৬০ বর্ষ ৯ সংখ্যা / ১৪ অক্টোবর, ২০২২ / ২৭ আশ্বিন, ১৪২৯
ডব্লিউএফটিইউ - আন্তর্জাতিক শ্রেণি সংগ্রামের হাতিয়ার
দীপক দাশগুপ্ত
প্রেক্ষাপট
(ক) ফ্যাসিস্ট হিটলার-মুসোলিনি শক্তির পরাজয় ও স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের জয়লাভ, বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শক্তি তথা দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণির সামনে সংগ্রামের নতুন রাস্তা খুলে দেয়; এই ঘটনার দ্বারা বিশ্বে একগুচ্ছ পদানত পরাধীন দেশের জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জনের পথ উন্মুক্ত হলো। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীনস্ত অনেকগুলি পরাধীন দেশ মুক্ত হলো। ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের রাস্তাও অনেকটা ত্বরান্বিত হলো। ইয়োরোপের পূর্বাংশের দেশগুলিও ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করে জনগণতন্ত্র কায়েম করলো ও সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে গেল।
১৯৪৯ সালে মহাচীনের নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হলো। ১৯৪৫ সালে ভিয়েতনামের উত্তর অংশে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হলো হো চি মিনের নেতৃত্বে এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের ও পরবর্তী সময়ে দখলদার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রাম গড়ে উঠলো। পরবর্তী ষাট এবং সত্তর দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ভিয়েতনামের জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম চলল এবং ১৯৭৬ সালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনাম মুক্ত হলো এবং দুই ভিয়েতনাম এক হয়।
একইভাবে বৈপ্লবিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কোরিয়ার উত্তর অংশে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হলো, প্রতিষ্ঠিত হলো গণপ্রজাতান্ত্রিক কোরিয়া। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ও জাপ সাম্রাজ্যবাদী চক্রের মদতে পুতুল সরকার কায়েম হলো।
১৯৫৯ সালে কিউবার কমরেড ফিদেল কাস্ত্রো, কমরেড চে গুয়েভারার নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীরা কিউবাকে মার্কিন-স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী পুতুল সরকারের পতন ঘটিয়ে মুক্ত করে এবং সমাজতান্ত্রিক কিউবা গঠন করার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। মুক্ত করার দিন থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সরকার কিউবার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।
(খ) পরিণামে বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ থেকে বিশ্ব সমাজতন্ত্রের অনুকূলে পরিবর্তিত হলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে তথা ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধান্তে সমাজতন্ত্র হয়ে উঠেছিল নির্ণায়ক শক্তি। বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণির শ্রেণি সংগ্রাম গড়ে উঠল বিপুল শক্তি নিয়ে ও তীব্রতর বেগে।
বিশ্ব ফেডারেশন অব ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা
উপরোক্ত অনুকূল পরিস্থিতি ও পরিবেশে ১৯৪৫ সালের ৩ অক্টোবর গড়ে উঠেছিল ডব্লিউএফটিইউ (ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব ট্রেড ইউনিয়ন্স)। উক্ত সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্যারিস শহরে। প্রকৃত পক্ষে ডব্লিউএফটিইউ বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির প্রথম ঐক্যবদ্ধ সংগঠন। যে সংগঠন দেশে দেশে তার অনুমোদিত সংগঠনগুলির নেতৃত্বে শ্রেণি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলির একচেটিয়া পুঁজি ও বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামকে বিগত ৭৭ বছর যাবত এগিয়ে যেতে পরিপূর্ণ সহায়তা করে চলেছে।
ক্রমবর্ধমান শ্রেণি সংগ্রামের পথে এগিয়ে যাওয়ার বিশ্ব শ্রমিক নেতৃত্ব
ডব্লিউএফটিইউ প্রতিটি দেশে শ্রমিক আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে থাকে তার জন্মলগ্ন থেকে। শ্রমিক শ্রেণির অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করা, শ্রমিক শ্রেণির ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে সংগঠিত হওয়া এবং যৌথ দর কষাকষির বিষয়কে সুদৃঢ়ভাবে সমর্থন জানিয়ে থাকে ডব্লিউএফটিইউ। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, The WFTU took the initiatives for the adoption of ILO conventions on the right of association and collective bargaining.
এই ফেডারেশন বিশ্বব্যাপী বহমান শ্রেণি সংগ্রামকে সর্বদা যেমন সমর্থন জানিয়ে এসেছে এবং আজও সমর্থন করে চলেছে অনুরূপভাবে গ্রিসের ফ্যাসিস্ট জুন্টার বিরুদ্ধে সংগ্রাম শ্রমিক শ্রেণি ও জনগণের সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। রাষ্ট্রসঙ্ঘকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছিল যে, মাদ্রিদ (স্পেনের রাজধানী) থেকে সদস্য রাষ্ট্রগুলি যেন তাদের দূত প্রত্যাহার করে নেয়।
পূ্র্বে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার যা ডব্লিউএফটিইউ-র সংহতিমূলক আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে তোলা হয়েছে এবং আজও গড়ে তোলা হচ্ছে। ঔপনিবেশিক ও ধনতান্ত্রিক দেশগুলির নির্যাতিত ও চরমভাবে শোষিত শ্রমিকদের সংগ্রামের সমর্থনে আজও সংহতিমূলক আন্দোলন সংগঠিত করা হচ্ছে।
দুইটি সংহতিমূলক আন্দোলনের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায় এখানে। যথাক্রমে ১৯৪৬ সালে ডব্লিউএফটিইউ-র এক Special Mission পাঠানো হয়েছিল ইরানে। সেখানে সংগ্রাম চালানোর অপরাধে এবং তাদের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করার জন্য। টি ইউ নেতাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছিল। আরও একটি দৃষ্টান্ত পূর্বতন দক্ষিণ আফ্রিকায় (বর্ণবাদী শাসনের সময়ে)।
১৯৪৭ সালে অনুরূপ একটি Mission ডব্লিউএফটিইউ-র পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছিল যেখানে ধর্মঘটী খনি শ্রমিকদের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন চালানো হচ্ছিল তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে।
এছাড়াও ঔপনিবেশিক শাসনে পদানত দেশগুলির শ্রমজীবী মানুষ পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য ব্যাপক জাতীয় ও স্বাধীনতা সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন। তাদের দ্বারা সংগঠিত সংগ্রামের প্রতি ডব্লিউএফটিইউ সংহতি আন্দোলন সংগঠিত করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে ওই দেশগুলির সংগ্রাম উত্তাল হয়ে ওঠে। উক্ত দেশগুলির শ্রমিক শ্রেণি ও সমগ্র শ্রমজীবী মানুষ ওই সময়ে জাতীয় মুক্তি অর্জনে দৃঢ়ভাবে অংশ নেন। ডব্লিউএফটিইউ উক্ত সংগ্রামগুলি সক্রিয় সমর্থন করে সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য এবং ওই সমস্ত দেশের ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক সংহতিমূলক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানায়।
ডব্লিউএফটিইউ - এক আন্তর্জাতিক ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক সংগঠন
ডব্লিউএফটিইউ ১৯৪৫ প্রতিষ্ঠিত হয় এক বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক সংগঠন হিসাবে। এই সংগঠন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে সাধারণভাবে একটা ঐকমত্যের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল; সেই ঐক্যবদ্ধতা ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত কাজ করেছে।
কিন্তু কয়েক বছর অর্থাৎ ১৯৪৯ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে Marsal Plan–এর প্রশ্নে মত পার্থক্য সৃষ্টি হয় সংগঠনের মধ্যে, এটা দূর করে ঐক্যবদ্ধভাবে ডব্লিউএফটিইউ-কে পরিচালনার চেষ্টা সত্ত্বেও তা সম্ভব হয় না। এর পরিণামে মার্কিন শাসকবর্গের প্ররোচনায় ও মদতে ১৯৪৯ সালে তা বিভাজিত হয়।
১৯৪৯ সালে অনেকগুলি National Trade Union ডব্লিউএফটিইউ থেকে বেরিয়ে যায়। এবং যারা এই সংগঠন থেকে বেরিয়ে যায় তারা আলাদাভাবে মিটিং করে এবং ডব্লিউএফটিইউ-কে বিভাজিত করে এবং আইসিএফটিইউ নামে এক বিভেদকামী সংগঠন গড়ে তোলে। যে সংগঠন অদ্যাবধি তথাকথিত ‘‘Free Trade Union’’ হিসাবে আত্মপ্রচার করে ও পরিচয় দেয়।
আইসিএফটিইউ প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদকে সাহায্য করার জন্য গঠিত হয়েছে। জন্মলগ্ন থেকে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে আইসিএফটিইউ কাজ করছে ও পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে শ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে শোষণ করতে সাহায্য করে চলেছে। তারা পুঁজিবাদী শোষণের পক্ষে সর্বদা অবস্থান করে।
আইসিএফটিইউ তথাকথিত ফ্রি ট্রেড ইউনিয়ন -এর নামে শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী ও বুর্জোয়া মালিক শ্রেণির ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, নির্যাতনমূলক শাসনের পক্ষে দাঁড়ায় এবং শ্রমিক শ্রেণিকে তার পক্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা চালায়। আর অন্যদিকে ডব্লিউএফটিইউ তার জন্মলগ্ন থেকে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষা, ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ বিরোধী শ্রেণিসংগ্রাম ও গণসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
একাজের জন্য প্রয়োজন শ্রমিক শ্রেণির দৃঢ় ঐক্য এবং কৃষক সহ অন্যান্য মেহনতি মানুষের দৃঢ় ঐক্য ও ব্যাপকতম সংগ্রাম সংগঠিত করা।
কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট লিগের কংগ্রেসে বলেছিলেন ‘‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’’। ১৮৬৪ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা কংগ্রেসে মার্কস-এঙ্গেলস আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনে প্রুঁধো, লাসাল ও ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব প্রমুখ যারা মার্কসীয় মতবাদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতেন তাঁদের সকলকে নিয়েই প্রথম আন্তর্জাতিক গড়ে তুলেছিলেন। ওই কংগ্রেসে মার্কসের উদ্বোধনী বক্তব্য ছিল দুনিয়ার মজদুর শ্রেণির ঐক্য ও সংগ্রামের এক অনন্য দলিল, যে দলিল বিশ্বের শ্রমিক আন্দোলনের দিগ্দর্শন হয়ে আছে ও থাকবে ভবিষ্যতে।
বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের গড়ে ওঠা ও পথচলা উক্ত দিক নির্দেশিকার ওপর ভিত্তি করেই।
প্রসঙ্গত, আমাদের দেশে অন্যতম শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন সিআইটিইউ-র রণকৌশল হলো ‘‘ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি’’। সিআইটিইউ গঠিত হওয়ার পর থেকেই ঐক্য ও সংগ্রামের রণকৌশলের লাইনে অগ্রসর হয়ে চলেছে। ফলশ্রতি সিআইটিইউ-র শক্তি ক্রমবর্ধমান।
ডব্লিউএফটিইউ-র সংজ্ঞা
ডব্লিউএফটিইউ প্রতিষ্ঠা কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ১৯৪৫ সালে। এর লক্ষ্য ‘‘এই সংগঠন গণতান্ত্রিক ও আন্তর্জাতিক শ্রেণি ভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন, যা বিশ্বের শ্রমিকদের সংগ্রামের প্রতি সর্বদা সমর্থন করে থাকে। এবং প্রতিটি দেশের শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দিয়ে থাকে।’’
উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য
History of the WFTU-তে বলা হয়েছেঃ
‘‘WFTU is a democratic, class-based international trade union organization of struggle of all wage-earners, which supports and encourages action by trade unions in every country to obtain the independent rights and demands of the workers, to defend their interests, to combat all forms of domination and subservience, exploitation and oppression, and to bring about socio-economic development and which develops and coordinates cooperation and solidarity.’’
শ্রমিক শ্রেণির ধর্মঘট করার অধিকার সম্পর্কে
ডব্লিউএফটিইউ শ্রমিক শ্রেণির ধর্মঘট করার অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে মনে করে ডব্লিউএফটিইউ কোনোরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব, দোদুল্যমানতার প্রশ্নকে উপেক্ষা করে সুস্পষ্টভাবে ধর্মঘট সম্পর্কে দৃঢ়ভাবে সঠিক অবস্থান গ্রহণ করেছে। কিন্তু শ্রেণি সমন্বয়কারী পূর্বতন আইসিএফটিইউ বর্তমানে আইটিইউসি সংগঠন শ্রমিক শ্রেণির ধর্মঘট করার অধিকারের বিরোধিতা করে থাকে। এর দ্বারা আইসিএফটিইউ বা আইটিইউসি শ্রমিক বিরোধী ও পুঁজিপতি মালিক শ্রেণির স্বার্থবাহী সংগঠন হিসাবে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়। ডব্লিউএফটিইউ সমস্ত মালিক শ্রেণিকে দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেয় যে, আইএলও-র দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে যে, শ্রমিক শ্রেণির ধর্মঘট করার অধিকার কারও দয়ার দান নয়; এটা দীর্ঘ সংগ্রামের দ্বারা অর্জিত অধিকার। এই অধিকার কারও কাছে ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই নেই। শ্রেণি সমন্বয়কারী আইটিইউসি নেতৃত্ব, যারা সংস্কারবাদী তারা পুঁজি ও তার মালিকদের স্বার্থে ও শ্রমিকদের স্বার্থের বিরুদ্ধে এই অর্জিত অধিকার ছেড়ে দিতে চায়। ডব্লিউএফটিইউ এক বিপ্লবী ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন হিসাবে মনে করে যে, ধর্মঘট করার অধিকার সংগ্রাম করে রক্ষা করা প্রয়োজন। শ্রমিক শ্রেণি তা কখনও ছেড়ে দেয় না। প্রসঙ্গত, কমরেড জ্যোতি বসু বার বার বলতেন, ধর্মঘটের অধিকার কখনও ছেড়ে দেবেন না - আমরা বললেও ছেড়ে দেবেন না।
ডব্লিউএফটিইউ-র মূল বিষয় পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শোষণকে পরাস্ত করে শ্রমিক শ্রেণির জয় অর্জন করা। দ্বিতীয়ত, ঔপনিবেশিক, সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদ ও বর্ণবাদ প্রভৃতি শোষণ-শাসনমূলক ব্যবস্থাকে পরাস্ত করা সংগ্রামের দ্বারা। তৃতীয়ত, পারমাণবিক যুদ্ধ প্রস্তুতি রোধ, এবং সমস্ত ধরনের সামরিক মোর্চা ও ব্লক বাতিল করা, আক্রমণ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে ন্যায় ও শক্তি প্রতিষ্ঠা, সমস্ত দেশের জনগণের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা এবং পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করা ও পুরোপুরি নিরস্ত্রীকরণ করা প্রভৃতির জন্য দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রাম গড়ে তোলার লক্ষ্যে ডব্লিউএফটিইউ-র পক্ষ থেকে উদ্যোগ ও সহযোগিতা চালানো হয়ে থাকে। উপরোক্ত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে ডব্লিউএফটিইউ গঠিত হওয়ার পরেই বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালিয়েছে এবং এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও যুদ্ধ চক্রান্তের বিরুদ্ধে ডব্লিউএফটিইউ ও তার অনুমোদিত ট্রেড ইউনিয়নগুলি দেশে দেশে ‘‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’’ এই দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
ডব্লিউএফটিইউ এবং তার অনুমোদিত ট্রেড ইউনিয়নগুলি এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার মুক্তিকামী জনগণের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন ও মুক্তির জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সমাজতান্ত্রিক কিউবা সহ অনেকগুলি দেশের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অর্থনৈতিক অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। ডব্লিউএফটিইউ ও তার অনুমোদিত ট্রেড ইউনিয়নগুলি মার্কিন যুদ্ধবাজ চক্রের উক্ত জঘন্য কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ও সংগ্রাম পরিচালিত করছে। একইভাবে মার্কিনি মদতে ইজরায়েলের যুদ্ধবাজ শাসকদল প্যালেস্তাইনের ওপর যেভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে তীব্রভাবে প্রতিবাদ করে চলেছে ডব্লিউএফটিইউ ও তার অনুমোদিত ট্রেড ইউনিয়নগুলি নিজ নিজ দেশে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চক্রান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছে। ইরান, ইরাক সহ মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হামলা, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ডব্লিউএফটিইউ এবং সকল দেশের অনুমোদিত ইউনিয়নগুলি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম গড়ে তুলেছে।
সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণির সমর্থনপুষ্ট আইসিএফটিইউ উপরোক্ত বিষয়গুলিতে প্রতিবাদ দূরের কথা, উক্ত সংগঠন সুস্পষ্টভাবে সাম্রাজ্যবাদী-ফ্যাসিবাদী পক্ষে অবস্থান করছে।
সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন, বেসরকারিকরণ ও উদারীকরণ নীতি ও বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন
১৯৯১ সাল থেকে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ নয়া উদারনীতি, বিশ্বায়ন ও বেসরকারিকরণের নীতি ভারত সহ বিশ্বের দেশে দেশে প্রয়োগ করে চলেছে; তার ফলে দেশগুলির শ্রমজীবী জনগণের ওপর তীব্রতম শোষণ চলছে ও পুঁজিপতিদের পক্ষ থেকে পূর্বেকার সমস্ত রেকর্ড ম্লান করে শোষণ চালানো হচ্ছে। ভারত সহ প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশেই বৃহৎ পুঁজি ও করপোরেট মুনাফার লুটের মহোৎসব চালানো হচ্ছে। বর্তমানে আরএসএস-বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে চরম প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি কেন্দ্রে ও অনেকগুলি রাজ্যে সরকার পরিচালনা করছে। সরকার শ্রমিক শ্রেণি তথা সমগ্র জনগণের ওপর অভূতপূর্ব শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে গরিবি, বেকারি তীব্রগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর আদানি, আম্বানি, টাটা, বিড়লা প্রভৃতি বৃহৎ পুঁজি ও করপোরেটদের পুঁজি নজিরবিহীনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতেও সেই একই অবস্থা বিরাজ করছে।
কিন্তু ভারত সহ সমস্ত উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের শ্রমিক শ্রেণি ও তার শ্রমজীবী মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার, তারা প্রতিরোধের ময়দানে শামিল। ভারতেও ১৯৯১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষ ২১ বার সাধারণ ধর্মঘট করেছে। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রেও শিল্প ও সংস্থা ভিত্তিক ধর্মঘট সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে; ভারত সহ প্রতিটি দেশের শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামকে ডব্লিউএফটিইউ জোরালোভাবে সমর্থন জানিয়েছে।
ডব্লিউএফটিইউ এবং তার অনুমোদিত ইউনিয়নগুলি চরম অত্যাচারের মধ্যেও প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কোটি কোটি অত্যাচারিত, শোষিত মানুষ নিজেদের শিড়দাঁড়া টান করে শির উঁচু করে শোষণ, অত্যাচারের বিরুদ্ধে লালঝান্ডা হাতে নিয়ে সংগ্রামকে প্রসারিত করে বিশাল বিশাল প্রতিরোধ মিছিল ও ধর্মঘটে শামিল হচ্ছেন।
ডব্লিউএফটিইউ ও তার অনুমোদিত ইউনিয়নগুলি ভয়ভীতিকে অগ্রাহ্য করে দৃঢ়ভাবে নির্দিষ্ট প্রতিরোধ, সংগ্রামের পথে এগিয়ে চলেছে।
শ্রমিক শ্রেণির জয় অনিবার্য।
ডব্লিউএফটিইউ জিন্দাবাদ।
তথ্যসূত্রঃ
১। History of WFTU ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।
২। স্বদেশ দেবরায় লিখিত ‘Champion of class struggle’.