৫৮ বর্ষ ২২শ সংখ্যা / ১৫ জানুয়ারি ২০২১ / ১ মাঘ ১৪২৭
স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মচর্চায় কোনো সাম্প্রদায়িকতা ছিল না
নিজস্ব প্রতিবেদনঃ বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস দল প্রতিক্রিয়াশীল দলীয় রাজনীতির স্বার্থে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতায় মত্ত হয়ে সামাজিক বিভাজন তীব্র করতে কয়েক বছর ধরেই তৎপর। বিজেপি এতই অধঃপতিত যে, এই নিকৃষ্ট কাজে তারা স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা ও বাণীকে বিকৃতভাবে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ন্যায্যতা প্রমাণ করতে চায়। তৃণমূল কংগ্রেস দল বিজেপি’র সাথে তরজায় নেমে সেই কাজে ইন্ধন জুগিয়ে চলে।
১২ জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে এই দুই দলের প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উৎকট চেহারা আবার প্রত্যক্ষ করা গেল।
স্বামী বিবেকানন্দের কিছু বাণী ও শিক্ষা এখানে উদ্ধৃত করা হলো। এগুলি অনুধাবন করলেই প্রকৃত স্বামী বিবেকানন্দকে উপলব্ধি করা যাবে।
সংঘ-পরিবার | বিবেকানন্দ |
ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থহীন। | ‘‘এখন ভারতে আধুনিক যুগ। কিভাবে জনগণের মধ্যে সেকুলার জ্ঞানের বিস্তার হয়, সেটাই গুরুতর প্রশ্ন।’’ (জনগণের অধিকার, পৃষ্ঠা ৬২) |
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব কথা বেদ-বেদান্তে লেখা আছে। | ‘‘আমি বেদের ততটুকুই মানি যতটুকু যুক্তিসম্মত। বেদের অধিকাংশই তো পরস্পর-বিরোধী।’’ ‘‘বেদান্তে কোনো সম্প্রদায়, ধর্ম বা জাতি বিচার নেই। কিভাবে এই ধর্ম ভারতের জাতীয় ধর্ম হতে পারে?’’ (বাণী ও রচনা ৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৬) |
‘হিন্দু’ হিসেবে গর্ব। | ‘‘সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য কাজ করিতে থাকো। তোমরা যে নিজদিগকে ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখিয়া খাঁটি হিন্দু বলিয়া পরিচয় দিতে গর্ব অনুভব করিয়া থাকো, উহা ছাড়িয়া দাও।’’ (বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭৩) |
অহিন্দুদের ভারতে থাকতে হলে হিন্দুদের অধীনে থাকতে হবে। | ‘‘এটা খুবই স্বাভাবিক যে একই সময়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে এবং নির্বিরোধে আমার ছেলে বৌদ্ধ, আমার স্ত্রী খ্রিস্টান এবং আমি নিজে মুসলমান হতে পারি।’’ (বাণী ও রচনা, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭২) |
হিন্দু জাগরণ ঘটলে তবেই দেশের উন্নতি। | ‘‘নিজের সুখ ও মোক্ষের কথা না ভেবে সমগ্র জাতির কথা ভাবো। সকলের মুক্তি না হলে নিজের মুক্তি চাওয়া স্বার্থপরতা।’’ (মাদ্রাজের ভাষণ, বিবেকানন্দ স্মৃতি, ক্যালকাটা বুক হাউস) |
হিন্দুদের মন্দির ভেঙেছে অহিন্দুরা। | ‘‘পুরীর জগন্নাথ মন্দির আসলে ছিল বৌদ্ধ-মঠ। হিন্দুরা দখল করে নিয়েছে।’’ ‘‘হিন্দুধর্মে দেবমন্দিরের তেমন প্রাধান্য নেই। যদি সব মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়, তাতেও বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না।’’ (বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭৩) |
বিবেকানন্দ আরও বলেছেনঃ ‘‘মানবজাতিকে এমন একটি পৃথিবীতে নিয়ে যেতে চাই যেখানে কোনো বেদ, বাইবেল, কোরআন কিছুই থাকবে না।’’ - বিবেকানন্দ (নৈনিতালের সরফরাজ হুসেনকে ইংরেজিতে লেখা চিঠি)
সরফরাজকে বিবেকানন্দ বেদান্ত বিষয়ে আগে লিখেছেনঃ I am firmly persuaded that without the help of practical Islam, theories of Vedantism, however fine and wonderful they may be, are entirely valueless to the vast mass of mankind. (আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বস্তুনিষ্ঠ ইসলামের সাহায্য ছাড়া বেদান্তের তত্ত্বসমূহ, তা যতই সুচারু এবং চমকপ্রদ হোক, বৃহৎ জনসমষ্টির কাছে সম্পূর্ণ মূল্যহীন।) [The Complete Works of Swami Vivekanada, Volume 6]
বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মের প্রবক্তা হলেও যেহেতু তাঁর ধর্মচর্চার মধ্যে কায়েমি স্বার্থ ছিল না, অর্থাৎ যেহেতু তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, ফলে মৌলবাদ-বিরোধী বহু কথা তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন। ইসলাম, খ্রিস্টান ইত্যাদি নানা ধর্মের দোষগুণ নিঃসঙ্কোচে আলোচনা করেছেন।
হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বিবেকানন্দ এও বলেছেন যে, ‘‘...হিন্দু ধর্ম যেমন পৈশাচিকভাবে গরিব ও পতিতের গলায় পা দেয়, জগতে আর কোনো ধর্ম এমন করে না।’’ (শশধর তর্কচূড়ামণির আলোচনার জবাবে, বিবেকানন্দ স্মৃতি, ক্যালকাটা বুক হাউস)
ধর্ম-কর্ম প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ বলেছেনঃ ‘‘যদি ভাল চাস তো ঘণ্টাফণ্টাগুলোকে গঙ্গার জলে সঁপে দিয়ে সাক্ষাৎ ভগবান নর-নারায়ণের - মানবদেহধারী হরেক মানুষের পূজো করগে - বিরাট আর স্বরাট। বিরাট রূপ এই জগৎ, তার পূজো মানে তার সেবা - এর নাম কর্ম; ঘণ্টার উপর চামর চড়ানো নয়, আর ভাতের থালা সামনে ধরে দশ মিনিট ব'সব কি আধ ঘণ্টা ব'সব - এ বিচারের নাম কর্ম নয়, ওর নাম পাগলা-গারদ। ক্রোর টাকা খরচা করে কাশী বৃন্দাবনের ঠাকুর ঘরের দরজা খুলছে আর পড়ছে। এই ঠাকুর ভাত খাচ্ছেন তো এই ঠাকুর আঁটকুড়ির ব্যাটাদের গুষ্টির পিণ্ডি করছেন; এদিকে জ্যান্ত ঠাকুর অন্নবিনা, বিদ্যাবিনা মরে যাচ্ছে। ...তোদের বুদ্ধি নাই যে, একথা বুঝিস।’’ (বাণী ও রচনা, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৮)
ধর্ম প্রতিষ্ঠান প্রসঙ্গে তিনি বলেছেনঃ ‘‘জীবন্ত ঈশ্বর তোমাদের সঙ্গে রহিয়াছেন, তথাপি তোমরা মন্দির, গির্জা নির্মাণ করিতেছ, আর সর্বপ্রকার কাল্পনিক মিথ্যা বস্তুতে বিশ্বাস করিতেছ। মানবাত্মা বা মানবদেহই একমাত্র উপাস্য ঈশ্বর। ...মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ মন্দির - মন্দিরের মধ্যে তাজমহল।’’ (বাণী ও রচনা, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫১)