E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৫ জুলাই, ২০২২ / ৩০ আষাঢ়, ১৪২৯

দুর্নীতি-কেলেঙ্কারিতে বিপর্যস্ত রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা

সমস্ত অংশের মানুষকে প্রতিবাদের আহ্বান পার্টির


এসএসসি উত্তীর্ণদের ধরনায় মহম্মদ সেলিম।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ নিয়োগ দুর্নীতির প্রতিবাদে তৃণমূল-বিজেপি-কে বাদ দিয়ে যাঁরাই চাকরি ব্যবস্থায় লুটেরাদের বিরুদ্ধে লড়তে চান, তাঁদের সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী নিয়োগ দুর্নীতির প্রতিবাদে বামপন্থীদের সঙ্গে একত্রে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলার যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে মহম্মদ সেলিম ১৩ জুলাই সাংবাদিক বৈঠকে বলেছেন, অধীর চৌধুরীর বক্তব্যকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা ধারাবাহিকভাবে নিয়োগ দুর্নীতির প্রতিবাদে আন্দোলনকারীদের পাশে আ‍‌ছি, তাঁদের সমর্থন করছি।

তিনি বলেছেন, টেট, এসএসসি, মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন সহ সব সরকারি দপ্তরে নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি চলছে। বর্তমান মন্ত্রী, প্রাক্তন মন্ত্রী সবার আমলেই এই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এমনকী ঠিকা নিয়োগেও টাকার বিনিময়ে নিয়োগ করা হয়েছে এবং যোগ্য প্রার্থীরা চাকরি পাননি। পাহারায় পাবলিক কর্মসূচিতে আমরা জনগণের কাছ থেকে এরকম বহু তথ্য পেয়েছি। শিক্ষক পদে নিয়োগে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা আদালতের পাশাপাশি রাস্তায় বসে আছেন, দিনের পর দিন ধরনা দিচ্ছেন।

তিনি বলেছেন, আলাদা আলাদা করে যেসব চাকরিপ্রার্থী আন্দোলন করছেন, রাজ্যের সরকার ও শাসকদল ভয় ও প্রলোভন দেখিয়ে অনেকবার তাঁদের আন্দোলন তুলে দেবার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। চাকরিপ্রার্থীরা কেউ এখন সরকারকে বিশ্বাস করছেন না। তাঁদের ন্যায্য দাবি এখনো আদায় হয়নি। আমরা এইসব খণ্ড খণ্ড আন্দোলনকে একত্রিত করে একটি বৃহত্তর আন্দোলনের চেহারা দিতে চাই।

কংগ্রেস সহ তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী সবাইকে পাশে থাকার আবেদন জানিয়ে মহম্মদ সেলিম বলেছেন, যাঁরা লুটের কাজে যুক্ত, তারা সবাই হয় তৃণমূলে, নয় বিজেপি-তে রয়েছেন। সিবিআই এবং সিআইডি’কে দিয়ে কেবল দল বদল করানো হচ্ছে। কিন্তু লড়াই ছাড়া এই বঞ্চনার প্রতিকার হবে না। তাই তৃণমূল এবং বিজেপি ছাড়া সবাইকে আমরা এই আন্দোলনে পাশে চাই।

১০ জুলাই ধর্মতলায় গান্ধী মূর্তির সামনে অবস্থানরত এসএসসি চাকরি প্রার্থীদের ধরনা মঞ্চে উপস্থিত হয়ে সিপিআই (এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন - চালাকি, ভাঁওতাবাজি বন্ধ করে দ্রুত এসএসসি চাকরি প্রার্থীদের নিয়োগের বন্দোবস্ত করতে হবে। না হলে আন্দোলনের আগুন আরও ছড়াবে।

মেধা তালিকায়‌ নাম থাকা সত্ত্বেও এসএসসি উত্তীর্ণ মেধা তালিকাভুক্তদের চাকরি মেলেনি। তাঁরা নিয়োগের দাবিতে গান্ধী মূর্তির সামনে টানা অনশন চালাচ্ছেন। এই অনশনের ৪৮৩তম দিনে মহম্মদ সেলিম তাঁদের ধরনা মঞ্চে যান। তিনি সহ অন্যান্য পার্টি নেতৃত্ব এর আগেও চাকরির দাবিতে আন্দোলনরত এসএসসি চাকরি প্রার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই এসএসসি চাকরি প্রার্থীরা খোলা আকাশের নিচে নিদারুণ শারীরিক কষ্ট সহ্য করে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিন আন্দোলনরত অনেকেই এ‍‌ই ধরনা মঞ্চে ঈদ উৎসব পালন করেন। পরিবারের সদস্য ও প্রিয়‌জনেরা এদিন ধরনা মঞ্চে উপস্থিত হয়ে তাঁদের ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। লেখাপড়া, রাতদিন পরিশ্রম করে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া এবং পরীক্ষায় সফল হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের চাকরি মেলেনি। তাই তাঁদের কাছে খুশির ঈদ নিদারুণ যন্ত্রণা ও হাহুতাশের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছে। গত ৩ মে ঈদ-উল-ফিতরের দিন মুখ্যমন্ত্রী নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির হবু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়োগের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিলেও তা এখন বিস্মৃত হয়েছেন। তাই চাকরি প্রার্থীরা এখন বাধ্য হয়েই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রসঙ্গত, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে আকাশছোঁয়া দুর্নীতিতে আলোড়িত রাজ্য। স্বাধীনতার পর এরাজ্যে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে এতবড়ো দুর্নীতি হয়নি। এই ব্যাপক দুর্নীতিতে খোদ শিক্ষামন্ত্রীর নাম জড়িয়েছে। তাঁকে ইতিমধ্যে কয়েকবার সিবিআই দপ্তরে হাজিরা দিতে হয়েছে। মূলত এসএসসি-তে গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি এবং প্রাথমিকের নিয়োগে বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেন হয়েছে। গোটা রাজ্যজুড়ে এই দুর্নীতির জাল ছড়িয়েছে। এসএসসি-র ‍শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের সাতটি মামলায় আগেই হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল। এরপর সিবিআই’র পাশাপাশি এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট (ইডি)-ও তদন্ত শুরু করে।

গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি, নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে নিয়োগ দুর্নীতির সিবিআই তদন্তে রীতিমতো বেকায়দায় মমতা ব্যানার্জির সরকার। প্রাথ‍‌মিকে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলাতেও তদন্ত চালাচ্ছে সিবিআই। রাজ্যের দুই মন্ত্রী - পার্থ চ্যাটার্জির পাশাপাশি পরেশ অধিকারীকেও জেরার মুখে পড়তে হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি, তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যকে পদ থেকে অপসারিত করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। নিয়োগ দুর্নীতির জেরেই বাধ্য হয়ে মধ্য শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলিকেও সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে শিক্ষা দপ্তর।

এর পাশাপাশি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কাউন্সিলের চেয়ারম্যানদের সরাতে শুরু করেছে রাজ্য সরকার। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, যাদের সরানো হয়েছে দলীয় মহলে তাঁরা প্রায় সকলেই পার্থ চ্যাটার্জির অনুগামী বলে পরিচিত। ৯ মাস আগে এদের নিয়োগ করা হয়েছিল। সিবিআই’র তরফে নির্দিষ্ট নথি চেয়ে পাঠানোয় চেয়ারম্যানদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। সিবিআই তদন্তের প্রয়োজনে চাকরি পাওয়া ১৭ হাজার শিক্ষকের নথি চাওয়ায় হিমশিম খেতে হয় তৃণমূল অনুগত চেয়ারম্যানদের। সিবিআই জেরার আতঙ্কে অনেকেই পদ ছাড়ার জন্য শিক্ষা দপ্তরে তদবির শুরু করেন।

প্রাথমিক থেকে উচ্চ প্রাথমিক, একাদশ-দ্বাদশ - গত এগারো বছরে কার্যত প্রতিটি নিয়োগে টাকার বিনিময়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রথম থেকেই এ‍‌ই দুর্নীতিতে সামনে এসেছে বিপুল টাকার লেনদেনের ঘটনা। তারই ভিত্তিতে আর্থিক নয়ছ‌য়ের তদন্তে ইডি স্বতঃপ্রণোদিত তদন্ত শুরু করেছে।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, গ‍‌ত ১৩ জুন কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে অবৈধ নিয়োগের দায়ে ২৬৯জন প্রাথ‌মিক শিক্ষকের চাকরি গেছে। এসএসসি-তে নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় রাজ্যের মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতাকে বরখাস্ত করার পাশাপাশি তার নেওয়া বেতনের সম্পূর্ণ টাকা ওই পদে যোগ দেওয়া ববিতা সরকারকে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। শাসকদল ও সরকারের এই সমস্ত অপকীর্তিতে বিভিন্নমহলে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। তবুও নির্লজ্জ শাসকদল ও সরকার এই পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি ঢাকতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় ইতিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালায় সিবিআই। হাইকোর্টের নির্দেশে অপসারিত প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি, তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যের যাদবপুরের বাড়ি, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সচিব রত্না চক্রবর্তী বাগচীর ডানলপের বাড়ি এবং প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অফিসে দফায় দফায় তল্লাশি চালিয়ে বহু নথিপত্র, ফাইল ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করেছে সিবিআই।

মেধা তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও শাসকদলের দুর্নীতির ফলে যাঁরা চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাঁরা নানাভাবে প্রতিবাদ-ক্ষোভ ব্যক্ত করছেন। এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর সভায় গিয়েও ভয়-ভীতি, প্রশাসনের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে চাকরির দাবিতে সরব হচ্ছেন। সম্প্রতি এমনই ঘটনা দেখা গেছে বর্ধমানে এবং আসানসোলে। ২৭ জুন বর্ধমানের গোদায় মুখ্যমন্ত্রীর সভা চলাকালীন টেট উত্তীর্ণ ৭জন তরুণী হাতে লেখা পোস্টার নিয়ে চাকরির দাবিতে সরব হন। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের দাবিতে অনড় থাকেন। শেষ পর্যন্ত পুলিশের ঘেরাটোপে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হন। পরদিন মুখ্যমন্ত্রীর আসানসোলের সভাতেও প্রায় একই ঘটনা ঘটে। এদিন কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও স্কুল লেভেল সিলেকশন টেস্ট (এসএলএসটি)-র চার তরুণী সভা মঞ্চের সামনে উঠে দাঁড়িয়ে পোস্টার তুলে ধরেন। তাঁরা এসএলএসটি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার দাবি জানান। পুলিশ এই প্রতিবাদী মহিলাদের জোর করে সভাস্থল থেকে বের করে দেয়।

এমনই এক বিরূপ অবস্থার মুখে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজেদের অপদার্থতা আড়াল করতে সিপিআই (এম) সাংসদ, আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যকে এজন্য দোষারোপ করেন। তিনি ক্ষুব্ধ স্বরে অভিযোগ করেন ১৭ হাজার শিক্ষকের চাকরি নাকি রেডি হয়ে আছে। আরও ৫ হাজার তাঁর ভাষায় - যাঁরা ‘ডিপ্রাইভড হয়েছিল’ তাঁদের জন্য ‘ক্যাবিনেটে করেছেন’। কোর্টের অর্ডার না পেলে নাকি কিছু করতে পারছেন না। এরপর তিনি সরাসরি বলেন, ‘আমাদের না বলে আপনারা যারা কেস করেছেন এবং আপনাদের হয়ে কেস করা সিপিএম’র ল’ইয়ার বিকাশবাবুদের গিয়ে বলুন।’ তিনি বিকাশ ভট্টাচার্যকে উদ্দেশ্য করে সরাসরি বলেন, আপনি কেস করে আমাদের ছেলেমেয়েদের চাকরি বন্ধ করে দিলেন। আপনি চাকরি বন্ধ করেছেন - আপনি চালু করবেন।

মুখ্যমন্ত্রীর কথায় নিয়োগ-দুর্নীতি নিয়ে কোনো অনুশোচনা বা ভুল স্বীকার ছিল না। উলটে ‍‌তিনি বিকাশ ভট্টাচার্যের ঘাড়ে দায় চাপাতে চেয়েছেন।

মুখ্যমন্ত্রীর এ‍‌ই ধরনের কথার জবাবে বিকাশ ভট্টাচার্য বলেছেন, ১৭ হাজার পদে তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত নি‍‌য়োগ করেছেন। যাঁরা যোগ্য নন, তাঁদের টাকা নিয়ে নিয়োগপত্র দিয়েছেন। তৃণমূলীরা লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বেআইনিভাবে নিয়োগপত্র দিয়েছে। সে জন্যই যাঁরা যোগ্য প্রার্থী তাঁরা আদালতে গিয়েছেন। আদালতে আমি যাইনি। তাঁদের হয়ে আমি সওয়াল করেছি, যেটা আমার নৈতিক দায়। দুর্নীতি দেখলেই তার বিরুদ্ধে লড়াই করাটা স্বাভাবিক কাজ। মমতা ব্যানার্জি একজন আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত নেত্রী। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলেছেন। সেজন্য তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের লড়তেই হবে। তিনি যতই দুঃখ পান, কান্নাকাটি করুন, এই ১৭ হাজার দুর্নীতিগ্রস্তের চাকরি যাবে। এবং যাঁরা চাকরি দিয়েছেন, তাঁদের সাজা হবে। সেই সাজা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তিনিও বাদ যাবেন না।

তি‍‌নি আরও বলেছেন, ১৭ হাজার চাকরি যদি দিতে হয়, মুখ্যমন্ত্রী নবান্ন থেকে সরে যান, আমরা নিয়ম মেনে, মেধার ভিত্তিতে চাকরির ব্যবস্থা করব। শুধুমাত্র ১৭ হাজার নয়, যে পরিমাণ শূন্যপদ ঘোষণা করা হয়েছে, সেই সমস্ত পদ এখনো শূন্য। সেগুলি পূরণ করুন। উনি সেই সব না করে ভয় দেখাচ্ছেন। চাকরি প্রার্থীদের বলছেন তোমরা মামলা প্রত্যাহার করে নাও, তোমরা বিকাশবাবুর বাড়ি যাও। আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার কাছে আসুন। আমি তাদের নিয়ে নবান্ন অভিযান করব।

মাদ্রাসাতেও নিয়োগের দাবি সহ বিভিন্ন দাবিতে টানা ৪৮ দিন বিক্ষোভ-ধরনায় বসেন মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চাকরি প্রার্থীরা। ২০১৩ সালের বিজ্ঞাপনের ভিত্তিতে পরীক্ষার পর ২০১৮ সালে প্রকাশিত উত্তীর্ণদের প্যানেলের ৩১৮৩ জনের মধ্যে মাত্র ১৫০০ জনের চাকরি হয়েছে। বর্তমানে মাদ্রাসাগুলিতে প্রায় ১০ হাজার শূন্যপদ থাকলেও বাকিদের নিয়োগ হচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি মতো দশ হাজার মাদ্রাসার মধ্যে একটাও নতুন মাদ্রাসা হয়নি। বরং বেশ কিছু মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে গে‍‌ছে। এছাড়াও নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। এসবের দাবি নিয়েই চাকরি প্রার্থীরা বিধাননগরে বিকাশ ভবনের সামনে অবস্থান-বিক্ষোভে শামিল হন। এদের এই অবস্থান-বিক্ষোভ মঞ্চে বিভিন্ন সময়ে গিয়ে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী এবং আইনজীবী ও সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য তাঁদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ও সংহতিজ্ঞাপন করেছেন।

২৯ জুন এদের অবস্থান মঞ্চে গিয়ে বিমান বসু বলেছেন, ‘উন্নয়নে’র প্রচার আকাশ ছুঁলেও পাশ করেও রাজপথে বসে ধুয়ো, ধুলো খেতে হচ্ছে চাকরি প্রার্থীদের। কিন্তু তাঁরা হকের চাকরি পাচ্ছেন না। কৃতকার্য যাঁরা হয়েছেন, তাঁদের নিয়োগ করতেই হবে। তৃণমূল সরকারের আমলে মাদ্রাসায় মাত্র ১৫০০ নিয়োগ হয়েছে, আর এই সময়ে বহু শিক্ষক অবসর নিয়েছেন। সরকারের এই নীতির ফলে শুধু বেকারত্ব বাড়ছে তাই নয়, শিক্ষকের অভাবে পঠন-পাঠন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সমাজের ক্ষতি হচ্ছে। মানুষকে কৌশলে বাধ্য করা হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে। তিনি বলেন, সরকারপোষিত ৬১৪টা মাদ্রাসার মধ্যে বেশ কিছু বন্ধ হ‍‌য়ে গেছে। আর অন্যগুলো শিক্ষকসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। অথচ মুখ্যমন্ত্রী প্রচার করে যাচ্ছেন ‘উন্নয়ন’ নাকি উল্কাগতিতে ছুঁটছে।

এদিকে অবিলম্বে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দাবি জানিয়ে ৫ জুলাই স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়েছে। ওয়েস্ট বেঙ্গল এসএলএসটি ক্যান্ডিডেট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে এদিন বিধাননগরে কমিশনের কার্যালয় আচার্য সদনে এবং বিভিন্ন জেলায় শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিক ও জেলাশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, স্কুল সার্ভিস কমিশন ২০১৬ সালে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। গত ছয় বছরে কোনো নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি হয়নি। রাজ্যে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যায়ে ২০২১ সালের অক্টোবরের হিসেবে এক লক্ষ দশ হাজার শূন্যপদ রয়েছে। ইতিমধ্যে সংখ্যা আরও বেড়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকার নিয়োগ বন্ধ রেখেছে। কেবল শিক্ষা‍ক্ষেত্রে দুর্নীতিই নয়, তৃণমূলের জমানায় গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে তিলেতিলে ধ্বংসের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে সরকার। আর তার পরিণতিতে গত এক দশকে তৃণমূলী শাসনে সাত হাজারের বেশি প্রাথমিক স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় শিক্ষাপ্রেমী মানুষ, শিক্ষক, অভিভাবক সবাইকে নিয়ে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তা তুলে দিয়ে এখন শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের উপর দায়িত্ব সঁপে দেওয়া হয়েছে। স্কুল তহবিলের টাকা খরচ হচ্ছে হিসাব বর্হিভূতভাবে। প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। যেটুকু হচ্ছে তাও চূড়ান্ত দুর্নীতি করে ঘুষের বিনিময়ে নিজেদের অযোগ্য লোকদের নিয়োগ করা হচ্ছে। স্কুল পরিকাঠামো নির্মাণ সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে চরম অব্যবস্থায় লেখাপড়া বন্ধ হবার মুখে ছাত্রছাত্রী কমে যাচ্ছে। এভাবে গত দশবছরে প্রায় সাত হাজার প্রাথমিক স্কুল চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্কুল বন্ধ না হলেও লেখাপড়ার পরিবেশ নষ্ট করে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা হ্রাসের মতো পরিবেশ তৈরি করে এমন একটা অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে যাতে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া যায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও নানা উপদ্রব ঘটানো হচ্ছে। এভাবেই তৃণমূল গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে একেবারে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে।

এসবের প্রতিবাদে গত ১০ জুলাই এসএসসি উত্তীর্ণ চাকরি প্রার্থীদের ধরনা মঞ্চে উপস্থিত হয়ে সিপিআই (এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, এই অচলায়তন চলতে পারে না। সমাজ গড়ার কারিগর যাঁরা তাঁরা রাস্তায় বসে আছেন মাসের পর মাস। এ কোন্‌ অবস্থার মধ্যে রয়েছি আমরা। তৃণমূলের এই দশ বছরের সময়কালে রাজ্যের কর্মসংস্কৃতিটাই উঠে গেছে। দিকে দিকে বেকারির যন্ত্রণা। স্থায়ী জীবিকার জন্য হাহাকার। সরকারি দপ্তরে হাজার হাজার শূন্যপদ। অথচ স্থায়ী কাজ মেলে না এরাজ্যের ছেলেমেয়েদের। তিনি বলেন, রাজ্যের স্কুলগুলি শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্মীর অভাবে ধুঁকছে। কোনো নিয়োগ নেই। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই ধ্বংস করে দিতে চাইছে বর্তমান শাসকদল। এর বিরুদ্ধে সমস্ত অংশের মানুষকে আরও জোরালোভাবে প্রতিবাদে শামিল হবার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।