E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২২শ সংখ্যা / ১৫ জানুয়ারি ২০২১ / ১ মাঘ ১৪২৭

বিজ্ঞানসাধনা ও বিজ্ঞানমনস্কতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে গ্যালিলিও গ্যালিলে

বিশ্বম্ভর মণ্ডল


অজ্ঞানতা থেকে জন্ম নেয় কুসংস্কার, বাড়তে থাকে অতীন্দ্রিয় শক্তির উপরে বিশ্বাস। যে সমাজব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের জীবনজীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা বেশি, অসাম্য বেশি সেখানেই ভাগ্য নির্ভরতা বেশি। যে সমাজব্যবস্থায় বিজ্ঞান, যুক্তি, বুদ্ধি লজ্জায় মুখ লুকোয় - সেখানে ধর্মকে শাসক তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করে অবলীলায়। যে শাসক চায় না, মানুষ তার জীবনজীবিকা, শিক্ষা, স্বাস্থের অধিকার নিয়ে শাসককে প্রশ্ন করতে শুরু করে দিক, তারা নানা নাটকে ভরতি করে রাখে সময়ের কলসি। যাত্রাপালার আগে যেমন একটানা চলতে থাকা বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজে নিবিষ্ঠ থাকতে থাকতে দর্শক চমকে উঠে দেখতে পায় তার অলক্ষে গুটি গুটি পায়ে মঞ্চের উপরে অভিনেতা হাজির। ঠিক তেমনি করে সকলের অলক্ষে সত্য প্রকাশিত হবার আধারও গড়ে ওঠে। এই সময়ে বিজ্ঞানসাধনা ও বিজ্ঞানমনস্ক মন ধর্ম ব্যবসায়ী ও মৌলবাদী শক্তির চরম আক্রমণের শিকার হয়। এই প্রবন্ধ বিজ্ঞানসাধনা ও বিজ্ঞানমনস্কতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে গ্যালিলিওর ভূমিকার একটি মুখবন্ধ বলা যেতে পারে।

চারপাশের গোঁড়ামি, কুসংস্কারের আক্রমণকে উপেক্ষা করে সমাজের অল্প কিছু প্রভাবশালী মানুষের স্বার্থের কথা না ভেবে নিজের সমাজমনস্ক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতায় বলীয়ান করে তুলেছিলেন নিজেকে। হাজার বাধা, ভয়, ধর্মের ব্যবসায়ীদের প্রবল চাপে তাঁকে টলানো যায়নি। লক্ষ্যে অবিচল থেকে নিজের কাজ করে গেছেন। পুরনো অবৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণাকে বিজ্ঞানের জ্ঞানের সাহায্যে ছিন্ন-বিছিন্ন করে গেছেন। বিজ্ঞানে ধর্মীয় শাসন, ধর্মীয় উন্মাদনাকে তিনি মেনে নেননি। পৃথিবী কী করে সৃষ্টি হয়েছে বা মহাবিশ্বের নিয়মকানুন বিষয়ে বাইবেলের কথা, ধর্মযাজকদের কথাই শেষ কথা হবে? না কী বিজ্ঞানের শিক্ষাই পথচালিকা হবে, সেই নিয়ে তার মধ্যে কোনো অস্বচ্ছতা ছিল না।

বাবা মায়ের সাত সন্তানের প্রথম। জন্ম ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৫৬৪ ইতালিতে, মৃত্যু ৮ জানুয়ারি ১৬৪২। বাড়ি থেকে ডাক্তারিতে ভরতি করে দেওয়া হলেও তিনি ডাক্তারি ছেড়ে ভরতি হন গণিতে। পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে অধ্যাপনা জীবন শুরু করে পরবর্তীতে যোগ দেন পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।

অ্যারিস্টটলের মতবাদ ছিল - উপর থেকে সব বস্তু একই গতিবেগে নিচে পড়ে না। ২০০০ বছর ধরে এটা সত্য বলে বিবেচিত হয়েছে। গ্যালিলিও “পতনশীল বস্তুর সূত্র” প্রতিষ্ঠা করলেন যেখানে তিনি দেখালেন অ্যারিস্টটলের মতবাদ ভ্রান্ত। তিনি দূরবিন আবিষ্কার না করলেও তিনিই প্রথম মানুষ যিনি দূরবিনের সঠিক ব্যবহার করেছিলেন। জড়ত্ববাদ আবিষ্কার তাঁর অন্যতম অবদান। মহাকাশ পর্যবেক্ষণে তাঁর অবদান একদিকে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে যেমন সহায়ক হয়, অন্যদিকে বিজ্ঞানমনস্কতার ভিত্তিভূমি শক্তভাবে প্রতিষ্টিত হয়। বিজ্ঞানের জগতে তিনি “অবজারভেশনাল অ্যাস্ট্রোনমির জনক”, “আধুনিক পদার্থবিদ্যার জনক”, “বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জনক” হিসাবে স্বীকৃত।

চারপাশের গোঁড়ামি, কুসংস্কারের আক্রমণকে উপেক্ষা করে সমাজের অল্প কিছু প্রভাবশালী মানুষের স্বার্থের কথা না ভেবে নিজের সমাজমনস্ক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতায় বলীয়ান করে তুলেছিলেন নিজেকে। হাজার বাধা, ভয়, ধর্মের ব্যবসায়ীদের প্রবল চাপে তাঁকে টলানো যায়নি। লক্ষ্যে অবিচল থেকে নিজের কাজ করে গেছেন। পুরনো অবৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণাকে বিজ্ঞানের জ্ঞানের সাহায্যে ছিন্ন-বিছিন্ন করে গেছেন। বিজ্ঞানে ধর্মীয় শাসন, ধর্মীয় উন্মাদনাকে তিনি মেনে নেননি। পৃথিবী কী করে সৃষ্টি হয়েছে বা মহাবিশ্বের নিয়মকানুন বিষয়ে বাইবেলের কথা, ধর্মযাজকদের কথাই শেষ কথা হবে? না কী বিজ্ঞানের শিক্ষাই পথচালিকা হবে, সেই নিয়ে তার মধ্যে কোনো অস্বচ্ছতা ছিল না। পৃথিবী স্থির, সূর্য তাকে কেন্দ্র করে ঘুরে চলেছে - এটাই সকলে দেখে অভ্যস্ত। ধর্মগ্রন্থতেও তাই লেখা আছে। বিগত ২০০০ বছর ধরে ধর্মযাজকরা সেই কথাটা মানুষকে বলে এসেছেন। সম্রাটের মুখেও একই সুর। অতএব সেই সময়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত আইন হলো এটাই যে, পৃথিবী হলো নিশ্চল। কিন্তু সকলকে ছাপিয়ে গ্যালিলিওর ভাবনায় তখন কোপারনিকাসের সত্য - সূর্য নিশ্চল, পৃথিবী তার চারপাশে ঘুরে চলেছে। প্রসঙ্গত, পৃথিবীকেন্দ্রিক সৌরজগতের ধারণার প্রবর্তক ছিলেন টলেমি। টলেমি ও তাঁর পূর্ববর্তী জ্যোতির্বিদ হিপাকার্সের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অনেক অবদান মেনে নিলেও পৃথিবীকেন্দ্রিক সৌরজগতের ধারণার সংশোধন করেন কোপারনিকাস এবং তাঁর নতুন ধারণা সারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেন সাড়াজাগানো বই “অন দ্য রেজেলিউশনস অফ দ্য হেভেনলি স্ফেয়ারস”-এর মাধ্যমে। কোপারনিকাসের মতবাদের পক্ষে থাকায় পুড়িয়ে মারা হয়েছে জিওর্দানো ব্রুনোকে। সব জেনেও গ্যালিলিও সত্য প্রতিষ্ঠায় অবিচল থাকলেন। মেনে নিলেন ব্রুনোর “প্লুরুলিটি অফ ওয়ার্ল্ড” তত্ত্ব। বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য, তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর সুনিশ্চিত হলেই সেই মতবাদ গ্রহণ করতেন। কোপারনিকাস বলেছিলেনঃ “বাইবেল ধর্মের কথা বলে, বিজ্ঞানের কথা বলে না।... কোনো ধর্মপুস্তকের কিছু কথা নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে কেউ যদি আমার ভাবনাকে আক্রমণ করে, আমি গ্রাহ্য করব না।’’

এ হেন কোপারনিকাসের মতবাদের সমর্থককে শাসক ও তার সহযোগী শক্তির মেনে নেবার কথা নয়। মেনে নেয়ওনি তারা। নানাভাবে গ্যালিলিওর উপরে চাপ তৈরির প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে আর একটি ঘটনায় আগুনে ঘি পড়ল। ১৬০৯-এ দূরবিন তৈরি করে গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করা শুরু করলেন। দেখলেন চাঁদের ভিতরে উঁচু উঁচু পাহাড়, গর্ত আর পাথর। দেখলেন ছায়াপথে তারার সমাবেশ। বৃহস্পতির চারটে উপগ্রহ আবিষ্কার করলেন। দেখাতে থাকলেন অনেককে। এর ফলে একদিকে যেমন তিনি বিজ্ঞানী মহলে ও সাধারণ মানুষের সমর্থন পেতে শুরু করলেন, অন্যদিকে শাসকরা এটাকে ভালোভাবে নিল না। তারা প্রচার শুরু করল যে, গ্যালিলিও ধর্মবিদ্বেষ প্রচার করছেন, বাইবেলের উপরে মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করা হছে। এই পরিস্থিতিতে ১৬১৫ সালে পোপ তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে সতর্ক করেন। পোপের আদেশে প্রাসাদে ডেকে শাসক তাঁকে বলে দেন যে, এই বিতর্ক থেকে দূরে থাকতে হবে। এভাবে তাঁকে একপ্রকার ঘর বন্দি জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, তবু তিনি চাঁদ বা সূর্যকে শাসকের দাবি মেনে ঈশ্বর বলে প্রচার করতে রাজি হননি, বরং বস্তুপিণ্ডরূপে আখ্যা দেন। এই ভয়ংকর চাপের মুখেও তিনি নতিস্বীকার করেননি। তবে তাঁকে কাজের স্ট্র্যাটেজি বদলে ফেলতে হয়। প্রকাশ্যে কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় তিনি বসে না থেকে এই সময়ে লিখে ফেলেন “ডায়লগ অন দি টলেমিক অ্যান্ড কোপারনিকান সিস্টেমস” বই। এর মধ্যে নতুন পোপের ডাকে তাঁকে আবার নিজের বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি পেশ করতে হয়। কোনো লাভ হয় না, বিচার হয় তাঁর। রায় হয় গ্যালিলিওর বক্তব্য অযৌক্তিক ও ধর্মমতের পরিপন্থী। কারণ হিসাবে বলা হয়, বাইবেলের সঙ্গে ও ধার্মিক যাজকদের মতের সাথে গ্যালিলিওর মতের মিল নেই, তাই তার মত গ্রহণীয় নয়। এই প্রায় বন্দি জীবনে তিনি আর একটি বই “ডায়লগ কনসার্নিং টু দি প্রিন্সিপাল অফ দি ওয়ার্ল্ড” লিখে ফেলেন। শাসকের রোষ এতে আরও বেড়ে যায়। বিচারসভা বসে। এখানে তাঁকে শাসকের পছন্দ মতো কথা বলতে বাধ্য করা হয়। সাথে তাঁকে নিজ গৃহে নজরবন্দি জীবনযাপনে বাধ্য করা হয়। বাইরের জগতে কাজ করার সুযোগ না পেয়েও তিনি থেমে থাকেন নি। সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণাকে প্রকাশ করলেন সারা বিশ্বের সামনে তার বই “ডায়লগ কনসার্নিং টু চিফ সিস্টেমস অফ ওয়ালর্ডঃ দি টলেমিক অ্যান্ড দি কোপারনিকাস”-এর মাধ্যমে। লিখে ফেলেন “ডায়লগ কনসার্নিং টু নিউ সায়েন্সেস” বই ও গোপনে ছাপার ব্যবস্থা করেন। যুগে যুগে শাসকের বাজনদার না হবার অপরাধে কাউকে না কাউকে কারাগারের অন্তরালে পাঠিয়ে শাসনযন্ত্রের ক্ষমতা প্রদর্শনের সাক্ষী হতে হয় মানবসমাজকে। কিন্তু সাময়িকভাবে সফলতা আসলেও কোনো যুগেই কোনো শাসক সত্যের প্রকাশকে আটকে রাখতে পারেন নি, তাই ঘরের অন্ধকারে শেষজীবন কাটাতে বাধ্য হলেও বিজ্ঞানমনস্কতার ব্যাটনকে ঠিক পরের প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যান ব্রুনো, গ্যালিলিওরা।