৫৯ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৫ এপ্রিল, ২০২২ / ১ বৈশাখ, ১৪২৯
সিপিআই(এম) ২৩তম পার্টি কংগ্রেস
শিক্ষার অধিকারের ওপর বিজেপি সরকারের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক পার্টি কংগ্রেসে
শিক্ষার অধিকারের ওপর বিজেপি সরকারের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত হয়েছে। কংগ্রেসে আহ্বান জানানো হয়েছে, সমাজের বিস্তৃত অংশের যাঁরা উন্নয়ন মুক্তি ও সমতার জন্য শিক্ষাকে হাতিয়ার বলে মনে করেন, তাঁরা শিক্ষার ওপর এই গুরুতর আক্রমণের প্রতিরোধে সমবেত হন। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, শিক্ষার বেসরকারিকরণ বাণিজ্যিকীকরণ নয়াউদারবাদী নীতির এক অখণ্ড অংশ। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এই নীতির প্রয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, শিক্ষায় রাষ্ট্রের দায়িত্বকে প্রত্যাহার করে সেই স্থানে করপোরেটদের জায়গা করে দেওয়া। এই নীতি শিক্ষার পরিমাণগত, গুণগত মানের এবং সবার শিক্ষা পাবার অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত।
মহামারীর সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনলাইন পড়াশুনো শুরু হয়। যা, শিক্ষাগ্রহণে সমতার ধারণাকে খাটো করা শুরু করে। কেন্দ্রীয় সরকার মহামারীকে ব্যবহার করে অগণতান্ত্রিকভাবে নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০ প্রণয়ন করে। এই শিক্ষা নীতি শিক্ষায় কেন্দ্রীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ এবং সাম্প্রদায়িকীকরণের পথ প্রশস্ত করেছে। এই নীতিতে প্রচলিত শ্রেণিকক্ষভিত্তিক শিক্ষাপ্রদানের পরিবর্তে অন্য যেকোনো পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রদানের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ভালো জায়গায় রাখতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করা দরকার ছিল। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ শতাংশ কোর্স অনলাইনে করার কথা বলেছে। এই ব্যবস্থা শিক্ষার গুণগত মানকে খর্ব করবে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ভারতে লিঙ্গ বৈষম্য বিরাট। মহামারীতে ছাত্রীদের শিক্ষা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। ছাত্রীদের মধ্যে কম বয়সে বিবাহ, পাচার, গার্হস্থ্য হিংসা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
শিক্ষাব্যবস্থাকে এইভাবে সংকুচিত করতে মহামারীর সমস্ত সুযোগকে সরকার ব্যবহার করেছে। প্রান্তিক আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠী থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা এই ডিজিটাল বিভাজনে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। স্কুলগুলিতে স্থায়ীশিক্ষকের জায়গায় চুক্তিভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ চলছে। অস্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক, অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ হওয়া শিক্ষকরা স্কুল শিক্ষাব্যবস্থায় বিরাট অবদান রাখা সত্ত্বেও তাঁদের স্থায়ী হওয়ার কোনো সুযোগই থাকছে না।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিজেপি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তুলে দেওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বর্তমান যে প্রতিষ্ঠানগুলি রয়েছে সেগুলির জায়গায় নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে বিজেপি সরকার। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের স্থানে হায়ার এডুকেশন কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া এবং অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশনের স্থানে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশনকে প্রতিস্থাপিত করার লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে। হায়ার এডুকেশন ফিনান্স এজেন্সি তৈরি করা হয়েছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে পরিকাঠামো উন্নয়নে ঋণ দেওয়ার জন্য। এটাও বিজেপি সরকারের উচ্চশিক্ষাকে বেসরকারিকরণের দিকে নিয়ে যাওয়ার একটা পদক্ষেপ।নয়া শিক্ষা নীতি দেশের শিক্ষার কেন্দ্রীকরণকে চরম জায়গায় নিয়ে যাবে। এই নীতিতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতির পরীক্ষা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ পরীক্ষা, গবেষণা প্রকল্পের অনুমোদন প্রভৃতি বিষয়ে রাজ্যগুলির অধিকারকে খর্ব করে সরাসরি কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে দিয়ে পরিচালনা করা হবে। ইউজিসি দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সারাদেশে একটা সাধারণ অ্যাডমিশন টেস্ট নেওয়ার ব্যাপারে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এটা বেসরকারি কোচিং সেন্টারগুলিকে উৎসাহিত করবে এবং রাজ্য বোর্ডগুলি পরিচালিত স্কুল শিক্ষাকে আঘাত করবে।
বিজেপি শাসনে শুধু শিক্ষার বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণই ঘটছে না ক্রমবর্ধমানহারে পাঠ্যসূচির সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটছে। এনসিইআরটি’র নির্দেশে সিবিএসই’র পাঠ্যপুস্তক থেকে নাগরিকত্ব, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয়বাদ, প্রগতিশীল লেখকদের প্রবন্ধ বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যদিয়ে বিদ্যালয় পাঠ্যসূচি থেকে যুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক উপাদানকে ধ্বংস করা হচ্ছে। সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করে পাঠ্যসূচিকে সাম্প্রদায়িকীকরণ করার আরএসএস-বিজেপি’র চলতি প্রকল্প হলো এরইসাথে সম্পর্কিত।
শংকর মুখার্জি