৬০ বর্ষ ৯ সংখ্যা / ১৪ অক্টোবর, ২০২২ / ২৭ আশ্বিন, ১৪২৯
অসমে শিক্ষার হাল-হকিকত এবং পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ
কমলেশ গুপ্ত
‘‘শিক্ষার মূল কথা হলো একদল বিশেষজ্ঞ বা জ্ঞানী আর বিশেষ বিশেষ কাজে সুদক্ষ মানুষ তাঁদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবে। ...এই আদান প্রদানের কাজ নিরন্তর না চললে মানুষের সর্বনাশ এবং সব মানব সন্তানের কাছে না পৌঁছালেও জাতির বিপুল ক্ষতি। ...ভারতের মতো দেশে এ দায়িত্ব রাষ্ট্রের আরও বেশি, কারণ এখানে প্রচুর মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, প্রচুর মানুষ (প্রায় এক-চতুর্থাংশ) এখনো নিরক্ষর এবং এখানে শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার বলে সরকারই স্বীকার করেছে।’’
(শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার)
শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষার পরিবর্তে স্কুল পর্যায়ে ইংরেজি মাধ্যমে প্রবর্তনের নীতি গ্রহণ, বিদ্যালয় একত্রীকৃত করার নামে সরকারি বিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া, সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে শিক্ষাকে ব্যক্তিগত উদ্যোগের হাতে হস্তান্তর সহ বিভিন্ন সর্বজনীন শিক্ষা বিরোধী নীতি অসম সরকার গ্রহণ করেছে। এর বিরোধিতা করে অসমের ৯টি বিরোধী দল যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল গত ২৮ সেপ্টেম্বর। সেই অবস্থান ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং নাগরিকেরা। উপস্থিত ছিলেন ডঃ হীরেন গোঁহাই, সাংসদ অজিত কুমার ভূঁঞা, প্রবীণ বামপন্থী বুদ্ধিজীবী অবনী বরঠাকুর, শিক্ষাবিদ ডঃ ইন্দ্রাণী দত্ত, অসমীয়া প্রতিদিন পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক হাইদর হুসেন, ডঃ অপূর্ব বরুয়া, ডঃ মনোরমা শর্মা, প্রাক্তন সাংসদ বলীন কুলি এবং উদ্ধব বর্মণ সহ অনেকে।
অসম সরকার তৃতীয় শ্রেণি থেকে মাতৃভাষা মাধ্যমের বিদ্যালয়ে অবৈজ্ঞানিক এবং যুক্তিহীনভাবে মাতৃভাষা বর্জন করে বিজ্ঞান এবং গণিত বিষয় দু’টি ইংরেজি ভাষায় পড়ানোর সিদ্ধান্ত করেছেন। এর ফলে ছাত্রছাত্রীর প্রতিভা বিকাশ যে বাধাগ্রস্ত হবে তা নিশ্চিত। বিপন্ন হবে স্থানীয় ভাষা বিকাশের প্রক্রিয়া। অসমের শিক্ষা ব্যবস্থার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা বৈঠকে। রাজ্যের শিক্ষানুষ্ঠানগুলোতে খালি হয়ে আছে ২৮,১৯০টি শিক্ষক পদ। তার মধ্যে ১৩,২১৭টি পদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, ১৪,৯৭৩টি পদ মাধ্যমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত। ২৬ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিষয় অনুপাতে শিক্ষক নেই। ফলে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে রাজ্যের ৪৫.৭ শতাংশ ছাত্র এবং ৫২.৪ শতাংশ ছাত্রী মাধ্যমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। একাংশ আবার উত্তীর্ণ হয়েও উচ্চতর মাধ্যমিকে নাম নথিভুক্ত করতে পারেনি। অর্থাৎ মাধ্যমিক স্তরেই শিক্ষা সমাপ্ত হয় ৩০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর। আরও উদ্বেগজনক কথা হচ্ছে ৩,৭১৬টি নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঁচটি শ্রেণির জন্য মাত্র একজন শিক্ষককে দিয়ে বিদ্যালয় চালানো হচ্ছে।
স্কুলগুলোর এই সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে বর্তমানের অসম সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে শিক্ষার মাধ্যমের ওপর। সম্প্রতি অসমের বিরোধীদল সমূহের এক প্রতিনিধিদল গুয়াহাটির মাতৃভাষা মাধ্যমের সরকারি স্কুলগুলো পরিদর্শন করে এক বিবৃতিতে বলেছেন যে, বর্তমান বিজেপি সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা মাতৃভাষা মাধ্যমের স্কুলগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক করার অপচেষ্টা করছেন। সেগুলোর পরিকাঠামোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থাকে বেকরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া। নিজের পৃষ্ঠপোষকতায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ইংরেজি মাধ্যমের বিলাসবহুল শিক্ষানুষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষাকে গরিব মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন, পরিণত করছেন দরিদ্র মানুষের জন্য দুঃসাধ্য এক পণ্য সামগ্রীতে। ব্যবসার স্বার্থে তিনি যে ষড়যন্ত্রের জাল রচনা করছেন, তার বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষকে ভয়ভীতি ত্যাগ করে প্রতিবাদে শামিল হবার আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।
স্কুলগুলোর দুরবস্থার কারণ নিয়ে এখনও পর্যন্ত যেসব সমীক্ষা হয়েছে, তা থেকে জানা যায় যে, সরকারি বিদ্যালয়গুলোর পরিকাঠামো উন্নত না হওয়াই এর মূল কারণ। সরকারি বিদ্যালয়গুলোর পরিকাঠামো উন্নত করার মাধ্যমেই গুণগতমান উন্নত করা সম্ভব। সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে অসম সরকার এখন ‘বিদ্যাঞ্জলি’ পরিকল্পনা রূপায়ণে ব্যস্ত। অর্থাৎ সরকারি বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য বেসরকারি সংগঠন সহ সকলের কাছেই অর্থ জোগানোর জন্য আবেদন করা। যদি সরকারি বিদ্যালয়গুলোকে জনসাধারণের অনুদানে চলতে হয়, তবে সরকারের দায়িত্ব কী থাকবে? সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো উন্নত করার জন্য অর্থব্যয় করা যখন জরুরি কাজ ছিল, তখন সরকার মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ‘আনুষ্ঠানিক শিক্ষা’র ওপর গুরুত্ব আরোপ করা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তদুপরি বিকল্প শিক্ষার উদাহরণ স্থাপনের নামে সংঘ পরিবারের সাথে যুক্ত সংস্থাগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, অসম সরকার ‘শংকরদেব শিশু নিকেতন’ (আরএসএস পরিচালিত বিদ্যালয়) উন্নয়নে গুরুত্ব দিয়েছে এবং নানাভাবে সাহায্য করছে। অসম এবং ত্রিপুরার মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যে স্কুল একত্রীকৃত করা হচ্ছে অথবা বিভিন্ন এনজিও’র হাতে অর্পণ করা হচ্ছে। একত্রীকৃত করার ফলে ছাত্রছাত্রীদের এখন অনেকটা পথ পার হয়ে স্কুলে যেতে হবে। ফলে ড্রপআউটের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে পারে।
বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষাদানের দু’টি ধারা আছে। একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে, অন্যটি মূলত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি ব্যবস্থার তুলনায় আকর্ষক হয়ে ওঠে। কারণ সেখানে শিক্ষার উৎকর্ষের সাথে সমাজের এলিটসুলভ, বিশেষত ইংরেজি ভাষার বচন-কুশলতার সাথে পশ্চিমি ধরনের চালচলনের শিক্ষা দেওয়া হয়। যা একাংশ অভিভাবকের কাছে আকাঙ্ক্ষিত। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মধ্যে মাদ্রাসাগুলোকেও ধরে নেওয়া যায়, আবার কিছু সরকারি মাদ্রাসাও ছিল। সম্প্রতি অসম সরকার সরকারি মাদ্রাসা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। অন্যদিকে মাদ্রাসাগুলো সন্ত্রাসবাদী সৃষ্টি করছে - এই অভিযোগ উত্থাপন করেছে। ইতিমধ্যেই কয়েকজন ‘জেহাদি’কে বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সন্ত্রাসবাদীরা যেখানেই থাকুক, তাদের খুঁজে বের করা সরকারের দায়িত্ব। তাদের বিচার এবং শাস্তি দেওয়া উচিত। সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে সমস্ত মাদ্রাসা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া সভ্য সমাজের সমর্থনযোগ্য নয়। এ ঘটনাও সম্প্রতি ঘটেছে অসমের যোগীঘোপা অঞ্চলের কাবাইটারি মাদ্রাসার ক্ষেেত্র। গত ২৫ আগস্ট ওই মাদ্রাসা থেকে একজন শিক্ষককে বাংলাদেশের একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩০ আগস্ট ওখানে তল্লাশি হয় এবং কিছু আপত্তিকর নথিপত্র পাওয়ার অজুহাতে বুলডোজার দিয়ে ওই মাদ্রাসা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষের দান-খয়রাতি নিয়ে গড়ে ওঠা একটি প্রতিষ্ঠান ধুলোয় মিশিয়ে যেভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানোর চেষ্টা হয়েছে, তা কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।
শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের যে চক্রান্ত অসমে শুরু হয়েছে, তার বিরুদ্ধে যৌথ সংগ্রাম গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অসম পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত দাবি
গত ১ অক্টোবর প্রকাশিত একটি খবরে তিনসুকিয়া জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) দেবজিৎ দেউরীর কিছু বিস্ফোরক অভিযোগ উঠে এসেছে, সেগুলি হচ্ছে -
১) প্রায় সব পুলিশ অফিসারেরই এমনকী পাঁচজন নারীর সাথে পর্যন্ত অবৈধ সম্পর্ক আছে।
২) পুলিশ সুপারের পদে অধিষ্ঠিত মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার ভাই সুশান্ত বিশ্ব শর্মা দুটি মেয়ে এবং একটি ছেলেকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ আছে।
৩) দেবজিৎ দেউরীর ভাষ্যমতে সম্প্রতি রাজ্যের ৬০০-র বেশি লোককে বিনাদোষে অপরাধী সাজিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাছাড়াও এর তিন গুণেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে আগাম জামিন নিতে হয়েছে। দেউরীর অভিযোগ অনুযায়ী চারদিকে হাহাকার চলছে। অসৎ উদ্দেশ্যে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। এমনকী এসপি দেউরী নিজেও যে কোনো মুহূর্তে গ্রেপ্তার হতে পারেন বলে ভীতিগ্রস্ত হয়ে আছেন।
অসম পুলিশের দুর্নামের শেষ নেই। কিন্তু একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারের উত্থাপন করা গুরুতর অভিযোগ উদ্বেগজনক। সুনির্দিষ্ট এই অভিযোগের তদন্ত হওয়া জরুরি। রাজনৈতিক চাপে এটাকে আড়াল করতে হিতে-বিপরীত হবার সম্ভাবনা আছে। দেবজিৎ দেউরীর অভিযোগের সত্যতা আছে কিনা জনসাধারণের জানার অধিকার নিশ্চয়ই আছে। রাজ্যের গৃহ দপ্তর মুখ্যমন্ত্রীর হাতে, তাই তাঁকেও তদন্তের আওতায় আনা উচিত বলে দাবি উত্থাপিত হয়েছে। একজন কর্মরত পুলিশ অফিসারের এইসব অভিযোগ থেকে গৃহ দপ্তরের অরাজকতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যদি দেউরীর অভিযোগ সত্য হয়, তবে এটা প্রকট হবে যে, অসমে আইনের শাসন চলছে না, স্বরাষ্ট্র দপ্তরে চলছে অরাজকতা তথা উপদ্রব। তদন্তে যদি মুখ্যমন্ত্রীকে শামিল করতে হয়, তবে এটা প্রকট হবে যে, ন্যায়পালিকার ভূমিকা এবং হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তা নাহলে তদন্ত তামাশায় পরিণত হবে।