৫৯ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৫ এপ্রিল, ২০২২ / ১ বৈশাখ, ১৪২৯
ধীরে ধীরে বিজ্ঞান গবেষণায় ইতি ঘটাচ্ছে সরকার
তপন মিশ্র
কেন্দ্রীয় গবেষণা সংস্থাগুলিকে শেষ করার দিকে অগ্রসর হচ্ছে ভারত সরকার। কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর) ছাড়াও ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (ডিআরডিও), টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিএফআইআর), ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন (ইসরো), ডিপার্টমেন্ট অফ বায়োটেকনোলজি (ডিবিটি) ইত্যাদি গবেষণা সংস্থায় সরকারি বরাদ্দ ধাপে ধাপে কমিয়ে ফেলার চেষ্টা অব্যাহত।
২০২২-২৩ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রককে ১৪,২১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এই পরিমাণ গত বছরের তুলনায় ৩.৯ শতাংশ কম। এর সঙ্গে যদি মুদ্রাস্ফীতির কারণে ভারতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন যুক্ত হয় তাহলে অঙ্কটা ৭-৮ শতাংশের কাছাকাছি চলে যেতে বাধ্য। পাঠকদের মনে করিয়ে দিই যে, দেশের মৌলিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার সিংহভাগ অর্থ এই মন্ত্রক সরবরাহ করে। ফলে এই মন্ত্রকের বাজেটে বরাদ্দ হ্রাসের অর্থ হলো সরাসরি দেশের গবেষণার উপর আঘাত।
উল্লেখিত বাজেট বরাদ্দের মধ্যে দেশের বিভিন্ন গবেষণা বিভাগের যে পরিমাণ অর্থ পাওয়ার কথা তা হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ (ডিএসটি) ৬,০০০ কোটি টাকা, বায়োটেকনোলজি বিভাগ (ডিবিটি) ২,৫২৮ কোটি টাকা এবং বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা বিভাগ (ডিএসআইআর) ৫,৬৩৬ কোটি টাকা। কিন্তু তার পরেও সংশোধিত হিসাব অনুযায়ী ডিএসটি এবং ডিএসআইআর যথাক্রমে ৫,২৪০ কোটি টাকা এবং ৫,২৯৭ কোটি টাকা পাচ্ছে। অর্থাৎ বরাদ্দকৃত বাজেটের থেকে বেশ কিছুটা কম।
বিজ্ঞান গবেষণায় সরকারের সদিচ্ছা কতটা তা দেশের মোট বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ দেখলেই বোঝা যায়। এবছর কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক কেন্দ্রীয় বাজেটের অত্যন্ত সামান্য অংশ পেয়েছে। এবারে মোট কেন্দ্রীয় বাজেট হলো ৩৯,৪৪,৯০৮ কোটি টাকার। এই পরিমাণের মাত্র ০.৩ শতাংশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের ঝুলিতে পড়েছে। যদি সমস্ত কেন্দ্রীয় গবেষণা সংস্থায় প্রস্তাবিত বরাদ্দ যোগ করা হয় তাহলে এবারের বাজেটের তা হবে মাত্র ০.৭ শতাংশ - যা বরাদ্দ করা হয়েছে দেশের বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য। এই সময়কালে পশ্চিমী দেশগুলির কথা যদি নাই বা ধরি তাহলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে এশিয়ার অন্য দুটি দেশ যেমন চীন এবং জাপানের তুলনায় আমরা অনেক পিছনে। চীনের এই খাতে বরাদ্দ হলো দেশের মোট বাজেটের ২ শতাংশ এবং জাপানের ৩.২ শতাংশ। আমাদের দেশের আগের সরকার এবং বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল বিজ্ঞান প্রযুক্তির গবেষণা খাতে বাজেটের অন্তত ১ শতাংশ বরাদ্দ করার। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, কমপক্ষে ২ শতাংশ ব্যয় বরাদ্দ না হলে কোনো উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণায় সরকারি সাহায্য চাই কেন?
বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণা বিশ্ব-ব্যবস্থাকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে। কিছু ক্ষেত্রে, এই ধরনের গবেষণা শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন দিকের সূচনা করতে পারে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো চীন। এমনকী আজকের দিনে সরকার যে ‘স্টার্ট-আপ’ এবং ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের কথা বলছে তা অনেকটা মৌলিক গবেষণার উপর নির্ভর করে। গবেষণার বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ জরুরি হয়ে পড়ে কারণ কোনো বেসরকারি সংস্থা এক্ষেত্রে বিনিয়োগে করতে চায় না। এই ক্ষেত্রগুলি হলো জ্যোতির্বিজ্ঞান, পরমাণু গবেষণা, মহাকাশ গবেষণা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক উৎপাদনের সুযোগ কম এবং গবেষণা দীর্ঘমেয়াদি। তাই দেশের স্বনির্ভরতা এবং সার্বভৌমত্বের স্বার্থে বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণায় সরকারি বিনিয়োগ জরুরি।
বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে অন্য একটি গুরুত্বপুর্ণ চাহিদা হলো শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ। এবারে দেশের সব ধরনের শিক্ষাক্ষেত্র মিলিয়ে সম্মিলিত বাজেট বরাদ্দ হলো মোট বাজেটের মাত্র ২.৬ শতাংশ। এবছর বাজেটে বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে বরাদ্দ হয়েছে ৬৩,৪৪৯.৭২ কোটি টাকা এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ৪০,৮২৮.৩৭ কোটি টাকা। দেশের গবেষক, ছাত্র এবং সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি হলো শিক্ষার বাজটের অন্তত ৬ শতাংশ বরাদ্দ।
বন, পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন দপ্তরের ব্যয় বরাদ্দ এবারের বাজেটে রাখা হয়েছে ৩,০৩০ কোটি টাকা। ২০২১-এর তুলনায় এই পরিমাণ মাত্র ১৬০ কোটি টাকা বেশি। কিন্তু ২০২০-র তুলনায় ৭০ কোটি টাকা কম। দেশের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্যার মোকাবিলা করা, এই সংক্রান্ত গবেষণায় উৎসাহিত করা, ক্রমবর্ধমান দূষণ নিয়ন্ত্রণ, বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ এবং বন্যপ্রাণের আবাসস্থলগুলির উন্নতিসাধন ইত্যাদির চাহিদা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা সত্ত্বেও বাজেট বরাদ্দে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা যায়নি।
গোড়ায় গলদ
দেশের স্বনামধন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার বলেন যে, দেশে বিজ্ঞান গবেষণা এবং চেতনার ঘাটতির উৎস হলো বিদ্যালয় স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে পরীক্ষা নিরীক্ষার পরিকাঠামোর অভাব। বিজ্ঞান শিক্ষা কেবল পুঁথি নির্ভর জ্ঞান নয়। বিজ্ঞান পঠন-পাঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বিজ্ঞানাগারে হাতেকলমে বিজ্ঞান চর্চা। অর্থাভাবে বিদ্যালয়স্তরে এবং উচ্চশিক্ষায় যথেষ্ট পরীক্ষণ পদ্ধতির ব্যবস্থা আমাদের দেশে করা যায় নি। ফলে প্রথম থেকে ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান শিক্ষায় যে ঘাটতি শুরু হয় তা পরে পূরণ করা যায় না।
২০০৭ সালে ভারত সরকার বেঙ্গালুরু শহরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (আইআইএসটি) নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, যাঁরা এখান থেকে প্রশিক্ষিত হয়ে বেরোবেন তাঁদের ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো)-তে গবেষণায় নিযুক্ত করা হবে। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতা, বিশেষ করে মহাকাশ গবেষণার যে যে ধারায় ছাত্রদের দক্ষতা গড়ে ওঠে সেই সেই ধারায় গবেষণার কাজে তাঁদের নিযুক্ত করা হয় না। এই শিক্ষার্থীদের যে চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হয় তা হলো উত্তীর্ণ হওয়ার পর কমকরে ৩ বছরের জন্য ইসরো’তে গবেষণার কাজে যুক্ত থাকতে হবে। অন্যথায় তাদের নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ ফেরত দিতে হয়। কিন্তু উপযুক্ত গবেষণার সুযোগ না থাকায় ছাত্রছাত্রীরা ওই অঙ্কের টাকা ফেরত দিয়ে বিদেশে কোনো গবেষণা সংস্থায় যুক্ত হয়ে যায়। ফলে আইআইএসটি’র মতো শিক্ষা-গবেষণা সংস্থা তৈরি করেও দেশের তেমন কোনো লাভ হয় না। এই অপারগতার দায়ভার আমাদের ব্যবস্থার মধ্যেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
২০১৯ সালে অন্তরা সেনগুপ্ত ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখেন। তাঁর দেওয়া হিসেব অনুযায়ী ২০১৮ সালে দেশে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারায় মোট ১,৬১,৪১২ জন গবেষক নথিভুক্ত আছেন। এই সংখ্যা হলো, দেশে উচ্চশিক্ষায় যত ছাত্রছাত্রী সেই বছর যুক্ত হয়েছে তার মাত্র ০.৫ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে এই পরিমাণ আরও কমেছে। তার মূল কারণ হলো, গবেষণা ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দের হ্রাস। নিজের অর্থ খরচ করে এমনকী সরকারি বৃত্তি পেয়েও গবেষণার এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোনোর সাহস খুব কম ছাত্রছাত্রীই করে।
সিএসআইআর-এর কেরামতি
আমাদের দেশের কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর) নরেন্দ্র মোদির আত্মনির্ভর ভারতের অন্যতম কারিগর। এই সংস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় (কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য স্তরের), কেন্দ্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যে সমস্ত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী নেট (ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট - এনইটি) পরীক্ষায় পাস করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন ধারার গবেষণায় যুক্ত হবে তাদের বৃত্তি দিয়ে দেশের স্বনির্ভর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণাকে বিকশিত করা। ব্রিটিশ আমলে এই সংস্থা তৈরি হলেও স্বাধীনতার পর নেহরুর চেষ্টায় এটি দেশের বিজ্ঞান গবেষণার একটি নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে ওঠে। স্বাধীন ভারতে এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম অধিকর্তা ছিলেন শান্তিস্বরূপ ভাটনাগর। তাঁর চেষ্টায় এবং নেহরুর সহযোগিতায় স্বাধীনতার ৪/৫ বছরের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১২ টি কেন্দ্রীয় গবেষণা সংস্থা তৈরি হয়।
এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান হাল আত্মনির্ভর ভারতের গোড়ায় এক বড়ো আঘাত বললে কম বলা হবে। ২০২০ সালে লকডাউন শুরুর পর থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলির গবেষকদের বৃত্তি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ‘The Wire Science’ পত্রিকায় এই তথ্য প্রকাশিত হয় (২৯-০৬-২০২০ সংস্করণ)। দেশজুড়ে এই সংস্থায় ৮,০০০ থেকে ৮,৫০০ গবেষক আছেন। করোনা সংক্রমণের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই কারণ সরকারের এই সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি গবেষণা সংস্থার গবেষকদের বৃত্তি আবার ২০১৯ সালের নভেম্বর মাস থেকে বকেয়া পড়ে আছে।
সিএসআইআর-এর বাইরের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা সংস্থা যেমন টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এর কলকাতার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালে একটি বিজ্ঞপ্তি দেখা গেছে। তাতে বলা হয় যে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মাসিক বৃত্তির মাত্র অর্ধেক গবেষকদের দেওয়া হবে (TFIR Notice; 6 March, 2019)। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পরই গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা শুরু হয়েছে।
একটি সূত্র থেকে পাওয়া খবর বলছে যে, দেশের ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ডিএসটি) ২০১৯-এর আগে বছরে গড়ে ২৫০টি গবেষণা প্রকল্পের অনুমোদন দিত। ২০১৯ সালের পর থেকে গবেষণা প্রকল্পের অনুমোদনের পরিমাণ এক ধাক্কায় কমে গড়ে ১০০টি হয়েছে।
গবেষণার আর্থিক বরাদ্দ কমিয়ে কোন্ আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন দেখছে বিজেপি সরকার? সরকার যদি গবেষণায় উৎসাহ না দেয় তবে বেসরকারি এবং বিদেশি সংস্থাগুলির উপর দেশের নির্ভরশীলতা বাড়তে বাধ্য। ঠিক এমনটাই হলো কোভিড টিকা তৈরির ক্ষেত্রে। দেশীয় গবেষণা সংস্থাগুলির অর্থাভাব করপোরেটদের উৎসাহিত করেছে টিকা তৈরির গবেষণায়। ফলে দেশের মানুষের দুর্দশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের মানুষের সামনে এই বঞ্চনার কথা তুলে ধরতে না পারলে দেশের সর্বনাশ আসন্ন।