৫৮ বর্ষ ২২শ সংখ্যা / ১৫ জানুয়ারি ২০২১ / ১ মাঘ ১৪২৭
এক দেশ, একটি নির্বাচন - গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি হুমকি
ভারতের সংবিধান ও সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপরে আরও একটি গুরুতর আঘাত হানার পরিকল্পনা করছে মোদী সরকার তথা বিজেপি।
‘এক দেশ, একটি নির্বাচন’ ধারণাটির ব্যাপক প্রচারের লক্ষ্যে গত ডিসেম্বরের (২০২০ সাল) শেষ সপ্তাহে ২৫টি ওয়েবনিয়ার (অনলাইন সভা) পরিচালনা করেছে বিজেপি। ‘এক দেশ, একটি নির্বাচন’ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মাঝে মধ্যেই যে সরকারি বার্তা দিয়ে থাকেন, ওই সভাগুলি সেই প্রেক্ষাপটেই করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সরকারি বার্তা ছিল ২৬ নভেম্বর, প্রিসাইডিং অফিসারদের ৮০তম সম্মেলন মঞ্চে। আর, ওই দিনটি হলো সংবিধান দিবস।
লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচন একযোগে করার পক্ষে ওয়েবনিয়ারগুলিতে বিজেপি যে সমস্ত যুক্তি তুলে ধরেছিল সেগুলি আদতে বহু মানুষের কাছে পরিচিত - পুরনো কথা। একযোগে নির্বাচন হলে অনেক খরচ বেঁচে যাবে; বারবার নির্বাচন হওয়ায় আদর্শ নির্বাচনবিধি মানতে গিয়ে উন্নয়নের কাজ ব্যাহত হচ্ছে ও তার থেকে সরকারি আধিকারিকদের মনোযোগ সরে যাচ্ছে; ইত্যাদি, ইত্যাদি। কোনো একটি ওয়েবনিয়ারে বিজেপি’র একজন সাধারণ সম্পাদক ভূপেন্দ্র যাদব বলেছেন, ‘‘নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের একটি হাতিয়ার মাত্র, কিন্তু নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি তুলে ধরছে যে এটাই হলো কোনো গণতন্ত্রের একমাত্র উদ্দেশ্য। শাসন পরিচালনার কাজ পিছিয়ে পড়ছে।’’
এই বক্তব্যের অন্তর্নিহিত বার্তা হলো, ঘন ঘন নির্বাচন গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো নয়, বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা। কৃষকদের সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে নীতি আয়োগের মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক (সিইও) অমিতাভ কান্ত এই লাইনে বক্তব্য রেখে বলেছেন যে, ভারতে অত্যন্ত বেশিমাত্রায় গণতন্ত্র আছে। এই বার্তাটি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার - ‘এক দেশ, একটি নির্বাচন’ ঘোষণাটি হলো ‘একটি দেশ, একজনই নেতা’ স্লোগানের যৌক্তিক অবলম্বন। আর, নেতা মহাশয় ঘোষণা করেছেন, এটা ‘‘কোনো বিতর্কের বিষয় নয়, এটা ভারতের পক্ষে আবশ্যিক।’’
সমস্ত স্তরের নির্বাচনকে একযোগে অনুষ্ঠিত করা (কিছু বিজেপি নেতা চান, স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচনগুলিও রাজ্য ও জাতীয় নির্বাচনের সাথে একযোগে হোক), এবং তার জন্যে প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধনগুলি দেশের সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থার মূলগত পরিবর্তন ঘটাবে ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণাটিকে সমূলে ধ্বংস করে দেবে। লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচন একযোগে করতে হলে সেই সাংবিধানিক বন্দোবস্তকে কেটেছেঁটে দিতে হবে যা আইনসভার কাছে সরকারের দায়বদ্ধতার কথা বলে। সংবিধান অনুযায়ী, কোনো সরকার যদি অনাস্থা প্রস্তাবে পরাজিত হয়, অথবা, অর্থবিলের ওপরে ভোটাভুটিতে হেরে যায়, তাহলে তারা পদত্যাগ করতে বাধ্য; এবং কোনো বিকল্প সরকার সেক্ষেত্রে গঠন না করা গেলে আইনসভা ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন করা হবে। লোকসভার জন্যে, বা রাজ্য বিধানসভাগুলির জন্যে সুনির্দিষ্টভাবে স্থায়ী কোনো মেয়াদের ব্যবস্থা সংবিধানে বলা নেই।
২০১৭ সালে নীতি আয়োগ তার ‘আলোচ্য দলিল’টিতে এবং ২০১৮ সালে আইন কমিশন তাদের খসড়া প্রতিবেদনে একগুচ্ছ প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। এই প্রস্তাবগুলির সবক’টিই হলো কিছু কিছু রাজ্য বিধানসভার মেয়াদ খর্ব করা, কোনো কোনো রাজ্য বিধানসভার মেয়াদ বৃদ্ধি করা যাতে তাদের নির্বাচনগুলি লোকসভা নির্বাচনের সাথে একযোগে করা যায়, অথবা তা না হলে, পাঁচ বছর সময়পর্বে মাত্র দু’বারে সমস্ত নির্বাচন করা যায় - এর বেশি কিছু নয়। বিধানসভার মেয়াদ ছাঁটাই করা, অথবা তা বৃদ্ধি করা, দু’টোই হলো তীব্রভাবে অগণতান্ত্রিক এবং আইনসভার সদস্য নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নাগরিকদের যে অধিকার, তা নস্যাৎ করে দেওয়া। অন্তর্বর্তী সময়ে আইনসভা ভেঙে দেওয়া ও তার পরিণতি হিসাবে নতুন নির্বাচন করার বিষয়কে ঠেকাতে তার মেয়াদের স্থায়িত্বের সুপারিশ করা হচ্ছে। এর তাৎপর্য ভয়ঙ্কর। নীতি আয়োগের দলিলটির একটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, লোকসভা ভেঙে দেওয়ার প্রসঙ্গটি যদি এড়ানো না যায় এবং তার মেয়াদ শেষ হতেও যদি বেশি দিন বাকি না থাকে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি দেশে প্রশাসন চালাবেন এবং সেই কাজে তাঁকে পরামর্শ দেওয়া ও সহযোগিতা করার জন্যে তিনি একটি মন্ত্রী পরিষদ নিয়োগ করবেন; পরবর্তী লোকসভা গঠিত হওয়ার আগে পর্যন্ত এই বন্দোবস্ত চলবে। এই জঘন্য প্রস্তাব আদতে রাষ্ট্রপতিকেই প্রশাসনের সর্বময় কর্তারূপে পরিণত করবে। এই প্রস্তাব রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রশাসনিক বন্দোবস্তকে পিছনের দরজা দিয়ে অনুপ্রবেশ করাচ্ছে। এই একই পন্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে রাজ্য বিধানসভাগুলির ক্ষেত্রেও; সেক্ষেত্রে একটি স্বল্পমেয়াদের জন্যে রাজ্যপাল প্রশাসনের দায়িত্বভার গ্রহণ করবে।
মেয়াদের স্থায়িত্বের অর্থ হবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই সরকার চালাচ্ছে এমন একটি দল বিধানসভা ভেঙে দিয়ে আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার পক্ষে সুপারিশ জানাতে পারবে না। আইন কমিশনের প্রতিবেদনেও প্রস্তাব করা হয়েছে, লোকসভায় যদি কোনো অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়, তাহলে তার সাথে সাথে জানাতে হবে বিকল্প সরকার পরিচালনা করবেন এমন নেতার নাম। এই বিষয়টিকে বলা হচ্ছে ‘অনাস্থার পক্ষে গঠনমূলক ভোট’। এর অর্থ হবে, লোকসভার সদস্যদের ভোটে যদি কোনো সরকারের পতন ঘটে, তাহলে সেক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে একটি বিকল্প সরকার গড়তে হবে, এমনকি তা একটি কোয়ালিশন সরকার হলেও চলবে; তা সে জনগণের পছন্দ অপছন্দের পরিপন্থী হলেও তা করতে হবে। এক্ষেত্রে মুখ্য বিষয় হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে মেয়াদের স্থায়িত্বের মারফত স্থিতিশীল বন্দোবস্ত, আর নির্বাচনী পছন্দ-অপছন্দ হয়ে দাঁড়াচ্ছে অপ্রাসঙ্গিক।
এই ধরনের একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে রাজ্য আইনসভাগুলি ও রাজ্যগুলির ওপরে কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ। একটি সরকার তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে আইনসভা ভেঙে দেওয়ার যে ক্ষমতা তা ছেঁটে দেওয়ার পরে পাঁচ বছর মেয়াদের স্থায়িত্ব রক্ষার জন্যে প্রয়োজন হবে একটি বিকল্প সরকার গঠন করা। এই ধরনের একটি সরকার গঠন রাজ্যপালের একচেটিয়া খেয়ালের বশে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। তিনিই ঠিক করতে পারবেন, সরকার গঠনের জন্যে কোন্ নেতাকে ডাকা হবে। তার সাথে সাথে নির্বাচনের মুখোমুখি হওয়ার ভয় মুক্ত হয়েই সাংসদ বা বিধায়কদের এ দল-ওদলে যাওয়ার লাইসেন্স হয়ে উঠবে এই স্থিতিশীল মেয়াদের বন্দোবস্ত।
জগদীপ ধনকড়, ভগৎ সিং কোশয়ারি ও আরিফ মহম্মদের মতো রাজ্যপালের উদাহরণ থাকায় যেকোনো মানুষ মাত্রই কল্পনা করতে পারেন, তাঁরা কেন্দ্রের দলীয় রাজনীতির হাতিয়ার রূপে কাজ করতে পারলে কী ভয়ানক কাণ্ড ঘটাতে পারবেন।
সংসদ ও বিধানসভাগুলির নির্বাচন একযোগে করতে হলে সংবিধানকে ঢেলে পরিবর্তন করতে হবে। সংবিধানের ধারা ৮৩ (লোকসভার মেয়াদ), ধারা ৮৫ (লোকসভা ভেঙে দেওয়া), ধারা ১৭২ (রাজ্য বিধানসভাগুলির মেয়াদ), ধারা ১৭৪ (রাজ্য বিধানসভা ভেঙে দেওয়া), ধারা ৩৫৬ (সাংবিধানিক কাঠামো ভেঙে পড়া) সংশোধন করতেই হবে। তার সাথে সাথে জনপ্রতিনিধি আইন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নিয়মগুলিরও বাধ্যতামূলক সংশোধন করতে হবে।
বিজেপি’র ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশ্তিহারে প্রথম ছাপা হওয়ার পর থেকে তারা এই ‘এক দেশ, একটি নির্বাচন’ ধারণাটিকে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করে চলেছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি উভয়েই তাঁদের সরকারি অবস্থান থেকে এই ধারণাটিকে সমর্থন জানিয়েছেন। বিজেপি’র বর্তমান জোরালো অবস্থান ও প্রচার (ইঙ্গিত দিচ্ছে) এই অভিমুখে যাওয়ার একটি গুরুতর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ কথাটি ভেবে নেওয়া ভুল হবে যে, শাসকদলের কর্তৃত্ববাদী অগ্রগমনের মুখে সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনগুলি প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ৩৭০ ধারা বাতিল করা এবং জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে টুকরো করে দেওয়ার বিষয়গুলি চরিতার্থ করতে যে সাংবিধানিক ছল-চাতুরির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে আমরা তার সাক্ষী থেকেছি।
মোদী সরকার সংসদে যখন এপ্রসঙ্গে কোনো পদক্ষেপ নেবে, বিরোধীপক্ষ যেন তখন অনবগত না থাকে; তা সে যখনই হোক। বিশেষ করে কংগ্রেস দলকে এবিষয়ে মনযোগী হতে হবে, কেননা ৩৭০ ধারা বাতিলের ক্ষেত্রে তাদের দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থার চরম ফায়দা তুলেছিল বিজেপি।
এই ‘এক দেশ, একটি নির্বাচন’ নামধারী কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আঞ্চলিক দলগুলি, বিশেষত যারা রাজ্যগুলিতে ক্ষমতাসীন আছে। রাজ্য সরকারগুলির জন্যে এক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ স্বাধীনতা থাকবে। মেয়াদ ফুরানোর আগেই বিধানসভা ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার প্রস্তাব দেওয়ার মতো গণতান্ত্রিক নিয়মগুলির অনুশীলন, অথবা বিধানসভা নির্বাচনের জন্যে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা গঠন করার মতো কাজ সেক্ষেত্রে চাপা পড়ে যাবে - বিধানসভার নির্বাচনকে বাগড়া দেবে লোকসভার জন্যে কেন্দ্রীয় স্তরের নির্বাচন।
ওডিশার বিজু জনতা দল, তেলেঙ্গানার টিআরএস এবং অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইআরএস কংগ্রেস পার্টির মতো দলগুলির অলসতা ও সুবিধাবাদের কারণেই রাজ্যের অধিকারগুলির ওপর এত আক্রমণ চালিয়েও মোদী সরকার পার পেয়ে গেছে। তাদের জাগরুক হতে হবে এবং এই দানবীয়, অগণতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিপন্থী পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে হবে। বিরোধী শক্তির বাদবাকি অংশের সাথে তারা যদি হাত মেলায়, তাহলে বিজেপি’র এই আইন তৈরির চাতুরিকে পরাস্ত করা যাবে।