E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৫ জুলাই, ২০২২ / ৩০ আষাঢ়, ১৪২৯

আনিস হত্যার ন্যায়বিচারের দাবিতে লড়াই চলবে


আনিস হত্যার বিচারের দাবিতে ছাত্র-যুবদের কলকাতায় বিক্ষোভ।

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ছাত্রনেতা আনিস খান হত্যাকাণ্ডকে আড়াল করার প্রতিবাদে ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাস্তায় লড়াই চালাবে সিপিআই(এম)। ১৩ জুলাই এক সাংবাদিক সম্মেলনে একথা জানিয়ে পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, রাজ্য সরকারের সিট মুখ্যমন্ত্রীর কথামতো অপরাধীদের আড়াল করছে। এর বিরুদ্ধে আইনের পথে লড়াই হবে,রাজ্যের পথে পথেও আন্দোলন হবে। খুনিরা যাতে পার না পায় তার জন্য আগামী এক সপ্তাহ রাজ্যের সব মহকুমায়, ব্লকে আন্দোলন করা হবে। আমরা সবাইকে এই আন্দোলনে শামিল হবার আবেদন জানাচ্ছি।

তিনি আরও বলেছেন,আনিস খান হত্যার পরদিন থেকেই আমরা বলেছিলাম যে,পুলিশকে দিয়ে খুন করানো হয়েছে। সরকার প্রথমে পুলিশের যাবার কথা অস্বীকার করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী পাঁচদিন চুপ করে থাকার পর যা বলেছিলেন এখন সিট আদালতে সেটাই রিপোর্ট হিসেবে পেশ করেছে। আদালতে মিথ্যাচার হয়েছে। আনিসের বাবার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে,পুলিশ দিয়ে আনিসকে খুন করানো হয়েছে।গ্রেপ্তার হওয়া সিভিক ভলান্টিয়ার বলেছে যে,তাঁকে বলির পাঁঠা করা হয়েছে। পুলিশের বেআইনি অভিযান যে হয়েছিল তা মেনে নিলেও এর পিছনে থাকা আসল ব্যক্তিদের ধরা হয়নি। এখন থানার আইসি’র কথা বলা হচ্ছে,কিন্তু হাওড়া গ্রামীণ পুলিশ সুপার পদে যিনি ছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? কলকাতায় বদলি করে তাঁকে অপরাধের দায় থেকে মুক্ত করা যাবেনা।

সেলিম বলেছেন,এখনো আমরা মনে করি,আনিসের পরিবার ন্যায় বিচার পাবে। ন্যায়ালয়ে তাঁদের ন্যায় বিচার পাওয়া উচিত। তারজন্য আনিসের পরিবার আইনি লড়াই করছে, সেই লড়াই চলবে। কিন্তু যে পুলিশকে দিয়ে মানুষের উপরে জুলুম করানো হচ্ছে,মিথ্যা মামলা সাজানো হচ্ছে এবং আনিসকে হত্যা করানো হয়েছে, সেই খুনি পুলিশকে শাস্তি দিতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে খুনিদের নিরাপদে থাকতে দেওয়া হবে না। এর জন্য রাস্তায় নেমেও লড়াই করতে হবে। রাজ্যের সব শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে আমরা এই লড়াইতে শামিল হবার আবেদন জানাচ্ছি।

প্রসঙ্গত,গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাত দেড়টা নাগাদ হাওড়া জেলার আমতার সারদা গ্রামে খাঁ পাড়ায় আনিস খানের বাড়িতে চারজন পুলিশ কর্মী গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন পুলিশের পোশাক পরা বন্দুকধারী,বাকি তিনজন ছিলেন সাধারণ পোশাকে। তাঁরা আমতা থানা থেকে আসার কথা জানান। তখন স্বাভাবিকভাবেই দরজা খুলে দেন আনিসের বাবা। এরপর পুলিশের পোশাক পরা ব্যক্তি আনিসের বাবাকে গেটের সামনে আটকে দেয় প্রথমে।বাকি তিনজন এরপর আনিসের খোঁজে বাড়ির ওপর তলায় চলে যায়।সেখানে গিয়ে তারা আনিসকে দেখতে পেয়ে তার উপর চড়াও হয় এবং মারধর করে।এরপর আনিসকে টানতে টানতে তিনতলার ছাদে নিয়ে যায়। তারপর দ্রুত তিনজন নিচে নেমে পুলিশের পোশাক পরা ব্যক্তিকে জানায় কাজ হয়ে গেছে। এর পরই তারা দ্রুত চলে যায়। এদিকে বাড়ির সামনে হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ হয়,সন্দেহ হতেই বাড়ির বাইরে আনিসের বাবা ও পরিবারের সদস্যরা দেখতে পান রক্তাক্ত অবস্থায় ২৮ বছরের ছেলে পড়ে আছে। ততক্ষণে পালিয়ে যায় থানা থেকে আসা চারজন।

কিন্তু এই ঘটনার কোনো বাস্তব প্রতিফলন নেই মমতা ব্যানার্জি সরকারের পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)-এর চার্জশিটে। বরং অভিযুক্ত পুলিশের বয়ান অনুযায়ী গোটা ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা এবং পুলিশের কর্তব্যের গাফিলতি বলেই দায় সারা হয়েছে। স্বভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে পুলিশের যদি অপরাধবোধ না থাকে তবে চোখের সামনে ছাদ থেকে আনিস পড়ে যাবার পর তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে চোরের মতো কেন পালিয়েছিল পুলিশ? এর কোনো উত্তর মেলেনি।

আমতার প্রতিবাদী ছাত্রনেতা আনিস খান হত্যাকাণ্ডে রাজ্য সরকারের পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) ১১ জুলাই উলুবেড়িয়া মহকুমা আদালতে যে চার্জশিট পেশ করেছে, তাতে নানা অসঙ্গতি ফুটে উঠেছে। তৃণমূল সরকারের পুলিশের তদন্ত কেমন হবে তা নিয়ে প্রথম থেকেই নানা মহলে সংশয় ছিল। বিশেষকরে নিহত আনিস খানের পরিবারের পক্ষ থেকেও নানা প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। সেই সমস্ত প্রশ্ন ও সংশয়কে আরও মজবুত করেছে সিট-এর চার্জশিট। সেখানে বলা হয়েছে, আদৌ খুন হননি আনিস খান। কেউ খুন করেনি আনিস খানকে। সেই চার্জশিটে বলা হয়েছে, সেদিন রাতে বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে আনিস খানের। এটা একটা দুর্ঘটনা। তবে চার্জশিটে স্বীকার করা হয়েছে সেদিন রাতে পুলিশ গিয়েছিল আনিস খানের বাড়িতে। চার্জশিটে পাঁচটি ধারায় তিনজন পুলিশকর্মী ও দুজন সিভিক ভলান্টিয়ারের নামে যে অভিযোগ আনা হয়েছে,তার সবক’টিই জামিন যোগ্য। চার্জশিটে বলা হয়েছে, হিজাব বিতর্ক নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করেছিলেন আনিস খান। সেই বিষয়েই নাকি তদন্ত করতে ওই রাতে পুলিশ তাঁর বাড়িতে গিয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টের জন্য গভীর রাতে বাড়ির সদস্যদের সন্ত্রস্ত করে, ছাত্র নেতা আনিসের বাবার বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে বাড়িতে ঢুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা পুলিশের কোন্‌ তদন্তের অংশ,তা নিয়ে স্বাভাবিক কারণেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টের জন্য তদন্ত করতে পাঁচজন পুলিশ কর্মী শুধু নয়,সারদা গ্রামের দক্ষিণ খান পাড়ার বাসিন্দাদের দাবি, বিরাট পুলিশ বাহিনী সেদিন গ্রামে এসেছিল। আশেপাশের বাড়ির ছাদেও ছিল পুলিশ। আর এই ‘তদন্তে’র পরিণামেই অকালে প্রাণ চলে গেল তরতাজা তরুণ ছাত্র নেতার।

গত ১৭ মে আদালতে আনিস খান হত্যা মামলায় সিট’র দেওয়া রিপোর্ট চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য বলেছিলেন,পুলিশের সামনে একজন মানুষের মৃত্যু হলো,পুলিশ সেখান থেকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল! পুলিশ কেন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেল না? এই ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির কারণে মৃত্যুর ৩০৪ নং ধারা যুক্ত করা হলো না। আনিস খানের বাড়ি ঘিরে সেদিন পুলিশ তল্লাশি করেছিল। বহু সংখ্যায় পুলিশ সেখানে ছিলেন। কিন্তু কেউই ওই মৃত ছাত্রের কাছে এগিয়ে গেলেন না কেন?

আর ১১ জুলাই সিট’র চার্জশিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিকাশ ভট্টাচার্য বলেছেন, এটা একটা বিপজ্জনক প্রবণতা। এমন চলতে থাকলে অন্য কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলেও সেটাকে এভাবে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হবে। তিনি বলেন,আমরা প্রথম থেকেই দাবি করেছিলাম সিট সঠিকভাবে তদন্ত করছে না। ওরা দুর্ঘটনার তত্ত্ব খাড়া করছে। তবে আমরা ডিভিশন বেঞ্চে গেছি। ওখানে শুনানি হবে।

লক্ষ্যণীয় ঘটনা হলো,উলুবেড়িয়া মহকুমা আদালতে রেজিস্ট্রারের কাছে দায়ের করা চার্জশিটে তিনজন পুলিশ কর্মীর পাশাপাশি দুই সিভিক ভলান্টিয়ারের নাম রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন সৌরভ কাঁড়ার সক্রিয় তৃণমূল কর্মী। চার্জশিট পেশের দিনও তাকে এলাকায় নিশ্চিন্তে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গেছে। অভিযুক্ত আরেক সিভিক ভলান্টিয়ার প্রীতম ভট্টাচার্য। আমতা থানা সংলগ্ন মিল্কিচক এলাকায় বাড়ি। এলাকার মানুষদের কথায়, তাকে সবাই সিভিক পুলিশ হিসেবে যত না চিনতেন,তার চেয়ে তৃণমূল কর্মী হিসেবেই বেশি চেনেন। তাই চার্জশিটে নাম থাকার পরেও এদের বেপরোয়া এবং নিশ্চিন্তে চলাফেরা আনিস খান হত্যাকাণ্ডে তদন্তের নামে প্রহসনকেই প্রকট করছে।

সিট’র তদন্তে আমতা থানার ওসি দেবব্রত চক্রবর্তীর নেতৃত্বে অভিযান হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওসি-কে গভীর রাতে হঠাৎ করে আনিস খানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কে নির্দেশ দিয়েছিল চার্জশিটে তার কোনো উল্লেখ নেই।

সিট’র এই অসঙ্গতিপূর্ণ চার্জশিটের বিরুদ্ধে সারদা গ্রামের বাসিন্দারা প্রবল ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন।পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবেই সিট’র এই চার্জশিট। তাঁরা আইনি পথেই এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আনিস খানের হত্যার উপযুক্ত বিচারের দাবিতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ আন্দোলনে পথে নেমেছে এসএফআই, ডিওয়াইএফআই’র কর্মীরা। তারা বিচার বিভাগের নজরদারিতে সিবিআই তদন্তের দাবি সোচ্চারে তুলে ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।