৫৮ বর্ষ ২২শ সংখ্যা / ১৫ জানুয়ারি ২০২১ / ১ মাঘ ১৪২৭
সুপ্রিম কোর্টের তৈরি করে দেওয়া কমিটি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে
কৃষক আন্দোলন চায় কৃষি আইন প্রত্যাহার
কৃষি আইনের কপি পোড়াচ্ছেন কৃষকরা।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ১২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রের তিন কৃষি আইনের রূপায়ণ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করলেও তাতে কৃষকের অসন্তোষ প্রশমিত হওয়া তো দূরের কথা বরং তারা এই আইন সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবিতে অনড় থেকে আন্দোলনকে আরও তীব্রতর ও প্রসারিত করার শপথ নিচ্ছেন। ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে কিষান প্যারেড অনুষ্ঠিত করার প্রস্তুতিতে এতটুকুও ছেদ পড়েনি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আপাতত বিষয়টিকে ধামাচাপা দেবার একটা চেষ্টা বলেই কৃষকনেতারা মনে করছেন। কারণ এই নির্দেশ কৃষকদের মূল দাবির ধারে কাছে যায়নি। ক্ষোভে, অসন্তোষে ১৩ জানুয়ারি অবস্থানরত কৃষকরা সহ গোটা দেশের কৃষকসমাজ প্রতিবাদ স্বরূপ কৃষি আইনের কপি পুড়িয়ে তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
দেশের শীর্ষ আদালত এই আইনগুলি খতিয়ে দেখার জন্য চার সদস্যের কমিটি তৈরি করে দিয়েছে। প্রধান বিচারপতি এসএ বোবদে, বিচারপতি এএস বোপান্না, ভি রামসুব্রহ্ম্যণমকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ একগুচ্ছ আবেদনের প্রেক্ষিতে এই নির্দেশ দিয়েছে। আন্দোলনে থাকা কৃষক সংগঠনগুলি কেউই মামলায় না গেলেও পাশ হওয়া কৃষি আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও কয়েকটি আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে। এ সম্পর্কে এআইকেএসসিসি’র পর্যবেক্ষণ, এটি একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা, স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। এআইকেএসসিসি’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পূর্বঘোষণা মতো কৃষক আন্দোলনের কর্মসূচি বহাল থাকবে এবং ২৬ জানুয়ারি সারা দেশে সাধারণতন্ত্র দিবস উদ্যাপন সহ রাজধানী দিল্লিতেও শান্তিপূর্ণভাবে ‘কিষান প্যারেড’ বের করবে কৃষক সংগঠনগুলি। উল্লেখ্য, কৃষক সংগঠনগুলি আগেই স্পষ্ট জানিয়েছে সাধারণতন্ত্র দিবসের সরকারি প্যারেড শেষ হবার পরে তারা কৃষক প্যারেড করবে। তাদের অভিযোগ, এব্যাপারেও আদালতকে ভুল বোঝাতে উঠেপড়ে লেগেছে সরকার।
রায়ের ফলে কৃষি আইনের রূপায়ণ শীর্ষ আদালতের পরবর্তী নির্দেশ পর্যন্ত স্থগিত করা হলো মাত্র, ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য’ নয়। যে চারজনকে সুপ্রিম কোর্ট ওই কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছে, তারা প্রত্যেকেই কেন্দ্রের কালা কানুনগুলির ঘোষিত সমর্থক হিসেবে সুপরিচিত। এই কমিটিকে দু’মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু শীর্ষ আদালতের নির্দেশে বিশদে একথাও রয়েছে যে, আদালত গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সংশোধনী আনা হবে এবং কমিটি গড়ে দেবার পাশাপাশি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য যেমন ছিল তেমন থাকবে এবং চুক্তিচাষে কোনো কৃষকের জমি নেওয়া যাবে না।
তাৎপর্যপূর্ণ হলো, শীর্ষ আদালত বর্তমান কৃষক আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ বলে আখ্যা দিলেও আদালতের আজকের নির্দেশের পরে তা আর চলা উচিত কিনা, তা নিয়ে মন্তব্য করেছে। আদালত বলেছে, কৃষকরা কোনো হিংসার পথে যাননি। কিন্তু অসুস্থ হয়ে, আত্মঘাতী হয়ে মৃত্যু হয়েছে। বাইরের কেউ হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কণ্ঠরুদ্ধ করতে চাইছি না, কিন্তু আজকের রায় ‘সাধারণ রায় নয়’। যে লক্ষ্যে কৃষকরা প্রতিবাদ করছিলেন আইন স্থগিত থাকায় সেই উদ্দেশ্য অন্তত এখনকার মতো সাধিত হয়েছে। এরপর আশা করা যায় কৃষকরা তাঁদের জীবনজীবিকায় ফিরে যাবেন। কৃষকদের নিজেদের জীবন এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় এবং অন্যদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় ফিরে যেতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ সম্পর্কে এআইকেএসসিসি’র পর্যবেক্ষণ, “...এটি একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা, স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। যে কোনোদিন ফের এই আইন জারি করা যাবে। সকলকে বুঝতে হবে, ভারতের জনগণ এবং কৃষকসমাজ এই আইনের তীব্র বিরোধী। তাই অবশ্যই এই আইন তিনটি খারিজ করা উচিত সরকারের।’’
কেন্দ্রের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করে এআইকেএসসিসি’র বক্তব্য, তিন কৃষি আইনের কুফল সম্পর্কে কেন্দ্রকে স্পষ্টভাষায় নিজেদের ব্যাখ্যা জানিয়েছেন আন্দোলনকারী কৃষকরা। এই আইন কার্যকর হলে কৃষি উপাদান তথা চাষের খরচ আরও বাড়বে। কৃষকের ঋণ আরও বাড়বে। ফসলের দাম আরও কমবে। গণবণ্টন ব্যবস্থার বিদায়ঘণ্টা বাজবে। খাদ্যসামগ্রীর দাম আরও বাড়বে। আরও বেশি সংখ্যক কৃষক ও খেতমজুর আত্মঘাতী হবেন। অনাহারে মৃত্যু বাড়বে। ঋণজালে জড়িয়ে আরও কৃষক জমি হারাবেন। অথচ এই রূঢ় বাস্তবের দিকটি দেশের মানুষ, এমনকি আদালতের কাছেও কেন্দ্রীয় সরকার লুকিয়ে রাখছে বলে অভিযোগ করেছে এআইকেএসসিসি।
শীর্ষ আদালতের গড়ে দেওয়া এই কমিটির সদস্যরা হলেনঃ ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের একটি গোষ্ঠীর নেতা ভূপিন্দার সিং মান, অর্থনীতিবিদ অশোক গুলাটি, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের দক্ষিণ এশিয়ার অধিকর্তা প্রমোদ কুমার যোশী, শ্বেতকারী সংগঠনের অনিল ঘানোয়াত। এহেন ব্যক্তিদের নিয়েই কমিটি গঠনের পরে সংযুক্ত কৃষক মোর্চা বলেছে, দেশের শীর্ষ আদালত কমিটিতে অন্তত একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকেও রাখল না, তা অত্যন্ত দুঃখের। তবে যে কারণেই কমিটি হোক, এর সঙ্গে কৃষকদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। এই চারজনই কৃষি আইনের সমর্থক। ভূপিন্দার সিং মান ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র তোমরের সঙ্গে দেখা করে কিছু সংশোধনী সহ কৃষি আইন রূপায়ণের দাবি জানিয়েছিলেন। মহারাষ্ট্রের শ্বেতকারী সংগঠনের নেতা ঘানোয়াত প্রকাশ্যেই এই তিন আইনের সোচ্চার সমর্থক। এই আইন কৃষকদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। অর্থনীতিবিদ অশোক গুলাটি টেলিভিশন চ্যানেলে এই আইনের পক্ষে সওয়াল করছেন, সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লিখছেন। প্রমোদ কুমার যোশী সম্প্রতি প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তিন আইনের ঢালাও প্রশংসা করে একথাও লিখেছেন যে, রাজনৈতিক শক্তিগুলি এর বিকৃত ভাষ্য হাজির করে কৃষকদের বিপথে চালিত করছে।
১১ জানুয়ারি শীর্ষ আদালত কেন্দ্রকে এই আইন স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়ে জানায় অন্যথায় তারাই হস্তক্ষেপ করবে। ওই দিনই কমিটি গঠনের ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছিল। প্রতিবাদকারীদের তরফে আইনজীবীরা ১১ জানুয়ারি ভার্চুয়াল শুনানির সময়ে আবেদন করেছিলেন এ বিষয়ে প্রতিবাদকারী সংগঠনগুলির মতামত জানানোর জন্য ১২ জানুয়ারি শুনানি করা হোক। কিন্তু শুনানি ধার্য হয়নি। প্রতিবাদকারী কৃষকদের আইনজীবীরাও ১২ তারিখের শুনানিতে সেই কারণে অংশ নেননি। কার্যত একতরফাই নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের এদিনের নির্দেশের পরে পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টে যাদের দিয়ে আবেদন করানো হয়েছিল তারা কেউই কৃষি আইনের স্পষ্ট বিরোধী নন। মামলা করানোর জন্যই তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। আইন স্থগিত রাখায় কেন্দ্র ধাক্কা খেয়েছে, একথা ঠিক। তবে আদালতের মাধ্যমে কেন্দ্র সাময়িক রেহাইও পেয়ে গেল। সম্মিলিত কৃষক আন্দোলনের সামনে কেন্দ্রের অবস্থান দুর্বল হয়েই আসছিল। আদালত কমিটি গঠন ও মধ্যস্থতার রাস্তা নেওয়ায় কেন্দ্র নিজের দায়িত্ব আদালতের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার সুযোগও পেল। দু’টি সফল সাধারণ ধর্মঘটে শ্রমিক-কৃষকের দেশজোড়া সার্বিক অংশগ্রহণ একটি ইতিবাচক দিক। বিজেপি আরএসএস-এর হিন্দুত্ব প্রত্যাখ্যাত দিল্লির সীমানাতেই। শুধুমাত্র কৃষক এই পরিচয়ে গড়ে উঠেছে ব্যাপকতর সার্বিক ঐক্য। কৃষক পরিচয়েই ঐক্যবদ্ধ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অন্নদাতারা - এমনটা আগে ঘটেনি। শ্রেণি ঐক্য ও শ্রমিক কৃষক মৈত্রী গড়ে ওঠার সবক’টি বৈপ্লবিক উপাদান সক্রিয়তর হয়ে ওঠার রোজনামচার মুখে থমকে গেছে কর্পোরেট ভজনা। তাই রাষ্ট্রশক্তি চ্যালেঞ্জের সামনে আচমকা নিজেদের আবিষ্কার করেছে কার্যত নিধিরাম এর ভূমিকায়। প্রশাসনিক বলপ্রয়গের জন্য দাতঁ-নখ বার করার আগে দ্বিধাগ্রস্ত কেন্দ্রীয় সরকার। কিষান প্যারেডের কর্মসূচির সাফল্য মানে সেটাই কর্পোরেট সারথি হিন্দুত্বের রথের চাকা আক্ষরিক অর্থেই বসে যেতে চলেছে গুণগতভাবে তা বুঝেই বিচারব্যবস্থার শরণাপন্ন হতে হয়েছে মোদি শাহদের তল্পিবাহকদের একথা বলছেন পর্যবেক্ষকরাও।
কেন্দ্রীয় সরকার যে কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে এখনও অসত্য প্রচারেই ব্যস্ত। একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটর্নি জেনারেল কেকে ভেনুগোপাল বলেন, খালিস্তানীরা এই আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আদালত সেই মর্মে নির্দিষ্ট হলফনামা দিতে বলেছে কেন্দ্রকে।
২৬ জানুয়ারি কৃষকরা রাজধানীতে যে ট্রাক্টর প্যারেডের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, তা নিয়েও আদালতে প্রশ্ন তুলেছে কেন্দ্র। দিল্লি পুলিশকে দিয়ে একটি আবেদন করানো হয়েছে যাতে এই কর্মসূচি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১১ জানুয়ারি শুনানির সময়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, কৃষকরা সাধারণতন্ত্র দিবসের কর্মসূচি বানচাল করার চেষ্টা করছে। প্রতিবাদী কৃষকদের তরফ থেকে আইনজীবী দুষ্যন্ত দাভে উত্তর দিয়েছিলেন, দিল্লির সীমান্তে যাঁরা বসে আছেন তাঁদের প্রায় সকলেরই পরিবারের একজন জওয়ান। কখনোই সাধারণতন্ত্র দিবসের কর্মসূচি তাঁরা বানচাল করবেন না। অ্যাটর্নি জেনারেল ১২ জানুয়ারি বলেন, রাজধানীতে এক লক্ষ লোক ঢুকবেন এ হতে দেওয়া যায় না। তাঁরা কোথায় যাবেন তার কোনও ঠিক নেই। আদালত বলে, নিয়ন্ত্রণ করা পুলিশের কর্তব্য। সঙ্গে সঙ্গেই কৃষক প্যারেডের ওপরে দিল্লি পুলিশ স্থগিতাদেশ চাইলে এ নিয়ে ১৮ জানুয়ারি শুনানি হবে বলে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে।