৬০ বর্ষ ৯ সংখ্যা / ১৪ অক্টোবর, ২০২২ / ২৭ আশ্বিন, ১৪২৯
মার্কসীয় দর্শন - দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (চার)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
● দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ প্রসঙ্গে আলোচনায় আমরা একথা জেনেছি যে, বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সমন্বয়ে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন গড়ে ওঠে। এই ঐতিহাসিক ভূমিকা কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস যৌথভাবে পালন করলেন। যদিও দ্বান্দ্বিকতার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় মহান জার্মান দার্শনিক হেগেলের ভূমিকার কথা কার্ল মার্কস বারে বারে উল্লেখ করেছেন। যদিও হেগেলের দ্বান্দ্বিকতার সীমাবদ্ধতার কথা মার্কস নিজেই উল্লেখ করেছেন। দার্শনিক হেগেল দ্বান্দ্বিকতাকে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সমন্বিত করলেন। তাই তো কার্ল মার্কসের কথায়, হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতা মাথা নিচে ও পা ওপরে করে দাঁড়িয়েছিল। তাঁরা (মার্কস ও এঙ্গেলস) যেটা করলেন তা হলো, দ্বান্দ্বিকতাকে স্বস্থানে স্থাপন করলেন, অর্থাৎ পা নিচে ও মাথা ওপরে এভাবে দাঁড় করালেন। দ্বান্দ্বিকতাকে বস্তুবাদের সাথে সমন্বিত করলেন।
● এবারে আমরা বস্তু সম্পর্কিত আলোচনায় প্রবেশ করব। বস্তু সম্পর্কে সঠিক ধারণা গড়ে তুলতে না পারলে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে পরিষ্কার বোঝাপড়া গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
বস্তু বলতে কী বোঝায়
● আমাদের চারপাশে যতকিছু সব কিছুই বস্তু। মানুষ ও মানব সমাজ, সমগ্র জীব জগৎ (কীট পতঙ্গ ও সমস্ত ধরনের প্রাণীসহ), গাছপালা, নদ-নদী-সাগর-মহাসাগর, পাহাড়, মরুভূমি, মালভূমি, সমতল, আমাদের পৃথিবী, সূর্য, সমগ্র সৌরজগৎ সবই বস্তু। ছায়াপথ নামক যে নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে আমাদের সৌরজগৎ তথা পৃথিবীর অবস্থান তাও বস্তু। সমগ্র মহাবিশ্বই বস্তুজগৎ। এ তো গেল বৃহৎ বস্তুর কথা। এবার চোখে ধরা পড়ে না এমন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পদার্থের রূপগুলি আমরা এখনও পর্যন্ত জেনেছি যেমন, অণু, পরমাণু, ইলেকট্রন, প্রোটন, কোয়ার্ক, মেসন এই সমস্ত কিছুই তো বস্তু। আলো, শব্দসহ নানা ধরনের শক্তি তাও বস্তু। বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের পদার্থ ও শক্তির মধ্যেকার সম্পর্ক বিষয়ে অবহিত করেছে। পদার্থ ও শক্তি পরস্পর রূপান্তরযোগ্য। মহান বিজ্ঞানী স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইন পদার্থ ও শক্তির মধ্যের সম্পর্কের সূত্র আবিষ্কার করে প্রকৃতি বিজ্ঞানকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করলেন। যে পারমাণবিক শক্তি নিয়ে এত আলোচনা তা যেমন শক্তির একটি রূপ এবং এটাও তো বস্তু। যে ক্ষেত্র (Field) নিয়ে এত আলোচনা, যেমন, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি (Gravitational Force), তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্র (Electro-Magnetic Field), এই সমস্তই বস্তু।
● ঘটনাবলিও বস্তুরই একটি রূপ। সামাজিক সমস্ত ঘটনাবলি সামাজিক প্রক্রিয়া। সমস্ত সামাজিক প্রক্রিয়াও বস্তু। কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠন ও বিপ্লবী কার্যধারা সামাজিক প্রক্রিয়া। এইগুলিও বস্তু। যা কিছু আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি, যা কিছু আমরা অনুভব করতে পারি শুধুমাত্র তাই বস্তু নয়। আমাদের গোচরের বাইরে, আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে বহু কিছু রয়েছে তাও তো বস্তু। আমাদের জানার পরিমাণ মোটেই যথেষ্ট নয়, আমাদের জানার বাইরের পরিমাণটাও অসীম। বস্তুজগৎ যে অসীম, তাই জানার পরিমাণও সীমাহীন। বৃহৎ ও ক্ষুদ্র পদার্থ এবং নানারূপ জটিলতর প্রক্রিয়ার সম্পর্কে জ্ঞানের বিকাশ ঘটছে। মানুষের ব্যবহারিক কার্যক্রম ও বিজ্ঞানের নিরন্তর বিকাশ এ সম্পর্কিত জ্ঞানের বিস্তার ঘটাচ্ছে। মাত্র কয়েক দিন পূর্বের ঘটনা (২মাসও হয়নি)। মানুষ প্রেরিত এই মুহূর্তের সর্বাধিক শক্তিশালী টেলিস্কোপ, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে ধরা পড়েছে ১৩৫০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রমণ্ডলী। অকল্পনীয় নয়, এটা বাস্তব। ব্যাপারটা একটু সময় নিয়ে চিন্তা করুন। বস্তুজগতে সর্বাধিক গতিসম্পন্ন বস্তু হলো আলো (Light)। এক সেকেন্ডে আলোর গতিবেগ হলো প্রায় ৩ লক্ষ ২৪ হাজার কিলোমিটার। তাহলে এক মিনিটে আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করবে তা হলো ৩ লক্ষ ২৪ হাজার × ৬০ কিলোমিটার। এক ঘণ্টায় আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করবে তা হলো ৩,২৪,০০০×৬০×৬০ কিলোমিটার। ২৪ ঘণ্টায় অর্থাৎ এক দিনে আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করবে তার পরিমাণ হলো ৩,২৪,০০০×৬০×৬০×২৪ কিলোমিটার। এবার এক বছরে আলো কত পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করবে তা হলো - ৩,২৪,০০০×৬০×৬০×২৪×৩৬৫১/৪ কিলোমিটার। (পৃথিবী সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় ৩৬৫১/৪ দিন)। এই যে বিপুল পরিমাণ কিলোমিটার যা আলো এক বছর সময়কালে অতিক্রম করে তাকে বলে আলোকবর্ষ (Light Year)। তাহলে বুঝুন, ১৩৫০ কোটি বছরে আলো কী বিশাল পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করবে। এত বিশাল দূরত্ব সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টি দেওয়া বা তা উপলব্ধিতে আনা সম্ভব হয়নি এতকাল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে এতদূর ও সুদূরের বস্তু সম্পর্কে বর্তমান সময়ে মানুষের জ্ঞান অর্জিত হয়েছে। এখনও পর্যন্ত মনুষ্যসমাজ যতদূর পর্যন্ত জানতে পেরেছে তার বাইরেও বস্তুজগৎ বিরাজ করছে। মানুষের দৃষ্টির মধ্যে না থাকলেও যার বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে তাই বস্তু। বস্তু থেকে নির্গত আলো মানুষের চোখে ধরা পড়লে তা আমরা দেখতে পারি। কিন্তু অসীম এই বস্তুজগতে মানুষের দৃষ্টির বাইরে রয়েছে অসীম বস্তুজগতের বিপুল পরিমাণ। যার বাস্তব রয়েছে, যা চেতনা নিরপেক্ষ তাই হলো বস্তু।
● বস্তু প্রকৃতপক্ষে একটি দার্শনিক রূপ - যার বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে, চেতনা নিরপেক্ষ তবে চেতনায় প্রতিফলিত হতে পারে। চেতনায় প্রতিফলিত হওয়া নির্ভর করে মানুষের ইন্দ্রিয় অনুভূতির ওপর। বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে নির্ভর করে ইন্দ্রিয় অনুভূতিকে অকল্পনীয় পরিমাণে বিকশিত করা সম্ভব হয়েছে। যার জন্যই যেখান থেকে আলোর আসতে সময় লাগবে প্রায় সাড়ে তেরো শত কোটি বর্ষ, সেই বস্তুকেও মানব সভ্যতা উন্নত উপকরণ ব্যবহার করে দেখতে সক্ষম হচ্ছে। লার্জ হ্যাড্রন কোলাইজার (LHC), জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এইগুলি অতি উন্নতমানের উপকরণ যা চেতনায় প্রতিফলিত করার ক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। মোদ্দা কথা হলো, আমরা যা দেখছি, উপলব্ধি করছি তা শুধুমাত্র অসীম এই বস্তুজগতের দৃষ্টিগোচর অংশ (observable part of the universe)।
● অসীম এই বস্তুজগতে প্রতিটি নির্দিষ্ট বস্তুকে ধরে যদি জানার প্রয়াস গ্রহণ করা হয়, তবে তাকে জানা সম্ভব। এই জানাকেই বলে জ্ঞান (knowledge)। বস্তু যেমন বাস্তব, জ্ঞানও বাস্তব। জ্ঞান বাস্তব বলেই তো তাকে অবলম্বন করে মানব সভ্যতার নিরন্তর অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। বস্তুকে জানা সম্ভব, নির্দিষ্ট বস্তুকে অবলম্বন করে জ্ঞানার্জন যে সম্ভব, ভাববাদ এটা স্বীকার করে না। তবে জ্ঞানের অগ্রগতির সুফল গ্রহণ ও ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ভাববাদীরা যথেষ্ট সিদ্ধহস্ত।
বস্তু সর্বদাই গতির মধ্যে অবস্থান করছে
● বস্তুর অস্তিত্বের রূপ হলো গতি। বস্তু সর্বদাই গতির মধ্যে অবস্থান করছে। গতিশীলতা বস্তুর ধর্ম। বস্তুকে সবসময়ে গতির মধ্যে বিচার করতে হবে। স্থির বস্তু বলে কিছু হয় না। আপাত দৃষ্টিতে যাকে স্থির বলে মনে হয়, তাও কিন্তু গতির মধ্যে অবস্থান করছে। আমরা স্থির হয়ে যখন বসে থাকি বা বিশ্রাম করছি তখনও কিন্তু আমরা গতির মধ্যেই অবস্থান করছি। স্থির অবস্থা একেবারেই আপেক্ষিক। কারণ যে পৃথিবীর মধ্যে আমরা অবস্থান করছি তা তো নানাবিধ গতির মধ্যে অবস্থান করছে। শুধুমাত্র একটা গতির মধ্যে নয়, নানাবিধ গতির মধ্যে অবস্থান করছে এই পৃিথবী, পৃিথবী িনজের অক্ষের চারপাশে ঘুরছে। একে বলে আহ্নিক গতি। ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবী নিজের চারপাশে একবার ঘোরে। আহ্নিক গতির জন্যই দিন ও রাত্রি হয়।
● আবার পৃথিবী, আমাদের এই সুন্দর গ্রহ সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। ৩৬৫১/৪ দিনে সূর্যের চারপাশে একবার প্রদক্ষিণ পৃথিবী সম্পন্ন করে। এখানেই শেষ নয়, সূর্য তার পরিবার নিয়ে আমাদের নক্ষত্রমণ্ডলী ‘ছায়াপথ’ (Milky Way)-এর কেন্দ্রকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। সুতরাং একথা বোঝার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয় যে, আমরা অর্থাৎ মানবসমাজসহ যা কিছু বস্তু এই পৃথিবীর মধ্যে রয়েছে সবই তো নানাবিধ গতির মধ্যে অবস্থান করছে। আমরা যখন স্থিরভাবে বসে থাকি বা ঘুমাই, তখন আমাদের শরীরের মধ্যে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। জারি থাকে বিপাকক্রিয়া (Metabolism)। জীবন্ত মানুষের শরীরে একদিকে পুরাতন কোষের মৃত্যু হয় এবং জন্ম নেয় নতুন কোষ। জীবন-মৃত্যুর ধারা আমাদের চোখের সামনে। ব্যক্তি মানুষ ও তার জীবন, মানব সমাজ সমস্ত কিছুই নিরন্তর গতির মধ্যে অবস্থান করছে। গতির দ্রুততর হওয়া (Acceleration) এটাও বস্তুর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য।
● আমাদের পৃথিবীর যে ভূ-স্তর তাও গতির মধ্যে অবস্থান করছে। এটা ভূ-স্তরীয় গতি, - প্লেট টেকটনিক মুভমেন্ট (Plate Tectonic Movement)। ভূস্তরীয় এই গতির ফলেই একটি স্তর (Plate) অপর স্তরের (Plate) মধ্যে অনেক সময়ে প্রবেশ করে। এরফলে ভূ-কম্পন হয়।
● আমাদের পৃথিবীর বর্তমান যে মানচিত্র, কয়েক কোটি বছর পূর্বে পৃথক মানচিত্র ছিল। পৃথিবীর মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটে চলেছে। মহাসাগর-সাগর ও মহাদেশগুলির অবস্থানেরও পরিবর্তন ঘটে চলেছে। পৃথিবীর এই ভৌগোলিক পরিবর্তনের গতি অত্যন্ত কম তাই অনেক সময়ে এই গতি ও পরিবর্তন আমাদের বোধগম্য হয় না।
● বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতির যুগে আমরা বাস করছি। বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা জেনেছি যে, স্থির অবস্থাও একটি শক্তি। একে বলে স্থির শক্তি (Static Energy)। স্থির অবস্থাও গতির একটা রূপ।
● এর পরবর্তী পর্যায়ে আমরা আলোচনা করব স্থান (Space) ও সময় (Time) সম্পর্কে। স্থান ও সময় হলো গতিশীল বস্তুরই বৈশিষ্ট্য।
(ক্রমশ)