E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৫ এপ্রিল, ২০২২ / ১ বৈশাখ, ১৪২৯

হাঁসখালিতে বর্বরতা

হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত


হাঁসখালি থানার বাইরে ছাত্র-যুবদের বিক্ষোভ।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির হাঁসখালি সংক্রান্ত বক্তব্যের সঙ্গে ধর্ষিতার বাবা মায়ের বয়ান এবং ওই মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ ঘিরে এই মুহূর্তে আলোড়িত পশ্চিমবঙ্গ। নদীয়ার হাঁসখালির দলিত দিনমজুর পরিবারের নাবালিকাকে দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত অসুস্থতার জেরে মৃত্যু এবং ধর্ষিতার মৃতদেহ ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়াই প্রমাণ লোপের জন্য পুড়িয়ে দেবার ঘটনায় ইতিমধ্যেই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। ন্যক্কারজনক এই ঘটনাটি ঘটে ৪ এপ্রিল। ৫ এপ্রিল ভোরে প্রবল রক্তক্ষরণের জেরে ওই ধর্ষিতার মৃত্যু হয়। অভিযোগ ১৪ বছরের ওই মুমূর্ষু নাবালিকাকে হাসপাতালে পর্যন্ত নিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি ভয় দেখিয়ে। ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হাঁসখালির স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য ও তৃণমূল নেতা সমর গয়ালীর ছেলে সোহেল (ব্রজ) গয়ালী। এদিকে সিবিআই তদন্তকে স্বাগত জানিয়েছেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। মুখ্যমন্ত্রীর ঘটনা সংক্রান্ত বক্তব্যেরও তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। ১১এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছিলেন ধর্ষিতার অভিভাবকদের অভিযোগ জানানোর ক্ষেত্রে দেরি হলো কেন তার যৌক্তিকতা নিয়ে। পুলিশমন্ত্রী হিসেবে তাঁর এই বক্তব্যের প্রসঙ্গে ধর্ষিতার বাবা-মা সহ পরিবারের অন্যদের এবং গ্রামবাসীদের পাল্টা বক্তব্যে এখন আরও জোরদার হয়েছে তদন্তকে প্রভাবিত করার অভিযোগ।

১২ এপ্রিল কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব এবং বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চ এই রায় দেবার পাশাপাশি সিবিআই-কে নির্দেশ দিয়েছে আগামী ২মে’র মধ্যে এই তদন্তের প্রাথমিক অগ্রগতির রিপোর্ট জমা করার এবং রাজ্য পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে তদন্ত কেন্দ্রিক যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ সিবিআই-এর কাছে তুলে দেওয়ার। ২ মে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে। একই সঙ্গে নির্যাতিতার পরিবার এবং এই ঘটনার সাক্ষীদের নিরাপত্তার দিকে নজর দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সিবিআই-কে।

হাঁসখালির নবম শ্রেণির ছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় রাজ্য পুলিশের তদন্ত নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন উঠছিল। দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ এড়িয়ে গিয়ে খুনের ঘটনা প্রমাণ করতে চাইছিল রাজ্য পুলিশ। অন্যদিকে এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে মুখ্যমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন সেই মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট যে, গোটা তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে চাইছে তৃণমূল সরকার - এই অভিযোগের পক্ষে মতামত জোরালো হতে শুরু করে গত ১১ এপ্রিল থেকেই।

প্রসঙ্গত, কলকাতার মিলন মেলায় একটি অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এই ঘটনা সম্পর্কে ১১ এপ্রিল মন্তব্য করেছেন, ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটির লাভ অ্যাফেয়ার্স ছিল। এটা ফ্যাক্ট। ডিজি সাহেব এখানেই আছেন। আমি যতটুকু ইনফরমেশন পেয়েছি। বাড়ির লোক জানতো। কে প্রেম করবে সেটা তার স্বাধীনতা। ঘটনা প্রকাশ্যে আনায় সংবাদ মাধ্যম সম্পর্কে বিরক্তি প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, পুলিশ এখনো জানতে পারেনি। দেখানো হচ্ছে একটা বাচ্চা মেয়ে মারা গেছে নাকি ধর্ষিত হয়। ধর্ষিত বলবেন? না প্রেগন্যান্ট বলবেন? না প্রণয়ঘটিত বলবেন? এটা অনুসন্ধান করেছেন কি? আমি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আমার কাছে ইনফরমেশন এলো ঘটনাটার। পুলিশ আমাকে বলেছে তদন্ত করছি। লোকাল থেকে জেনে বলছি। রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ থেকে পুলিশ তদন্ত শেষ করার আগে মুখ্যমন্ত্রীর এহেন বক্তব্যে অভিযোগ উঠছে তিনি সচেতনভাবে এই দুঃখজনক ঘটনার সঙ্গে অন্তঃসত্ত্বা, প্রেম, শরীর খারাপ ইত্যাদি শব্দ জুড়ে দিয়েছেন তদন্তকে প্রভাবিত করতে। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন অভিযোগ জানানোর দেরি প্রসঙ্গে যা খারিজ করে দিয়েছেন নাবালিকার বাবা-মা ও পরিবার।

মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে এমন নৃশংস ঘটনাকে বেপরোয়াভাবে লঘু করে দিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘‘মেয়েটি যখন মারাই গেল, কবে মারা গেল? ৫ তারিখ। পুলিশ জেনেছে কবে? ১০ তারিখ। ৫ তারিখ যদি কেউ মারা গিয়ে থাকে, তার মধ্যে কোনওরকম ‘কিন্তু’ থাকে, কারও কোনও অভিযোগ থাকে, তাহলে ৫ তারিখই অভিযোগ দায়ের করলেন না কেন?’’

মৃতার পরিবারের বক্তব্যে উঠে এসেছে অন্য কথা। হাঁসখালি থানা জানত গোটা ঘটনা। ৫ তারিখেই ঘটনার কথা জানতে পারে হাঁসখালি থানা। শুধু তাই নয়। সেদিন সকালে জোর করে তড়িঘড়ি নবম শ্রেণির ওই কিশোরীর দেহ পুড়িয়ে দেওয়ার পরে, দুপুরেই পরিবারের দু’জন থানায় গিয়েছিলেন তা জানাতে। হাঁসখালি থানা তাঁদের ফেরত পাঠিয়ে দেয়, অভিযোগ নেওয়া তো দূরের কথা। এক বার নয়। দু-দু’বার।

পুলিশেরই একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, তৃণমূলের সেই কীর্তিমান নেতা সমর গয়ালীর ভাগ্নে সিভিক ভলান্টিয়ার গোবিন্দ ঢালির প্রভাবে থানা অভিযোগ নেয়নি। সেই সিভিক পুলিশের এতটাই প্রভাব। সেদিন রাতে ধৃত সোহেল গয়ালীর সঙ্গে এই গোবিন্দ ঢালিও ছিল ধর্ষণের ঘটনার সময়ে। আরও জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যে হাঁসখালি থানার পুলিশ এই সিভিক ভলান্টিয়ারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ত‍‌বে গ্রেপ্তার করেনি। এলাকায় তাকে অবশ্য দেখাও যাচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে সাধারণ মানুষ বলছেন, প্রতিবাদী ছাত্রের হত্যাকাণ্ড থেকে হতদরিদ্র দিনমজুর পরিবারের নবম শ্রেণির ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাতেও অভিযুক্তের তালিকায় সিভিক ভলান্টিয়ার - রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার এক ভয়াবহ প্রবণতাই সামনে আসছে একের পর এক ঘটনায়।

এদিকে ১২ এপ্রিল আদালতের নির্দেশে হাঁসখালির ঘটনায় সিবিআই তদন্তকে স্বাগত জানিয়ে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, আমরা সিবিআই তদন্তকে স্বাগত জানাচ্ছি, কারণ আদালতের নজরদারিতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

হাঁসখালির ধর্ষণের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সম্পর্কে তীব্র নিন্দা করে তিনি বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন তার জন্য তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে, নইলে তিনি ওই পদে থাকার যোগ্য নন। কোনও শিশুর ওপরে এমন অপরাধের পরে পসকো আইনে এমন কথা বলা যায় না। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা হয়েও ধর্ষকদের পাশে দাঁড়িয়ে ধর্ষিতা ছাত্রীকে দোষারোপ করবেন? গোটা দেশে সঙ্ঘ পরিবার যা করছে এরাজ্যেও তাই ঘটছে।

সেলিম বলেছেন, দময়ন্তী সেনকে তদন্তভার দেওয়ায় ওদের জ্বালা ধরেছে। কারণ পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণের মামলায় তিনি মাথা উঁচু করে কাজ করেছিলেন। রাজ্যে পুলিশের এমন অবস্থা হয়েছে যে মুখ্যমন্ত্রী যা বলেন সেই অনুযায়ী পুলিশ কেস সাজাতে বাধ্য হয়। এই অবস্থায় সিবিআই তদন্ত ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না।

আবার হাইকোর্টে ১২এপ্রিল তৃণমুলপন্থী আইনজীবীদের দ্বারা বিশিষ্ট আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের হেনস্তার অভিযোগ প্রসঙ্গে মহম্মদ সেলিম বলেন, হাইকোর্টে এসএসসি এবং ধর্ষণের মামলায় যখন রায় হচ্ছে, তখন আদালতে মস্তান ঢুকিয়ে হামলা করা হয়েছে। আদালত যাতে নিরপেক্ষ না থাকে, পক্ষপাতিত্ব করে তার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। মোকদ্দমাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে, ভয় দেখানো, কেনার চেষ্টা করছে। বিচারপতিরা নিজেরাই বলেছেন।

অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির কুরুচিকর মন্তব্য সম্পর্কেই মঙ্গলবার সোজাসাপটা ভাষায় প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন নির্ভয়ার মা আশা দেবী। তিনি বলেছেন, মমতা ব্যানার্জি যদি ধর্ষণ সম্পর্কে এতটাই অসংবেদনশীল হয়ে থাকেন, তাহলে মুখ্যমন্ত্রীর পদের যোগ্যই নন তিনি। এই ধরনের মন্তব্য ধর্ষণের মতো অপরাধকে উৎসাহিত করে, নির্যাতিতার উপর প্রভাব ফেলে এবং মদত দেয় তাদের, যারা এমন অপরাধ করে। এই ধরনের রাজনীতিকরা শুধু নিজের ভোটব্যাঙ্কের কথা ভাবেন। আশা দেবী জোরের সঙ্গেই আরও বলেছেন, ওই ঘটনার যথাযথ তদন্ত হওয়া দরকার এবং অপরাধীদের শাস্তি হওয়া উচিত।

মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদিকা কণীনিকা ঘোষ। গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের সম্পাদক রজত বন্দ্যোপাধ্যায় এক বিবৃতিতে ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। কি ঘটেছিল ৪ তারিখ? বিভিন্ন সূত্র এবং মৃত নাবালিকার মা-বাবা-পরিজনদের বয়ানে জানা যাচ্ছে দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা পঞ্চায়েত সদস্য সমর গয়ালির ছেলে ব্রজ গয়ালির জন্মদিনের পার্টিতে ওই দিন ডাকা হয় নাবালিকাকে। সেখানে মদ খাইয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয় তাকে। সে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দুষ্কৃতীদের কয়েকজন রক্তাপ্লুত অবস্থায় বাড়ি পৌঁছে দেয়। রক্তক্ষরণে ধর্ষিতা নিস্তেজ হয়ে পড়লেওও তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেয়নি তৃণমূল বাহিনী। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে ওষুধ আনতে যাওয়ার পর ফিরে এসে নাবালিকার বাবা দেখেন মেয়ে মারা গেছে। এর পরই মাদুরে মুড়ে স্থানীয় এক‍‌টি স্বীকৃতিহীন শ্মশানে ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়াই পুড়িয়ে দেওয়া হয় প্রমাণ লোপ করতে। একাজে নেতৃত্ব দেয় ব্রজ গয়ালি এবং সিভিক ভলান্টিয়ার গোবিন্দ ঢালি। নাবালিকার মা-বাবাকে বাধ্য করা হয় তাদের মেয়েকে পোড়ানোর দৃশ্য দেখতে।

পিংলার কালুখাঁড়া সহ মাটিয়া, হাঁসখালি, নামখানা, বোলপুর সহ রাজ্যজুড়ে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, ধর্ষণের পর খুন করে পুড়িয়ে দিয়ে দেহ লোপাটের ঘটনাকে এবং রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর অশ্লীল ও কুরুচিকর মন্তব্যকে ধিক্কার জানিয়ে ধিক্কার মিছিল সংগঠিত হয় রাজ্যজুড়ে। ‘হাঁসখালি, কাকদ্বীপ, ভাঙর, বোলপুর রোজ বেড়ে চলেছে ধর্ষণ খুনের ঘটনা। এ কোন্‌ রাজ্য? ছিঃ! সমস্ত দোষীদের শাস্তি চাই, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই’। এই স্লোগানকে সামনে রেখে নদীয়া জেলা হাঁসখালিতে নাবালিকা ধর্ষণ সহ রাজ্যজুড়ে একের পর এক ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে মিছিল করলেন ছাত্র, যুব ও মহিলারা। এসএফআই, ডিওয়াইএফআই ও সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির উদ্যোগে প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কূশপুত্তলিকা পোড়ানোর কর্মসুচি ও জনসভা করার কথা ছিল এসএফআই’র। সেই সময়ই হঠাৎই তৎপর হয়ে উঠে পুলিশ মুখ্যমন্ত্রীর কুশ পুত্তলিকা নিয়ে পালিয়ে যায়। তারপরই এসএফআই কর্মী ও পুলিশের মধ্যে শুরু হয় বচসা ও ধস্তাধস্তি।