E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৫ এপ্রিল, ২০২২ / ১ বৈশাখ, ১৪২৯

তৃণমূলী জমানা-গণতন্ত্রের লজ্জা

কৌশিক মুখোপাধ্যায়


ভোট ‘উৎসবের’ ছোঁয়াচ।
বেলেঘাটায় ৩৩ নং ওয়ার্ডে সিপিআই(এম)-এর পোলিং এজেন্ট পূরবী দে বিশ্বাস।

আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি অত্যন্ত স্থূল অর্থে প্রধানত নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয় বলে চিহ্নিত করেই তুলে ধরা হয়। তাই শুধুমাত্র নির্বাচনের দিন হিংসা, বুথ দখল, রিগিং, বুথ জ্যাম, ছাপ্পা ভোট প্রভৃতি নির্বাচনী অসদুপায় অবলম্বন হলো কি হলো না একমাত্র তার উপর বিবেচনা করেই সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতার বিচার প্রক্রিয়া সংগঠিত হয়। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার এমন অসদাচরণ অবলম্বন করা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনাক্রম, নাকি একটা ব্যবস্থার অঙ্গ রূপেই আজ এ রাজ্যের শাসকের কাছে তা একপ্রকার বাধ্যবাধকতায় পরিণত? রাজ্যের বর্তমান শাসকদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে এমন দৃশ্যাবলীর অবতারণা কি পূর্ণমাত্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়?

বস্তুত, ঐতিহাসিক পরম্পরায় এ সত্য অনস্বীকার্য যে, কোনো শাসনতন্ত্রেই (তা যত আধুনিকই হোক না কেন) শাসকের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রুচি, শ্রেণিগত অবস্থান ও মতাদর্শগত চেতনার উপরেই সার্বিক গণতন্ত্রের প্রসার নির্ভরশীল। তথাকথিত রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্র বা আধুনিকতম সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও তা একইভাবে সত্য। কালের হাত ধরে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সংস্কৃতি যেমন সমাজে প্রবাহিত হয় তারই পাশাপাশি নব্যসংস্কৃতির ধারাও সেই সমাজকে প্রভাবিত করে। শাসকের সংস্কৃতি তাই তাৎক্ষণিকভাবে হলেও সমাজে সবথেকে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আবার কখনো কখনো সমগ্র সমাজে শাসকের সংস্কৃতির সুতীব্র অভিঘাতে কালের অতলে তলি‍য়ে যাবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় ঐতিহাসিকভাবে লালিত সামাজিক ঐতিহ্যও। আর সে সমাজে স্বাভাবিকভাবেই অকাতরে হারিয়ে যেতে থাকে আজন্মলালিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোও। সাধারণ মানুষের চেতনার অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকতে শাসকশক্তি এমন এক পরিবেশ কায়েম করে যেখানে সমাজের প্রচলিত ন্যায়-অন্যায়, শুভ-অশুভ বোধের স্বাভাবিক মাপকাঠিগু‍‌লোও প্রতিনিয়ত হারিয়ে যেতে থাকে।

আমাদের রাজ্যের সার্বিক সামাজিক পরিস্থিতি আজ ঠিক এই স্তরে উপনীত হয়েছে। শাসকের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ন্যূনতম শ্রদ্ধা, সচেতনতা বোধ যদি না থাকে তাহলে উক্ত শাসকের দ্বারা পরিচালিত প্রশাসনিক ও সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে ন্যূনতম গণতন্ত্রের উপস্থিতি থাকতে পারে কি? নির্বাচনী গণতন্ত্রের এমন সর্বব্যাপী অবক্ষ‌য় আজ তাই এ রাজ্যে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বর্তমান শাসকের সৌজন্যে রাজ্যের সার্বিক গণতান্ত্রিক পরিবেশের সাথে সাজুয্য রেখেই তা আজ স্বাভাবিকতায় পর্যবসিত।

চলছিল দেদার ছাপ্পা ভোট। বুথে ঢুকে রুখে দাঁড়ালেন
সিপিআই(এম) প্রার্থী মধুমিতা দাস। ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডে।

স্বাভাবিকভাবেই এমন ব্যবস্থার অভ্যন্তরে ন্যূনতম গণতন্ত্রের ছোঁয়া পাওয়াও কার্যত অসম্ভব। ফলত সেই সমাজে গণতন্ত্রের অবয়বটুকুই নানা প্রতিষ্ঠানের মোড়কে টিকে থাকে, কিন্তু তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও কার্যকারিতা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ১০৮টি পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মূল ধারার নানা সংবাদমাধ্যম থেকে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে দিনভর ভোটাধিকার প্রয়োগকে কেন্দ্র করে শাসকদলের তাণ্ডবের যে চেহারা উঠে এসেছে তার ভিত্তিতেই যদি এ রাজ্যের গণতান্ত্রিক চেহারাকে পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তাহলে তা কার্যত ‘অন্ধকে হস্তিদর্শনের’ সমতুল্যই হয়। বস্তুত তা এ রাজ্যের সার্বিক গণতান্ত্রিক বাতাবরণের এক অতি ক্ষুদ্র খণ্ডিত চিত্র মাত্র। গ্রাম-শহরজুড়ে গোটা রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই যে ব্যবস্থা আজকের শাসককুলের সৌজন্যে কায়েম হয়েছে তার নির্যাস যদি আমরা একত্রিত করি তাহলে কতগুলো সুস্পষ্ট লক্ষণ বা প্রবণতাকে চিহ্নিত করা যায়, যা জেলা, ব্লক, অঞ্চল ভেদে চরিত্রগত বা উপাদানগতভাবে একই -

১. শাসকদলের সব স্তরের জনপ্রতিনিধিরা প্রায় সকলেই পেশাগতভাবে রাজনীতিক, তারা বেশিরভাগই জীবনধারণের জন্য অন্য কোনো পেশার সাথে যুক্ত নন।

২. আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় সকলেরই বিপুল আয়, বিবিধ সম্পত্তির মালিক। কিন্তু সেই আয়ের উৎস কোন্‌ পেশা থেকে - জনসমক্ষে তা তারা নিজেরাও নির্দিষ্ট করতে পারবেন না।

৩. প্রত্যেকেই নিজ নিজ এলাকায় নিজ নিজ ক্ষেত্র চিহ্নিত করে নিয়েছেন এবং তার ভিত্তিতে আয়ের নির্দিষ্ট বন্দোবস্ত কায়েম করেছেন। এলাকার চরিত্র অনুযায়ী যেখানে যে ব্যবসায় কাঁচা পয়সা উড়ছে - প্রোমোটিং থেকে বালি খাদান, পাথর খাদান থেকে চাষের জমির মাটি বিক্রি, ইমারতি দ্রব্য সহ নানা ক্ষেত্রের সিন্ডিকেট, এমন হরেক পেশায় এরা সরাসরি সংযুক্ত। আবার এরই পাশাপাশি নানা সরকারি কাজের বরাত থেকে আমদানি তো শাসক হবার সুবাদে ‘অধিকারে’ পরিণত! যেখানে যেখানে টাকা আয়ের ন্যূনতম সম্ভাবনা রয়েছে, তা সে ছোটো-বড়ো শিল্পপতি থেকে স্থানীয় মাঝারি বা বড়ো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তোলা আদায়, রুটে টোটো, অটো বা রিকশা নামানোর অনুমোদন, হকার বসানো হোক বা পাড়ার শনি বা হনুমান মন্দিরের প্রণামীর ভাগ পর্যন্ত হরেক উপায়ে তৃণমূল নেতাদের ভেট না দি‍‌য়ে পার পাবার জো নেই। স্কুলের ক্লার্ক থেকে মাস্টারি সহ সরকারি চাকরির যেটুকু গত ১১ বছরে হয়েছে তাও নির্দিষ্ট নেট‍‌ওয়ার্কে উপযুক্ত উপঢৌকন দিয়েই তৃণমূলের কর্মীদের পর্যন্ত আদায় করতে হয়েছে। ফলে এ বাংলার সর্বত্রই দেখবেন তৃণমূলের মাঝারি থেকে বড়ো মাপের নেতা বা যে কোনো স্তরের জনপ্রতিনিধিদের ২০১১ সালের আগে এবং বর্তমানে আয়ের ব্যবধান চোখ ধাঁধিয়ে দেবার মতো।

৪. প্রতিটি নির্বাচনেই যে কোনো স্তরের জনপ্রতিনিধি তার মনোনয়ন থেকে নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত করার জন্য বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেন। ঠিক যেমনভাবে যে কোনো ব্যবসায় ব্যবসায়ীরা লগ্নি করেন একইভাবে‍‌ এরাও সে কাজ করেন। নির্বাচিত হয়ে আসার পর কড়ায় গণ্ডায় তা পুষিয়ে নেন। আর ঠিক এ কারণেই যে কোনো মূল্যে তাদের সকলকেই নির্বাচনে জয়লাভ করতেই হবে। না হলে আগামীদিনের রোজগারের বন্দোবস্তে প্রশ্ন চিহ্ন উঠে যাবে। বাংলা জুড়ে পুলিশ-প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন সহ সমগ্র প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে এবং একইসাথে দুষ্কৃতীবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে নিরঙ্কুশ, বিরোধীশূন্য নির্বাচনী জয়লাভ তাই এদের কাছে আজ একপ্রকার বাধ্যবাধকতায় পরিণত। গোটা তৃণমূল দলটাই এই চেতনায় লালিত এবং তার কর্মধারাও সেই অনুযায়ী পরিচালিত। মমতা ব্যানার্জিকে তার দলকে টিকিয়ে রাখতে গেলে এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা ছাড়া আজ আর কোনো গত্যন্তর নেই।

৫. প্রশাসনিক নানা ক্ষেত্রে অবৈধভাবে চূড়ান্ত স্বজনপোষণের নিরিখে প্রত্যেকেই নিজ নিজ এলাকার ছেলেমেয়েদের নানা অস্থায়ী পদে নিয়োগ করেন। যেহেতু বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশ-প্রশাসন সহ কার্যত সমস্ত সরকারি ক্ষেত্রেই স্থায়ী চাকরির অবলুপ্তি ঘটেছে ফলে এভাবে নিয়োগ হওয়া ছেলেমেয়েরা এই নেতাদের কাছে তাদের রোজগার বাঁচানোর তাগিদে যে কোনো কাজ করতে বাধ্য হন। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের নানা কাজে সরাসরি এদের ব্যবহার করা হয়। এর পাশাপাশি নেতারা এলাকায় এলাকায় মাস মাহিনার ভিত্তিতে বা নির্বাচনের সময়ে অস্থায়ী ভিত্তিতেও লোক নিয়োগ করেন। সব মিলি‍‌য়ে রাজনীতির মোড়কে প্রশাসনকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করে ব্যবসায়ি‌ক শ্রীবৃদ্ধির জন্য যা যা উপকরণ দরকার তার সফল প্রয়োগ ঘটিয়ে শাসকদলের সব স্তরের জনপ্রতিনিধিরা গোটা বাংলা জুড়ে লুঠতরাজের এক গণতান্ত্রিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।

ভোট ‘উৎসবের’ ক্ষত।
তৃণমূলের ছোঁড়া বোমার আঘাতে জখম যুবক। টাকি স্কুলের সামনে।

সামগ্রিকভাবে এ রাজ্যের যে কোনো এলাকায় গ্রাম-শহর নির্বিশেষে বর্তমান শাসকদলের সৌজন্যে যে দুর্বিনীত ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে তাতে গণতন্ত্র দুরস্ত,ন্যূনতম স্বাধীন সত্তায় মাথা উঁচু করে সাধারণ নাগরিকের জীবনধারণই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বাংলার রাজনীতিতে তৃণমূলের হাত ধরে বিপুল অর্থসম্মিলিত এমন এক রাজনৈতিক শ্রেণির উত্থান ও একাধিপত্য আজ কায়েম হয়েছে যা শিক্ষিত, সচেতন, রুচিশীল বাঙালির কাছে নিশ্চিতভাবে অসহনীয় -

ক. শাসকদলের নেতাদের প্রায় সকলের চেহারার মধ্যে একটা কদর্য বৈভবের ছবি আপনি দেখতে পাবেন। কারো শারীরিক অভিব্যক্তিকে ব্যঙ্গ করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যায় বাংলার নানা প্রান্তে গ্রাম-শহরে মূলত রঙ-বেরঙের রকমারি পাঞ্জাবি, গলায় সোনার মোটা চেন বা হাতে সোনার বালা পরিহিত প্রায় সকলেরই মেদবহুল, সুরালালিত একটা চেহারা আপনার নজরে আসবে।

খ. গত ৯-১০ বছরে বাংলার বুকে গজিয়ে ওঠা শাসকদলের এই শ্রেণির রাজনীতিকদের শরীরী ভাষা, তাদের হাব-ভাব, চলন-বলন, কাজের ধরনের সাথে অতীতের বাঙালি রাজনীতিবিদদের মেলানো কার্যত অসম্ভব। এদের মধ্যে বাঙালির শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রুচিশীলতার ন্যূনতম ছাপ কোনোভাবেই আপনার নজরে আসবে না। এরা রাজনীতি করেন কিন্তু কণামাত্র রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এদের মধ্যে নেই। বাঙালির রাজনৈতিক ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এই নব্য শ্রেণির আবির্ভাব ঘটানো তৃণমূলী জমানার কদর্যতম আখ্যান রূপেই ইতিহাসের পাতায় চিহ্নিত হতে বাধ্য।

স্বাভাবিকভাবেই এমন একটা শাসকদলের দ্বারা পরিচালিত ব্যবস্থার মাধ্যমে ন্যূনতম প্রশাসনিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা কায়েম করা কঠিনই নয়, বাস্তবত তা অসম্ভব। আনিস খান, তপন কান্দু, অনুপম দত্ত থেকে বগটুই-এর নারকীয় হত্যালীলা বা আনারুল, ভাদু, মোদ্দাসর, শেখ সুফিয়ান, সৌমিক হোসেন সহ দিকে দিকে শাসকদলের নেতা-নেত্রীদের প্রাসাদোপম বাড়ি বা বিপুল সম্পদ থেকে শিক্ষকতা সহ যে কোনো সরকারি চাকরিকে কেন্দ্র করেই যে নজিরবিহীন দুর্নীতির কথা প্রতিদিন আদালতে উঠে আসছে, লক্ষ করলে দেখা যাবে প্রতিটি ক্ষেত্রই একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। ন্যায়, নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধহীন রাজনীতি সমৃদ্ধ শাসক শক্তি দ্বারা পরিচালিত ব্যবস্থায় গণতন্ত্ররহিত, স্বৈরাচারী ও শৃঙ্খলাবিহীন এমন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাই যে অতি স্বাভাবিক - আজকের পশ্চিমবঙ্গ তার নির্মম সাক্ষী।