শ দিই। সবসময়ের পার্টির একজন একনিষ্ঠ সৈনিক কমরেড কোডিয়ারি চেন্নাইয়ে চিকিৎসার ব্যাপারে সম্মত হন এবং পরেরদিন সকালেই তাঁকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। গত একমাসের বেশি সময় ধরে এই দূরারোগ্য ব্যাধির সাথে হাসপাতালে তিনি লড়াই করেন। এক প্রাচীন প্রবাদে বলে, ‘‘নিঃশব্দে ক্যানসার বেড়ে চলে,’’ শেষপর্যন্ত এই ক্যানসারেই মৃত্যু ঘনিয়ে আসে।

কমরেড কোডিয়ারি বালকৃষ্ণন লাল সেলাম।

অনুবাদঃ শংকর মুখার্জি