E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৯ সংখ্যা / ১৪ অক্টোবর, ২০২২ / ২৭ আশ্বিন, ১৪২৯

অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী মন্দার ছায়া

সাত্যকি রায়


সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থার চলতি আর্থিক বছরের প্রথম কোয়ার্টারের তথ্য থেকে পাওয়া সাম্প্রতিক আর্থিক প্রবণতা বর্তমান সময়ের মূল আর্থিক সমস্যার থেকে পরিত্রাণের কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না। একথা ঠিক যে, আমাদের দেশের অর্থনীতি অতিমারী- পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে কিন্তু এই পুরনো ছন্দে ফেরার গতি যথেষ্ট কম। গত বছরের তুলনায় একই কোয়ার্টারে বৃদ্ধির হার ১৩.৫ শতাংশ হলেও, কোভিড- পূর্ববর্তী অবস্থার চেয়ে আমরা অল্পই এগোতে পেরেছি। ২০২০ সালে আমাদের দেশের জিডিপি যদি ১০০ টাকা হয়ে থাকে তবে ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে ১০৪ টাকায় পৌঁছেছে মাত্র। আর্থিক বৃদ্ধির প্রধান চালক এই মুহূর্তে নির্মাণ ক্ষেত্র ও পরিষেবা ক্ষেত্র। এই সব ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির হার দুই সংখ্যা অতিক্রম করলেও ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার মাত্র ৪.৮ শতাংশ। এর সাথে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো চাহিদার দিকে ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয় বা মানুষের পণ্য পরিষেবা কেনার পরিমাণ এখনো দ্রুতগতিতে বাড়ছে না। শহরাঞ্চলে ভোগব্যয়ে সাম্প্রতিককালে কিছুটা গতি পেলেও গ্রামাঞ্চলে এ প্রশ্নে আদৌ কোনো আশাব্যঞ্জক গতি দেখা যাচ্ছে না। এর একটা বড়ো কারণ হলো মুদ্রাস্ফীতি যা মানুষকে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে ব্যয় সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য করছে। এর সঙ্গে যেটা উল্লেখ করা দরকার তা হলো - খুচরো ব্যবসা, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি পরিষেবা ক্ষেত্রে উৎপাদন এখনো অতিমারীর আগের অবস্থাতেই ফিরতে পারেনি। যেহেতু দেশের অকৃষি কর্মসংস্থানের একটা বড়ো অংশই হয়ে থাকে খুচরো ব্যবসা ও ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে, তাই এই দুই ক্ষেত্রের ধীর বিকাশ কর্মসংস্থান সৃষ্টিকেও প্রভাবিত করছে। এর সাথে মনে রাখা দরকার যে, এই সময়কালে দেশের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪.৭ শতাংশ হারে, অথচ আমদানি বেড়েছে ৩৭.২ শতাংশ হারে। অর্থাৎ দেশের বহির্বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দ্রুতগতিতে বাড়ছে যা টাকার দামের উপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে। দেশের করপোরেটদের মুনাফার হার অতীতের তুলনায় কমছে যার প্রধান কারণ উৎপাদনের উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি। অতএব ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হার আগামীদিনে যথেষ্ট গতি পাবে এরকম সম্ভাবনা কম।

এ প্রসঙ্গে সারা পৃথিবীর অর্থনীতির বর্তমান সময়ের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা বিবেচনায় রাখা দরকার। প্রথমত, পৃথিবীর আর্থিক বৃদ্ধির হার সম্পর্কে অনুমান ক্রমাগত নিচের দিকে সংশোধিত হচ্ছে, অর্থাৎ আর্থিক বৃদ্ধি যে গতিতে ঘটবে বলে মনে করা হয়েছিল তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যৎ, মুদ্রাস্ফীতির অনুমান ক্রমাগত উপরের দিকে সংশোধিত হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য ও জ্বালানি সমন্বিত খরচ আগামীদিনে বাড়তে চলেছে। তৃতীয়ত, উন্নয়নশীল দেশগুলি যে ধরনের পণ্য রপ্তানি করে থাকে তার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমতে চলেছে, এবং চতুর্থত, সারা পৃথিবীতে পণ্য ও পরিষেবার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আয়তন যথেষ্ট কম এবং অচিরেই বিশাল পরিবর্তন হয়ে যাবে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। এই সবের প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই ভারতের অর্থনীতির উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এবং সে কারণেই দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার যা ২০২১ সালে ৮.৭ শতাংশ ছিল তা ২০২৩ সালে ৬.১ শতাংশে নেমে আসবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

একদিকে আর্থিক বৃদ্ধি যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক নয় আবার অন্য দিকে মুদ্রাস্ফীতির হার এখনো যথেষ্ট বেশি। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই মুদ্রাস্ফীতির হার আগামী বছরেও গড়ে ৭.৩ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। আমাদের দেশে আবার নতুন করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য সূচক ঊর্ধ্বমুখী। সর্বশেষ প্রাপ্ত সরকারি তথ্য অনুযায়ী আগস্ট মাসে ভোগ্যপণ্যের মূল্য সূচক (কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স) ৭.৫৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখযোগ্য হলো, খাদ্যশস্যর মূল্যবৃদ্ধির হার সাধারণ মূল্য সূচকের চেয়ে বেশি - ৯.৫৭ শতাংশ। শহরে এই হার ৮.৬৫ শতাংশ আর গ্রামাঞ্চলে ১০.০৮ শতাংশ। অর্থাৎ সাধারণভাবে এই পর্যায়ে গ্রামাঞ্চলে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বেশি। একইভাবে আগস্ট মাসের মূল্য সূচক অনুযায়ী সবজির দাম বেড়েছে ১৩.২৩ শতাংশ হারে আর মশলাপাতির দাম বেড়েছে ১৪.৯ শতাংশ হারে। খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়লে তুলনামূলক বিচারে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিব নিম্নবিত্ত মানুষ। কারণ তাদের আয়ের বেশির ভাগ অংশটাই খাবারের পেছনে খরচ হয়। মানুষের আয় যত বাড়তে থাকে তার মোট ভোগব্যয়ের মধ্যে খাওয়ার খরচ তত কমতে থাকে। ফলে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়লে ন্যূনতম বেঁচে থাকার জন্য খাবার ও আনুষঙ্গিক খরচের সংকুলান করা গরিব মানুষের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। মুদ্রাস্ফীতির বোঝা পুঁজিপতিরা সবসময় শ্রমজীবী মানুষের উপর চালান করার চেষ্টা করে থাকে। ধরা যাক, কোনো জিনিসের উৎপাদন খরচ বাড়ল। এবার জিনিসের দাম সরাসরি বাড়িয়ে দিলে জিনিসটি বিক্রির পরিমাণ কমে যেতে পারে। এর ফলে পুঁজিপতির মুনাফার পরিমাণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে পুঁজিপতি চাইবে বিক্রির দাম অল্প একটু বাড়ানো যেতে পারে যা বিক্রির পরিমাণে বিশেষ প্রভাব ফেলবে না। আবার অন্য দিকে শ্রমিকের মজুরি বা আয়ের অংশ কমিয়ে দিতে পারলে মালিকের মুনাফা অক্ষুণ্ণ থাকবে। আমাদের মতো দেশে যেখানে বেশির ভাগ মানুষের আয় মূল্য সূচক অনুযায়ী সুরক্ষিত নয় এবং বেশিরভাগ মানুষই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে থাকেন সেখানে মূল্যবৃদ্ধির বোঝা সহজেই শ্রমজীবী মানুষের উপর চালান করা সহজ হয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে যে কথাটি আরও বলা দরকার যে, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া দফায় দফায় ব্যাংক রেপো রেট বাড়িয়ে চলেছে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যে। এক্ষেত্রে সাধারণ যুক্তিটা হলো, সুদের হার বাড়িয়ে দিলে বাজারে মুদ্রার জোগান কমে যাবে, ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। একথা ঠিক যে, রেপো রেট বাড়ালে টাকার জোগান কমবে কিন্তু একথাও আধুনিক অর্থনীতিতে খেয়ালে রাখা দরকার যে, টাকাই একমাত্র আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম নয়, ক্রেডিট বা ভবিষ্যতে ধার শোধ করার নানা প্রকারের আর্থিক অঙ্গীকার টাকার মতোই ভূমিকা পালন করতে পারে ও করে থাকে। এগুলির কোনোটির উপর রেপো রেট বৃদ্ধির বিশেষ কোনো প্রভাব নেই। আর তার চেয়েও বড়ো কথা হলো সুদের হার বাড়ানোয় ধার যারা নেয় তাদের খরচ বেড়ে যাবে। যেহেতু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ অনেক কিছুই মাসিক কিস্তিতে ধারে জিনিস কিনে থাকে ফলে সুদ বাবদ তাদের খরচ বেড়ে যাবে। তাছাড়া এমনিই অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় সবেমাত্র ফিরতে শুরু করেছে, এর মধ্যে সুদের হার বাড়ার কারণে বিনিয়োগ প্রবণতা কমলে সংকট আরও গভীর হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। এর জন্য কর্মসংস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অর্থনীতিতে চাহিদার সংকট গভীরতর হয়ে উঠবে।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্থিক বৃদ্ধির হার উৎপাদনকে অতিমারী -পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরতে সাহায্য করলেও কর্মসংস্থানের বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই নিয়োগের সংখ্যা এখনো পর্যন্ত অতিমারী পরিস্থিতির আগের অবস্থায় ফিরে যায়নি তাকে ছাপিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, অল্প বয়সিদের ক্রমহ্রাসমান কর্মসংস্থানের হার। কোনো একটি দেশে ১৫-২৪ এই বয়সের ছেলেমেয়েদের কত অংশ শ্রম বাজারে উপস্থিত হচ্ছে, কতজন কাজে নিযুক্ত হচ্ছে তার উপর বৃদ্ধির গতি ও সম্ভাবনা অনেকটাই নির্ভরশীল। আমাদের দেশে ১৯৯৪ সালে এই অংশের যুবক-যুবতীদের মধ্যে কর্মসংস্থানের হার ছিল ৪৩.৪ শতাংশ যা বর্তমানে কমে হয়েছে ২৩ শতাংশ। ইয়োরোপে এই হার ৪২ শতাংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০.৬ শতাংশ, পাকিস্তানে ৩৮.৯ শতাংশ। যুব অংশের কর্মসংস্থানের হার কমে আসার ফলে যেটা লক্ষ করা যাচ্ছে তা হলো, শ্রমবাজারে কর্মপ্রার্থীর অংশ কমতে শুরু করেছে। এটা গভীর চিন্তার কারণ। আমরা আমাদের দেশের বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থাকে কাজে লাগাতে অক্ষম থাকছি। আমাদের দেশ বর্তমানে একটা বিশেষ পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে তা হলো, বর্তমানে আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে অল্পবয়সিদের অংশ বেশি। এটা যে কোনো দেশের জন্যই খুব সুবিধাজনক অবস্থা কারণ এই পর্যায়ে কর্মরত মানুষের সংখ্যা, অন্যের উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যার চাইতে বেশি হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। একে সাধারণভাবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড-এর পর্যায় বলা হয়। কিন্তু এই অবস্থার সুযোগ একটি দেশ কতটা নিতে পারবে তা নির্ভর করে, অল্পবয়সি কর্মক্ষম মানুষের কত বেশি অংশকে তারা কাজে নিয়োগ করতে পারবে। তা না পারলে অল্পবয়সিদের মধ্যেও আসলে নির্ভরশীল জনসংখ্যা বাড়তে থাকবে। আমাদের দেশে এই অংশের মানুষের মধ্যে কর্মসংস্থানের হার যেভাবে কমে চলেছে তা সত্যিই আশঙ্কার কারণ। আমরা এই বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থার কোনো সদ্ব্যবহার করতে পারছি না।

আর্থিক বৃদ্ধির ধীর গতি, দীর্ঘমেয়াদি মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারি জনজীবনে গভীর সংকট ডেকে আনছে। সরকার এই সমস্যার সমাধান করতে অক্ষম, তার কারণ তারা দেশের মানুষের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক পুঁজি ও করপোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। এবং একইসাথে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি নিয়ে মানুষের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধকে মোকাবিলা করতে চাইছে একদিকে গণতান্ত্রিক মতামতকে ধ্বংস করার মধ্যে দিয়ে আর অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মাধ্যমে। একে মোকাবিলা করেই দেশের মানুষকে নিজেদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে হবে।