৫৮ বর্ষ ২২শ সংখ্যা / ১৫ জানুয়ারি ২০২১ / ১ মাঘ ১৪২৭
পশ্চিমবাংলার শিল্প - একটি তুলনামূলক আলোচনা
সুপ্রতীপ রায়
দুয়ারে নির্বাচন - স্মরণে সিঙ্গুর
সামনে ভোট তাই মমতা ব্যানার্জি সিঙ্গুরে শিল্প পার্ক গড়ার ঘোষণা করেছেন। তিনি ২৪ ডিসেম্বর ২০২০ জানিয়েছেন, ‘‘সিঙ্গুরের ১১ একর জমিতে হবে অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি পার্ক।’’ মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে বিদায়ী বছরের সেরা রসিকতা বললে অত্যুক্তি হবে না। রাজ্যবাসী ভুলে যাননি ৮০ শতাংশ তৈরি হয়ে যাওয়া সিঙ্গুরের গাড়ি কারখানাকে তাড়িয়ে ছিলেন রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী।
২০২১-র নির্বাচনী ইশ্তিহারে তৃণমূল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল - ‘‘বিপুল পরিমাণ জমি সংক্রান্ত মামলা বছরের পর বছর ঝুলে আছে। ফলে সরকারি কোষাগার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা যেমন খরচ হচ্ছে, তেমনই নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে সে জমিগুলি কেউ ব্যবহার করতে পারছে না। এগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’’ কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। তাই ২০১৬ সালে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘সিঙ্গুরের জমি আদালতে আটকে থাকলে আমি কি করব? পাঁচ বছর কেন পঞ্চাশ বছর লাগলেও আমার কিছু করার নেই।’’ অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে সিঙ্গুর রায়ে বলেছিল - যাঁদের কাছ থেকে জমি নেওয়া হয়েছিল তাঁদের প্রত্যেককে জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এই রায় কতটা কার্যকর হয়েছে?
আসলে ৮০ শতাংশ কাজ হয়ে যাওয়া গাড়ি কারখানাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে বাংলার বেকার যুবকদের ভবিষ্যৎকে হত্যা করেছে তৃণমূল। প্রায় এক দশক ক্ষমতায় কাটিয়ে কৃষকের জমিও ফেরত দিতে পারেনি তৃণমূল সরকার। আবার এই সরকার কারখানাও গড়তে পারেনি। শিল্প গড়ার প্রশ্নে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকা, তৃণমূল সরকারের ভূমিকা, বর্তমান বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা মানুষ বিচার করবেনই।
৭৭-র পূর্ববর্তী সময়ে বাংলার শিল্পচিত্র
বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অপপ্রচার ছিল - ৩৪ বছরের বামশাসনে বাংলার শিল্প ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে রাজ্যের শিল্প চিত্র কেমন ছিল? ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন রাজ্যের শিল্প কার্যত ধ্বংসের অবস্থায়। চালু শিল্পগুলি ধুঁকছিল। যে শিল্পগুলি চলছিল বিদ্যুৎ সঙ্কটে সেগুলিরও বেহাল অবস্থা। ১৯৫১ সালে যেখানে সারা দেশের শিল্প উৎপাদনে পশ্চিমবাংলার অংশ ছিল ২৪ শতাংশ, সেখানে ১৯৭৫-৭৬ সালে তা নেমে দাঁড়ায় ১১.৫ শতাংশ।
ছিল বাংলার প্রতি ধারাবাহিক বঞ্চনা - শিল্প গড়ার প্রতিবন্ধকতা
ইদানিং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মেজাজ হারিয়ে মাঝে মাঝে বলছেন - কেন্দ্র রাজ্যকে বঞ্চনা করছে। যদিও বামফ্রন্ট সরকার যখন কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের দাবিতে সরব হয়েছিল তখন শ্রীমতী ব্যানার্জি তাকে উপহাস করতেন। সে যাই হোক, দিল্লির ধারাবাহিক বঞ্চনা পশ্চিমবাংলায় শিল্পে অগ্রগতির পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল। মাশুল সমীকরণ নীতি, টেলিস্কোপিক হার, শিল্প লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চনা, কেন্দ্রীয় বিনিয়োগ থেকে শুরু করে পরিকল্পনা সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে বিমাতৃসুলভ আচরণ, ব্যাঙ্ক সহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক মনোভাব প্রভৃতি পশ্চিমবাংলায় নতুন শিল্প গড়ার ক্ষেত্রে পর্বতপ্রমাণ বাধা সৃষ্টি করেছিল।
বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে শিল্পে অগ্রগতি
প্রতিবন্ধকতাগুলিকে মোকাবিলা করেই শিল্পায়নে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকার।
● শিল্পায়নের উপযোগী পরিকাঠামো তৈরি - শিল্পায়নের উপযোগী পরিকাঠামো বলতে কিছুই ছিল না এ রাজ্যে। তীব্র বিদ্যুৎ সঙ্কট, রাস্তাঘাট নেই, টেলিযোগাযোগ নেই, ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযুক্ত পরিবেশ নেই, রপ্তানি ব্যবস্থা নেই। বামফ্রন্ট সরকার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আধুনিক শিল্প গড়ে তোলার পর্যাপ্ত পরিকাঠামো উন্নয়নে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়। বিদ্যুৎ ছাড়া শিল্পের বিকাশ ঘটতে পারে না। বাম সরকার প্রতিষ্ঠার পূর্বেই রাজ্যে ভয়াবহ বিদ্যুৎ সঙ্কট চলছিল। ১৯৭৬ সালে রাজ্যের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির মোট উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ১,৩৬১ মেগাওয়াট। ১৯৯৯ সালে তা দাঁড়ায় ৬,৮৭৭ মেগাওয়াটে।
সড়ক উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, শিল্প তালুক, শিল্পবিকাশ কেন্দ্র গড়ে ওঠে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে। ২০০৬ সালের ৩১ জুলাই বেসরকারি উদ্যোগে বৃহত্তম পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প হিসাবে নিউ কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড গঠনের জন্য কলকাতায় সমঝোতা পত্র স্বাক্ষরিত হয়।
● বামফ্রন্ট সরকারের নেতৃত্বে অগ্রগতির পথে শিল্প - ১৯৭৭ সালে শিল্পবিকাশ কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৩, দ্রুত তা বেড়ে হয় ১২; চালু হয় ডানকুনি কোল কমপ্লেক্স। গড়ে ওঠে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস, বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প। বিধাননগরে প্রথম পর্যায়ে ৪০ একর, দ্বিতীয় পর্যায়ে ৯৩ একর জমির ওপর ইলেকট্রনিক্স কারখানা গড়ে তোলা হয়। তারাতলায় গড়ে তোলা হয় একটি ইলেকট্রনিক এস্টেট। ফলতায় গড়ে ওঠে রপ্তানি প্রক্রিয়ার অঞ্চল।
● শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি - বামফ্রন্ট সরকারের শিল্পবান্ধব নীতির ফলেই নতুন নতুন শিল্পোদ্যোগ ও পুরনো সংস্থাগুলিতে নতুন বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ফলে ১৯৭৭-৮১ সালে রূপায়িত প্রকল্পগুলিতে যা বিনিয়োগ হয়েছিল, ১৯৮২-৮৭ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল তার ৩০৩.২ শতাংশ বেশি। ১৯৯১-৯৯ সালের মধ্যে রাজ্যে মোট ৪৭,৩৯৪ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব আসে। ২০০৯ সালে শিল্পে বিনিয়োগ হয় ৮,৪০০ কোটি টাকারও বেশি। ২০১০ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করে।
● ক্ষুদ্র শিল্পে অগ্রগতি - শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থান, উৎপাদন, মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রশ্নে ক্ষুদ্রশিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ক্ষুদ্রশিল্পের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছিল। ১৯৮৬ সালেই সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’র হিসাব অনুসারে সারা দেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক ক্ষুদ্র শিল্প ইউনিট ছিল পশ্চিমবঙ্গে। ২০০৯-১০ সালের রাজ্য বাজেটে রাজ্যের ক্ষুদ্র শিল্পে আড়াইশো কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। ২০১০ সালে রাজ্যের ক্ষুদ্র শিল্প ইউনিটের সংখ্যা ছিল ২৭ লক্ষ ৫৩ হাজার। ২০১০-১১ সালের বাজেটে ২০০ কোটি টাকা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে বরাদ্দ করা হয়।
● ভারি ও বৃহৎ শিল্প রূপায়ণে পদক্ষেপ - বামফ্রন্ট সরকারের সময় হলদিয়া পেট্রোরসায়ন প্রকল্প, মিৎসুবিশি পিটিএ প্রকল্প, ভূষণ ইন্ডাস্ট্রিজের কোল্ড রোলিং প্রকল্প, অম্বুজা সিমেন্ট প্রকল্প, ভিডিওকন কারখানা, ফেরো ম্যাঙ্গানিজ প্রকল্প, ডেটিক কর্পোরেশন, অ্যালয় স্টিল কাস্টিং প্রকল্প, ডাকটাইল লোহা প্রকল্প, স্টিল ওয়ার প্রকল্প, বাসবী স্টিলের ফেরো-অ্যালয় প্রকল্প রূপায়িত হয়েছে। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি ইস্পাত শিল্প তৈরি হয়েছে।
● তথ্যপ্রযুক্তিতে বিরাট সাফল্য - বিধাননগর ইলেকট্রনিক্স এলাকায় তথ্য প্রযুক্তির সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। টাটা, আইবিএম, উইপ্রোর মতো নামকরা প্রতিষ্ঠান রাজ্যে তথ্য প্রযুক্তি নির্মাণ শিল্পে এগিয়ে এসেছিল। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তথ্য প্রযুক্তির রপ্তানি ১৯৯৮-৯৯ সালে ছিল ৪০০ কোটি টাকা। ১৯৯৯-২০০০ সালে তা বেড়ে হয় ৭০০ কোটি টাকা। ২০০৫-০৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২,৭০০ কোটি টাকা। পরবর্তীকালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬,৪০০ কোটি টাকা।
● রুগ্ন শিল্প পুনর্গঠনে বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকা - বামফ্রন্ট সরকার রুগ্ন ও বন্ধ শিল্প পুনরুজ্জীবনের জন্য পৃথক শিল্প পুনর্গঠন দপ্তর খুলেছিল। বন্ধ ও রুগ্ন শিল্প বাঁচানোর জন্য ভরতুকি দান, ঋণের সুদের উপর ভরতুকি, বিদ্যুৎখাতে ছাড় প্রভৃতি দিয়েছিল।
● শিল্পায়ন নিয়ে সদিচ্ছা মমতার কোনোকালেই ছিল না - আসলে মমতা ব্যানার্জির রাজনীতি চিরকালই ধ্বংসাত্মক। মিথ্যাচারই পুঁজি নেত্রীর। পশ্চিমবাংলার শিল্প নিয়েও বরাবর মিথ্যাচার করেছেন। তৃণমূল নেত্রী সাংসদ থাকাকালীন অবস্থায় প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী ভেঙ্গল রাও-এর ঘরের সামনে হঠাৎ অনশনে বসেছিলেন। দাবি - অবিলম্বে মেটাল বক্স খুলতে হবে। পরে তিনি সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেনঃ ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার মেটাল বক্স খোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাই অনশন ভঙ্গ করলাম।’’ যদিও মেটাল বক্স খোলেনি। ব্রিগেডের এক সমাবেশে প্রয়াত প্রমোদ মহাজনকে দিয়ে ঘোষণা করিয়েছিলেন - কেন্দ্র কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বন্ধ করবে না। নেত্রী একবার দুর্গাপুরে গিয়ে ফ্যাক্স দেখিয়ে বলেছিলেন - এমএএমসি বন্ধ হবে না। সবই ছিল নির্জলা মিথ্যাচার।
মনে পড়ে দিদিভাই
২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে এবং ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল কংগ্রেসের শিল্পায়ন নিয়ে প্রতিশ্রুতিগুলি কি মনে আছে? ২০১১-র নির্বাচনের আগে মমতার প্রতিশ্রুতি ছিল - (১) ক্ষুদ্র, ছোটো ও মাঝারি শিল্পে ক্লাস্টার গঠনে ঝাঁপানো হবে, (২) প্রতিটি জেলায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব তৈরির প্রক্রিয়া শেষ হবে, (৩) রাজ্যজুড়ে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনশিপ নেটওয়ার্ক’ তৈরির কাজ শুরু হবে, (৪) চা এবং পাট শিল্প পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনার প্রয়োগ শুরু হবে, (৫) হলদিয়া, দুর্গাপুর, খড়্গপুর, কল্যাণী ও শিলিগুড়িতে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প প্রসারিত করা হবে, (৬) টিকাকরণ সহ চিকিৎসার অন্যান্য ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য ‘সেন্টার অব এক্সেলেন্স’ তৈরি করা হবে, (৭) কারিগরি ও উদ্ভাবনা ক্ষেত্রে একটি উৎকর্ষ কেন্দ্র হবে।
২০১১-র নির্বাচনী ইশ্তিহারে তৃণমূল লিখেছিলঃ ‘‘পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিটি মহকুমায় অন্তত দশটি করে বড়ো, মাঝারি শিল্প গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’’ ওই নির্বাচনী ইশ্তিহারে আরও লেখা হয়েছিলঃ ‘‘রাজ্যের সুতোকল কাপড়কল বন্ধ। তাঁতিরা ধুঁকছেন। গত ২০ বছরের ছবি আগামী ৫ বছরে পালটাবে...’’। ২০১৬-র ইশ্তিহার প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেনঃ ‘‘বাংলা কৃষি ও শিল্পে বিশেষ স্থান অর্জন করবে। বিশ্বসেরা বাংলা গড়ার অঙ্গীকার করছি আমরা।’’ বলাবাহুল্য প্রতিশ্রুতিগুলির পরিণতি সিঙ্গুরের শিল্পের মতোই হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর শিল্প সম্মেলনগুলিতে অশ্বডিম্ব প্রসব হয়েছে
ক্ষমতায় বসার পর ঘটা করে শিল্প সম্মেলনগুলি মমতা ব্যানার্জি করেছেন। বিদেশেও সরকারি অর্থ দেদার উড়িয়ে শিল্প সম্মেলন করেছেন। কিন্তু বিনিয়োগ কত হলো? উত্তর নেই। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে রাজ্যে দায়িত্ব গ্রহণের একমাসের মধ্যেই তিনি শিল্পপতিদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। প্রায় ২০ কোটি টাকা খরচ করে হলদিয়াতে শিল্প সম্মেলন হয়েছিল। কিন্তু বিনিয়োগ অঙ্ক কত? রাজ্যবাসী উত্তর পাননি।
রাজ্য সরকারের বাৎসরিক শিল্প সম্মেলনের নাম - ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’। এটির সূচনা হয় ২০১৫ সালে। গোটা রাজ্য প্রশাসনকে পথে নামিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করেও বিনিয়োগ টানতে ব্যর্থ তৃণমূল সরকার। গত কয়েক বছরের বিনিয়োগের হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের পিছনে থাকা রাজ্য বলতে উত্তর পূর্বাঞ্চলের ছোটো রাজ্যগুলির সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীর। পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেকগুণ এগিয়ে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটকের মতো রাজ্যগুলি।
আসলে তোলাবাজি, সিন্ডিকেটরাজ সহ তৃণমূল সরকারের শিল্পবিরোধী ভাবমূর্তিই এ রাজ্যে শিল্প স্থাপনে বড়ো প্রতিবন্ধকতা। গত পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে কাজ হয়েছে মাত্র ৩,৫২৫ জনের। ২০১৫-১৬-তে রাজ্যে শিল্পে একজনেরও কাজ হয়নি। বিনিয়োগ হয়েছিল মাত্র ৮৮ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭-তে কাজ হয়েছিল ৪৯০ জনের। বিনিয়োগ হয়েছিল ৩,৪৪০ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ তে কাজ হয়েছিল ৩০৩ জনের। বিনিয়োগ হয়েছিল ৬,৬৪৪ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯-এ বিনিয়োগ হয়েছিল ২,৬৭৬ কোটি টাকা। কাজ হয়েছিল ২,৬১৭ জনের। ২০১৯-২০-তে বিনিয়োগ হয়েছিল মাত্র ১৪ কোটি টাকা। কাজ হয়েছিল ১১৫ জনের।
মমতার আমলে বাংলার শিল্পচিত্র
রাজ্যের সমস্ত শিল্পাঞ্চলের অবস্থা খারাপ। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস-এর হাল সঙ্কটজনক। আসানসোল-দুর্গাপুরের শিল্পাঞ্চল, বারাকপুর শিল্পাঞ্চল, চা বাগানগুলি ধুঁকছে। দুর্গাপুর স্টিল, দুর্গাপুর মেটালিক, জয়কালী স্পঞ্জ আয়রন, মঙ্গলপুরের হুগলি জুটমিলের পরিণতি রাজ্যবাসী জানেন। সমস্ত শিল্পে স্থায়ী শ্রমিক কমছে। বেশিরভাগ কাজ করানো হচ্ছে ঠিকায়। শ্রমিকপিছু ব্যয় কমছে মালিকের। কয়লা মাফিয়াদের দাপট ক্রমবর্ধমান। রাজ্যের শিল্পাঞ্চলগুলি কার্যত শ্মশানের চেহারা নিচ্ছে। নতুন শিল্প তো আসছে না, যে শিল্পগুলি ছিল তার অনেকগুলিই অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’ হয়েছে কিন্তু শিল্প করার জমি নেই। নতুন শিল্পতালুক ঘোষিত হয়েছে। যদিও তার জমি অধরা। খড়্গপুর শিল্পাঞ্চলেও শিল্প বন্ধ হচ্ছে। ধুঁকছে ইস্পাত শিল্প, বন্ধ জুট মিল। শিল্পে রুগ্নতা বাড়ছে। বামফ্রন্ট আমলে চালু শিল্পগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়াই মমতা ব্যানার্জির শিল্পক্ষেত্রে ‘সাফল্য’।
তৃণমূল আমলে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের হাল কি?
হলদিয়া, দুর্গাপুর, খড়্গপুর, কল্যাণী ও শিলিগুড়িতে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প প্রসারিত করার ঘোষণা করেছিল বর্তমান রাজ্য সরকার। কিন্তু ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের কোনো লক্ষণ নেই। বাম জমানায় ইনফোসিস রাজ্যে আসতে চেয়েছিল। আইবিএম অনেক বেশি কর্মসংস্থান নিয়ে আসতে চেয়েছিল। প্রচুর আইটি, ইলেক্ট্রনিক কোম্পানি আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। ২০১১-তে সরকার পরিবর্তনের পর তারা কেউ আসেনি। বামফ্রন্ট সরকারের সময় ইনফোসিস জমি অধিগ্রহণ করেছিল, তাকেও রাজ্য ছাড়তে হয়েছে।
ক্ষুদ্র শিল্প বিপন্ন
বামফ্রন্ট সরকারের সময় সারা দেশের মধ্যে ক্ষুদ্র শিল্পে সেরা ছিল পশ্চিমবাংলা। তৃণমূল রাজত্বে ক্ষুদ্র শিল্পে রুগ্নতা বাড়ছে। যদিও তৃণমূলের প্রতিশ্রুতি ছিল ক্ষুদ্র, ছোটো ও মাঝারি শিল্পে ক্লাস্টার গঠনে ‘ঝাঁপানো’ হবে। সে সব কথার কথা। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ
বিজেপি নেতারা বলছেন, ‘বিজেপি সিঙ্গুরে শিল্পের পক্ষে’। কিন্তু সিঙ্গুরে শিল্প তাড়ানোর ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের শরিক ছিল বিজেপি। ২০০৬ সালে ৪ ডিসেম্বর ধর্মতলায় মেট্রো সিনেমার উল্টোদিকে মঞ্চ বেঁধে সিঙ্গুর প্রকল্পের বিরোধিতায় অনশন শুরু করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। বিজেপি’র সর্বভারতীয় নেতা রাজনাথ সিং ওই দিন বিজেপি’র রাজ্য নেতাদের নিয়ে সিঙ্গুর যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। একইদিনে এনডিএ-র তৎকালীন আহ্বায়ক জর্জ ফার্নান্ডেজ মমতা ব্যানার্জির মঞ্চে এসেছিলেন। ২৫ ডিসেম্বর ’০৬ মমতা ব্যানার্জির অনশন মঞ্চে এসেছিলেন বিজেপি’র তৎকালীন সর্বভারতীয় সভাপতি রাজনাথ সিং। নন্দীগ্রামের ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’তে বিজেপি-ও ছিল। অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে যেমন বাংলায় বিভিন্ন রাষ্ট্রয়ত্ত শিল্পের গেটে তালা পড়েছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সময়েও পশ্চিমবাংলায় অবস্থিত বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।