E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৯ সংখ্যা / ১৪ অক্টোবর, ২০২২ / ২৭ আশ্বিন, ১৪২৯

ফিরিয়ে দাও বাম আমলের জনগণের পঞ্চায়েত

সুপ্রতীপ রায়


আমাদের রাজ্যে গ্রামের সংখ্যা প্রচুর। গ্রাম বাংলার উন্নয়নের উপর নির্ভর করে পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক উন্নয়ন। গ্রাম বাংলার উন্নয়ন কতটা হবে তা নির্ভর করে বাম আমলে চালু হওয়া ত্রিস্তর পঞ্চায়েত কেমন চলছে তার উপরে। ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব জনগণের পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠা। গত এক দশকের বেশি সময় রাজ্য পরিচালনা করছে তৃণমূল। মানুষের কাছে এটা স্পষ্ট বামফ্রন্টের সময় পঞ্চায়েত ছিল প্রকৃতই মানুষের পঞ্চায়েত। তাই মানুষ ফিরে পেতে চাইছেন বামফ্রন্টের সময়ের পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাকে। কেমন ছিল সে ব্যবস্থা? কেনই বা মানুষ বামফ্রন্ট সরকারের সময়কার পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাকে ভাল বলছেন?

পঞ্চায়েত আসলে স্থানীয় সরকার। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকার প্রয়োজন কারণ, গণতন্ত্রের প্রসার ঘটে। আর গণতন্ত্রের সঙ্গে উন্নয়নের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরে তৃণমূল স্তরে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফলে গ্রামগঞ্জে নাগরিকদের ক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। গ্রামে পরিষেবা প্রদানে অথবা অন্যান্য সরকারি কাজকর্মে ত্রুটি ঘটলে পঞ্চায়েতকে মানুষ নির্ভয়ে জবাবদিহি করতেন। সরকারের নিয়ন্ত্রকদের হাতের কাছে পাওয়ার ফলে জবাবদিহি চাওয়ার কাজটা অনেকটাই সহজতর ছিল। প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং উপযুক্ত ক্ষমতার অধিকারী স্থানীয় পঞ্চায়েতের প্রয়োজনীয়তা বামফ্রন্ট সরকার তুলে ধরতে পেরেছিল। ১৯৭৮ সালে প্রথম ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পঞ্চায়েতের হাতে উপযুক্ত ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল।

আমাদের রাজ্যে পঞ্চায়েত আইন তৈরি হয় ১৯৫৬ সালে। ওই বছরেই প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৬৩ সালে দ্বিতীয় বার আইন তৈরি ও নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু মানুষের কাছে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা ছিল অধরা। ১৯৭৩ সালে পঞ্চায়েতি আইনের কিছু সংশোধন করে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত গঠনের কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি, কংগ্রেসের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে। মৃতপ্রায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত হয় বামফ্রন্ট সরকারে আসার পর। ১৯৭৮ সালের ৪জুন ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

একথা বারংবার স্মরণীয় ১৯৭৭ সালে নবগঠিত বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকের পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ঘোষণা করেছিলেন, বামফ্রন্ট সরকার রাইটার্স বিল্ডিং থেকে পরিচালিত হবে না। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। আসলে মানুষের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা তুলে দিতে চেয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। যার মূল লক্ষ্য ছিল জনমুখী উন্নয়ন এবং টেকসই, স্থায়ী উন্নয়ন। ১৯৭৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন বন্ধ করার জন্য আইনি পথে হেঁটেছিল দুটি প্রধান দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল। যদিও সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। তিনটি স্তরে মোট ৫৫,৯৫২ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বামফ্রন্ট সরকারের অবস্থানকালে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।১৯৭৮, ১৯৮৩, ১৯৮৮, ১৯৯৩, ১৯৯৮, ২০০৩, ২০০৮। তৃণমূল সরকারের আসার পর ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে মামলা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।

বামফ্রন্ট সরকার নিছক কিছু সদস্য বা প্রধান বা ব্লক সভাপতি বা সভাধিপতি তৈরি করার জন্য পঞ্চায়েত নির্বাচন করেনি। রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের উপর গুরুত্ব দিয়েছিল। প্রকৃত অর্থে বামফ্রন্ট সরকার গ্রাম বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য পরিবর্তনের সংগ্রাম পরিচালনা করেছে। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা জমিদার, জোতদার, সামন্তপ্রভুদের শোষণ ব্যবস্থা ও কায়েমি স্বার্থকে আঘাত হেনেছিল। ফলে গ্রামীণ মানুষের আর্থিক,রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা বেড়েছিল। সরকার ও জনগণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা অনেকটাই কাটিয়েছিল বাম আমলের পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা। ফলস্বরূপ গ্রামীণ জনগণের মধ্যে সরকারি কাজে অংশীদারিত্ব ও দায়বদ্ধতার প্রসার ঘটেছিল।

গ্রামের প্রান্তিক অংশের মানুষ যাতে গ্রামীণ উন্নয়নে অংশীদার হতে পারেন তার জন্য ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে মহিলা এবং তপশিলি জাতি ও উপজাতি অংশের মানুষের জন্য আসন সংরক্ষণ চালু হয়েছিল। এর ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর অংশের মানুষ উন্নয়নের মূল স্রোতে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকে প্রত্যেক পঞ্চায়েত স্তরে সভাপতি ও সহ-সভাপতির পদগুলি তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি ও মহিলাদের জন্য একইভাবে সংরক্ষিত করা হয়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে কী বোঝায় তা পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পরিচালনার মধ্যে দিয়ে বামফ্রন্ট সরকার বুঝিয়েছে। গণতন্ত্রকে বলা হয়, আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে শাসনকার্য চালানো। বাম আমলে পঞ্চায়েতগুলি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারার ফলে উদ্ভূত কোনো সমস্যা সম্পর্কে মানুষ তাঁর মতামত প্রশাসনের কাছে তুলে ধরতে পারতেন। রাজ্য সরকারও তার কোনো নীতি রূপায়ণে জনগণের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা বুঝতে পারত। নিচ থেকে উপরে আবার উপর থেকে নিচে মতামতের এই ধরনের আদান প্রদানের ফলে গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াও মজবুত হয়েছিল।

বামফ্রন্ট সরকারের সময় পঞ্চায়েতগুলি গরিব মানুষের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গরিব আংশের মানুষ নির্বাচিত হয়েছিলেন। যাঁরা গরিবদের দিকে তাকিয়ে গ্রামের উন্নয়ন করেছিলেন। গ্রামে গরিবদের অনুকূলে শক্তির ভারসাম্য বদলাতে বামফ্রন্ট সরকারের সময় পঞ্চায়েত ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ যেমন করেছে, তেমনি গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে শ্রেণি সম্পর্কের ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করেছে। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনের মধ্যদিয়ে গ্রামীণ নেতৃত্বের মৌলিক পরিবর্তন হয়। ভূমিহীন,প্রান্তিক,ক্ষুদ্র কৃষক অংশের মানুষই বেশি পরিমাণে পঞ্চায়েতে নির্বাচিত হন। প্রথম পঞ্চায়েতের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে বর্গাদারদের শতকরা হার ছিল ১.৮ শতাংশ, ভূমিহীনসহ তিন একরের কম জমির মালিকের প্রতিনিধিত্ব ছিল ২১.৮ শতাংশ। দ্বিতীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় এটা বেড়ে বর্গাদারদের ক্ষেত্রে ৩.১৭ শতাংশ, ভূমিহীনসহ তিন একরের কম জমির মালিকের প্রতিনিধিত্ব ছিল ৩০.১৭ শতাংশ। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় দেখা গেল ৬১ শতাংশ সদস্য/সদস্যার বার্ষিক আয় ২৪ হাজার টাকার কম,২২.৭ শতাংশ ভূমিহীন, ৭.২ শতাংশ বর্গাদার কিংবা পাট্টা প্রাপক,৩৭.৩ শতাংশ এক একরের কম জমির মালিক, ২৪ শতাংশ মালিকানা ৩ শতাংশের কম। অর্থাৎ বামফ্রন্ট সরকারের নীতির ফলে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত গরিব মানুষের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। এক কথায় ‘‘অবদমিত মনুষ্যত্বের বিকাশ’’ ঘটেছিল। গরিব,পশ্চাদপদ মানুষের আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা বেড়েছিল।

একটা কথা প্রায়ই বিরোধীরা প্রচার করে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে পশ্চিমবঙ্গে নাকি কিছুই হয়নি। গ্রাম বাংলার উন্নয়নে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে কাজ হয়েছে তা ঐতিহাসিক।

‘‘...১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠার ফলে পঞ্চায়েত সম্পর্কে সরকারের ধারণার পরিবর্তন ঘটে। বামফ্রন্ট গ্রামীণ ক্ষেত্রে তিনটি কাজকে প্রাথমিক কর্তব্য হিসাবে গ্রহণ করেঃ

ক) পঞ্চায়েতগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করা; খ) গ্রামীণ অর্থনীতির স্থিতাবস্থায় পুনরায় গতি সঞ্চার করা; গ) গরিব মানুষের সপক্ষে শ্রেণিসমূহের পারস্পরিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটানো।

বামফ্রন্ট সরকার যে অবশ্যম্ভাবী ফলের দিকে লক্ষ্য রেখে এই অভিপ্রায় গ্রহণ করে তা হলোঃ

ক) পঞ্চায়েতকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলা;
খ) পঞ্চায়েতকে শুধু উন্নয়নের যন্ত্র হিসেবেই ব্যবহার নয়,তার সঙ্গে একে গ্রামের কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা এবং এভাবে মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করা;
গ) আমলাদের ক্ষমতা খর্ব করে জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করা;
ঘ) বর্তমান আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মধ্যে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই এর অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধি ঘটানো এবং উন্নয়নের একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে আন্দোলনের স্ফুরণ ঘটানো।

এই দৃষ্টিভঙ্গি পঞ্চায়েত সম্পর্কে মূল ধারার মূল্যায়ন থেকে সুস্পষ্টভাবেই ভিন্ন ধারার পঞ্চায়েতকে শুধু স্বশাসনের প্রতিষ্ঠান এবং গ্রামোন্নয়নের যন্ত্র হিসেবেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

বামফ্রন্ট সরকারের শরিক দলগুলির কর্মসূচি এবং বামফ্রন্টের সাধারণ কর্মসূচির দিকে লক্ষ করলেই দেখা যাবে, শ্রেণি শক্তিসমূহের ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটানো এর একটি প্রধান লক্ষ্য। ভূমিসংস্কার বামফ্রন্ট সরকারের গ্রামোন্নয়ন নীতির একেবারে মর্মস্থলে অবস্থান করেছে। মূল কাজ হলোঃ

ক) জমিদারি প্রথার অবসান করা;
খ)ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক ও গরিব কৃষকদের মধ্যে জমি বণ্টন করা; গ)জমি থেকে ভাগচাষিদের উচ্ছেদের বিধিবদ্ধ সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। গ্রামে এ লক্ষ্য পূরণের কাজে পঞ্চায়েতগুলি সরকারের সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠান।...’’
(প্রবন্ধঃ বামফ্রন্ট ও পঞ্চায়েত - প্রভাত দত্ত, পৃষ্ঠা-৬০ / ‘পশ্চিমবঙ্গ’ পত্রিকাঃ ১৪০৪ / তথ্য ও সংষ্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার)।

বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরে পঞ্চায়েতের কর্মসূচির সুবিধা পৌঁছেছে দরিদ্র অংশের মানুষদের কাছে। পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই কৃষকদের অধিকার প্রশাসনিক পদ্ধতিতে স্বীকৃতি পেয়েছিল এবং গরিব কৃষকরা অধিকার অর্জন করে। ‘‘...গ্রামাঞ্চলের শোষক শ্রেণি অর্থাৎ বৃহৎ ভূস্বামী-মহাজনদের জুলুম থেকে কৃষক ও গ্রামবাসীর মুক্তি শুরু হতে থাকে। গ্রামবাসীদের প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রামোন্নয়নের কাজ চলতে থাকে। সেকাল আর একাল অর্থাৎ বামফ্রন্টের আমলের মধ্যে এক দারুণ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। শ্রেণিশক্তির পুনর্বিন্যাস ঘটতে শুরু করে। শোষিত শ্রেণিগুলির পক্ষে সরকারের সমর্থন ও সক্রিয় সাহায্য তাঁদের আন্দোলন আরও তীব্র ও ব্যাপক হতে থাকে।...’’ (পঞ্চায়েত নির্বাচনঃ তফাৎটা কোথায় - সরোজ মুখোপাধ্যায় / গণশক্তি - ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮)।

গ্রামোন্নয়ন পরিকল্পনার প্রণয়ন ও রূপায়ণের ক্ষেত্রে সুসংবদ্ধভাবে সাধারণ মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৭৮ সালে নির্বাচিত ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের সূচনাপর্বে পঞ্চায়েতের ওপর বেনামি জমি নির্দিষ্টকরণ, বেনামি জমিগুলি দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে বিলি ও বর্গাদার নথিভুক্তকরণের মতো ভূমি সংস্কারের কাজ দেওয়া হয়েছিল। এরপর পঞ্চায়েতগুলির ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কাজের বিনিময়ে খাদ্য,জাতীয় কর্মসংস্থান প্রকল্প প্রভৃতি প্রকল্পের প্রণয়ন ও রূপায়ণের। দায়িত্ব দেওয়া হয় গ্রামীণ ভূমিহীনদের জন্য কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত করার প্রকল্পের কাজ। সুসংহত গ্রামোন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্ব প্রধানত পঞ্চায়েত সমিতির ওপর ন্যস্ত করা হয়। এই কাজগুলি বামফ্রন্ট সরকারের সময়ের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত সাফল্যের সঙ্গে করার ফলে গরিব মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন হয়।

নির্বাচিত পঞ্চায়েতের মাধ্যমে উন্নয়নের ক্ষেত্রে গণ-উদ্যোগ সৃষ্টি করতে পেরেছিল বামফ্রন্ট সরকার। কৃষকদের সমস্যাগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে কৃষি উন্নয়নের কাজ হয় পঞ্চায়েতের মাধ্যমে। বর্গাদারের অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল আইনের সাহায্যে রেকর্ড করার মধ্যে দিয়ে। বাম আমলে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গ্রাম উন্নয়ন ও ভূমিসংস্কারের ক্ষেত্রে কর্মসূচি দ্রুত রূপায়ণ, কৃষি মজুরদের মজুরি সুনিশ্চিত করা, বর্গাদারসহ ছোটো কৃষকদের ব্যাঙ্ক থেকে কৃষি ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের উদ্যোগী ভূমিকা স্মরণীয়।

বামফ্রন্ট সরকারের নেতৃত্বে গ্রামীণ বাংলায় ভূমিসংস্কারের সাফল্যের পিছনে পঞ্চায়েতের অবদান অবিস্মরণীয়। ভূমিসংস্কারের সাফল্যের ফলেই গ্রামাঞ্চলে চাষি ও গরিব মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফসলের উপর কৃষকের অধিকার সুনিশ্চিত হয়েছিল।

বর্গাদারদের নাম নথিভুক্ত করণের ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য সবিশেষ উল্লেখ্য। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানসমূহ ক্ষমতাশালী জমির মালিকের রোষানলে পড়ার ভয়ে নাম সরকারি নথিভুক্ত করতে,বর্গাদারদের সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে তাদের মনে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। বামফ্রন্ট সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এবং পঞ্চায়েতি প্রতিষ্ঠানগুলির সক্রিয় সহযোগিতার ফলে কয়েক লক্ষ গরিব মানুষ যারা মালিকানার স্বত্ব ছাড়াই যে সব জমিতে বসবাস করছিলেন, সেইসব বাস্তু জমির মালিক হতে পেরেছিলেন।

বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কারের তিনটি মূল বৈশিষ্ট্য ছিল - বেনামি ও সিলিং বর্হিভূত জমি উদ্ধার,দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্ধার করা জমি বণ্টন এবং অপারেশন বর্গার মাধ্যমে বর্গাদারদের মেয়াদি স্বত্ব সুনিশ্চিত করা। ভূমিসংস্কারের সাফল্যের পিছনে বামফ্রন্টের সময়ের পঞ্চায়েতগুলির সদর্থক ভূমিকা ছিল।

বামফ্রন্ট সরকারের সময় গ্রামাঞ্চলে ভূমিসংস্কারের সাফল্য তর্কাতীত। বাম আমলে রাজ্যের জমি শতকরা ৬০ শতাংশের উপর চলে গিয়েছিল প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষির হাতে। ভূমিসংস্কারের এই সাফল্যই কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল। এই সাফল্যের অন্যতম কারিগর ছিল ত্রিস্তর পঞ্চায়েত। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সার্বিক গ্রামোন্নয়নের ফলেই আটের দশকের প্রথম দিক থেকেই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের সামাজিক চরিত্রের বদল ঘটতে থাকে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারিত হয়। ফসলের উপর কৃষকের অধিকার সুনিশ্চিত হয়।

বামফ্রন্টের সময় কৃষিক্ষেত্রের সাফল্যের পিছনে কাজ করেছে ভূমিসংস্কার ও পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের নীতি। এর প্রভাব পড়ে গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণ। বামফ্রন্ট সরকারের সময় দরিদ্রতা দ্রুত হ্রাস পেয়েছিল। গ্রামোন্নয়নের কাজে পঞ্চায়েতকে যুক্ত করার সুফল পশ্চিমবঙ্গবাসী পেয়েছিল। পঞ্চায়েতকে ব্যবহার করে গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গ যে সাফল্য অর্জন করেছিল তা প্রশ্নাতীত।

ভূমিসংস্কার কর্মসূচির সফল রূপায়ণের সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানের উত্থানের ফলে গ্রামাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছিল। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রামোন্নয়ন কর্মসূচির সফল রূপায়ণে এবং আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলি সমাধানে পঞ্চায়েতের কার্যকর ভূমিকা গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক চিত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। গ্রামীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছিল, মহাজনি শোষণ কমে গিয়েছিল।

আসলে বামফ্রন্ট সরকারের সময় পঞ্চায়েত গরিব মানুষের প্রকৃত বন্ধু ছিল। গ্রাম বাংলার বেশিরভাগ মানুষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাম আমলের ‘জনগণের পঞ্চায়েত’ পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে চান। এই লক্ষ্যেই আদায়যোগ্য আন্দোলন গড়ে উঠছে,দৃঢ় হচ্ছে শ্রেণি ঐক্য।