E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৫ জুলাই, ২০২২ / ৩০ আষাঢ়, ১৪২৯

বাংলার প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গাঙ্গুলি

বনানী বিশ্বাস


কাদম্বিনী গাঙ্গুলি (১৮ জুলাই, ১৮৬১ - ৩ অক্টোবর, ১৯২৩)

যে কোনো বিষয়ে প্রথম বিজয়ী সম্পর্কে জানার আগ্রহ সকলের থাকে। প্রথম মহিলা চিকিৎসক সম্পর্কে জানার আমার একটা কৌতূহল ছিল - সেটা অন্বেষণ করতে গিয়ে বিদেশি এবং স্বদেশি মহিলা চিকিৎসকদের সন্ধান পেলাম। বিলেতে প্রথম যুগের মহিলা ডাক্তার অ্যান বার্কলের কথা জানলাম, আমাদের দেশে বাংলার বটু বিদ্যালঙ্কারকে খুঁজে পেলাম, তারপরে পেলাম বাংলার প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলিকে। তারই সঙ্গে পেলাম ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার আনন্দবাঈ যোশীকে।

বাংলার প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গাঙ্গুলির জন্ম ১৮৬১ সালের ১৮ জুলাই ভাগলপুরে। তাঁর পিতা ব্রজকিশোর বসু ভাগলপুরে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং ব্রাহ্ম সমাজের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ভাগলপুরে একদল বাঙালি ব্রাহ্ম যুবক রামতনু লাহিড়ীর নেতৃত্বে সমাজকল্যাণমূলক কাজ শুরু করেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন ব্রজকিশোর। তাদের উদ্যোগে ১৮৬৩ সালে প্রথম মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা হয়।

ভাগলপুরে বাঙালিটোলায় ডাক্তার কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষ যে বালিকা বিদ্যালয় চালু করেন সেই বিদ্যালয়ে আটটি ছাত্রীর মধ্যে একজন ছিলেন ব্রজকিশোরের সাত বছরের কন্যা কাদম্বিনী। পড়াশোনায় কন্যার আগ্রহ দেখে ব্রজকিশোর কলকাতায় নিয়ে এসে হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে ভরতি করে দেন। ১৮৭৬ সালে বিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তন করে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় রাখা হয়। পিসতুতো দাদা মনমোহন ঘোষের বাড়িতে ছিলেন, পরে বোর্ডিং-এ চলে আসেন কাদম্বিনী।

কলকাতার ব্রাহ্ম প্রগতিশীল যুবরা অল্পবয়সী মেয়েদের পড়াশোনার কী ব্যবস্থা করা যায় তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছিলেন। কেশবচন্দ্র যে নারী শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন তার পাঠ্যসূচি নিয়ে ব্রাহ্মদের এই যুব গোষ্ঠীর তীব্র আপত্তি ছিল কারণ কেশবচন্দ্রের পাঠ্যসূচিতে বিজ্ঞান ও গণিত ছিল না। এই নব্যদলের পুরোভাগে ছিলেন দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি। তিনি নারীদের উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। দুর্গামোহন দাসও তাঁর দুই কন্যা সরলা ও অবলাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বালিগঞ্জে হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ প্রদান করেন ব্যারিস্টার মনমোহন ঘোষ। শুরুতে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন দ্বারকানাথ, মিস অ্যাকরয়েড ও মিসেস ফিয়ার। মিসেস ফিয়ারের স্বামী ছিলেন নামকরা বিচারপতি। দ্বারকানাথকে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা বলে উল্লেখ করেছেন শিবনাথ শাস্ত্রী।

শিবনাথ শাস্ত্রী তথ্যনিষ্ঠ সাংবাদিকের মতন বিদ্যালয়ের জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, কেশবচন্দ্রের বিদ্যালয়ে শুধু বিজ্ঞান ও গণিত নয় ছাত্রীদের লজিক পর্যন্ত পড়তে দেওয়া হতো না। কেশবচন্দ্র সেন শিক্ষা বিষয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে ভেদ রাখতে চাইতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতি অনুসারে শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক বোধ করতেন না। অপরপক্ষ এর বিরোধী ছিলেন। তাঁরা নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা দিতে চাইতেন। সুতরাং দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির উদ্যোগে এবং দুর্গামোহন দাসের অর্থ সাহায্যে অনুমান ১৮৭৩ সালে কলকাতার সন্নিহিত বালিগঞ্জ নামক স্থানে কুমারী অ্যাকরয়েডকে তত্ত্বাবাহিকা করে হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় নামে নারীদের উচ্চশিক্ষার জন্য এক বোর্ডিং স্কুল স্থাপিত হলো।

শিবনাথ বলেছেন, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্টভাবে ১৮৭৩ সালে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিনকে উল্লেখ করেছেন ১৮ সেপ্টেম্বর। বিদ্যালয়ের ঠিকানা ২২, বেনিয়াপুকুর লেন। বিদ্যালয় শুরু হয় পাঁচজন ছাত্রীকে নিয়ে।

শিবনাথ বলেছেনঃ ‘‘বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা যানবাহনাদির বন্দোবস্ত করা, পাঠ্যাদির ব্যবস্থা করা, ছাত্রীনিবাসে আহারাদির ব্যবস্থা করা, তাহাদের পীড়াদির সময়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রভৃতি সমুদয় কার্যের ভার একা গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের উপর পড়িয়া গেল। তিনি আহ্লাদিত চিত্তে সেই সকল শ্রম বহন করিতে লাগিলেন। আমরা দেখিয়া পরস্পর বলাবলি করিতাম যে মানুষ এত দূর শ্রম করিতে পারে ইহাই আশ্চর্য।’’

অল্পদিনের জন্য হলেও অ্যাকরয়েডকে শিক্ষিকা হিসাবে পেয়েছিলেন কাদম্বিনী। অ্যাকরয়েড বিয়ে করেন ঐতিহাসিক হেনরি রেভারিঞ্জকে ১৮৭৫ সালের এপ্রিলে। ১৮৭৬ সালের মার্চ মাসে বিদ্যালয়টি উঠে যায়। এক মাসের মধ্যে ওল্ড বালিগঞ্জ রোডে দ্বারকানাথ একই ধাঁচে নতুন বিদ্যালয় স্থাপন করেন। হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। প্রথম দিন থেকেই ওই বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন কাদম্বিনী।

বেথুন কমিটির সভাপতি চিফ জাস্টিস রিচার্ড বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের সঙ্গে বেথুন স্কুলের সংযুক্তির উদ্যোগ নেন। এই সংযুক্তিতে হিন্দু রক্ষণশীলদের একটা বড়ো অংশ বিরোধী ছিলেন। বিরোধিতা এসেছিল কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর অনুরাগীদের পক্ষ থেকে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে বিরোধীরা মেয়েদের সাজপোশাক নিয়ে পড়লেন। বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী মুম্বাইয়ে থাকার সময়ে পারসি মহিলাদের পরিচ্ছদকে এদিক ওদিক পরিবর্তন করে বাঙালি মেয়েদের পড়ার যে স্টাইল সৃষ্টি করেন, সেই স্টাইলেই ছাত্রীরা শাড়ি পরত। তখন এটাকে সংস্কৃত পোশাক বলা হতো।

বেথুন স্কুল ও বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের সংযুক্তির তারিখ হলো ১৮৭৮ সালের ১ আগস্ট। এ দেশে নারীশিক্ষা প্রসারে এই দিনটি গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় যোগ্য ছাত্রী তৈরি করেছিল। গভীর অনুতাপের বিষয় হলো, এই বিদ্যালয়ের নাম ইতিহাস গ্রন্থগুলিতে পর্যন্ত উল্লেখ নেই। জ্ঞানদানন্দিনীর মস্তিষ্ক প্রসূত আধুনিক পরিচ্ছদ জনপ্রিয় করার পেছনে এই বিদ্যালয়ের যে ভূমিকা ছিল সেটাও কেউ মনে রাখেনি।

এই প্রসঙ্গে আসে প্রবাসী বাঙালি চন্দ্রমুখী বসুর কথা। চন্দ্রমুখীর পড়াশুনা দেরাদুন বডরা বোর্ডিং স্কুল ফর নেটিভ ক্রিশ্চিয়ান গার্লস স্কুলে। এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার জন্য স্কুলের প্রিন্সিপাল রেক্টর রেভারেন্ট ডেভিড হেরনের কাছে চন্দ্রমুখী আবেদন করেন। প্রথমে হেরন তাঁকে ওয়েবস্টারের ডিকশনারি উপহার দিয়ে নিরস্ত করতে চাইলেন। বারবার অনুরোধ করায় বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি লেখেন।

বিশ্ববিদ্যালয় চন্দ্রমুখীকে অনিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসাবে পরীক্ষায় বসতে দেয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন কিন্তু সফলদের তালিকায় ওর নাম থাকল না। কলকাতায় বসে এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তে বিরক্ত হন দ্বারকানাথ। তিনি বিশিষ্টদের কাছে মেয়েদের পরীক্ষা দেওয়ার সরকারি অনুমতি আদায়ের চেষ্টা করেন। সেই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন স্যার আর্থার অব হাউস। তিনি ছিলেন নারী দরদি। স্যার আর্থার অব হাউস সেনেটের এক সভায় ঘোষণা করেন যে, কাদম্বিনী ও সরলা এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার উপযুক্ত কীনা তা একটি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। দুজনেই নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করলেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষার আগে সরলার বিয়ে হয়। এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিলেন কাদম্বিনী একা। মাত্র এক নম্বরের জন্য প্রথম বিভাগে পাশ করতে পারেননি। কাদম্বিনীর সাফল্যের কথা বাংলা, ইংরেজি সংবাদপত্রে ফলাও করে বের হয়।

কাদম্বিনীকে ছোটো লাট বাহাদুর উপহার পাঠান। উপহারের মধ্যে ছিল কয়েকটি বই। ভাওয়ালের রাজকুমার উপহার স্বরূপ বই এবং একটি স্বর্ণপদক পাঠান। সেই সব উপহার কাদম্বিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বেথুন স্কুল কমিটির সভাপতি রিচার্ড গার্থ।

সেই সময়ে সমস্যা ছিল কোনো কলেজ ছিল না। বেথুন স্কুলের সঙ্গে বেথুন কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। শুধু কাদম্বিনী না চন্দ্রমুখীও বিএ পরীক্ষায় বসতে চান। কাদম্বিনীর দু’বছর আগে চন্দ্রমুখী এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু তার কোনো সরকারি স্বীকৃতি না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি লিখলে পর তাঁর আবেদন গৃহীত হয়।

বেথুন কলেজ শুরু হবার পর কাদম্বিনী হলেন প্রথম ছাত্রী। ১৮৮০ সালে চন্দ্রমুখী বেথুন কলেজে ভর্তি হলেন। দু’বছর পর কাদম্বিনী ও চন্দ্রমুখী বিএ পরীক্ষায় বসলেন। পাশ করলেন দু’জনেই। সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে প্রথম দুই মহিলা গ্র্যাজুয়েট হলেন এই দুই বঙ্গ নারী।

বিএ পাশ করার পর কাদম্বিনী ডাক্তারি পড়ার অনুমতি পান ১৮৮৩ সালে। মেডিকেল কাউন্সিলের দুইজন সদস্য ডাঃ কোটস এবং ডাঃ হার্ডে মেয়েদের সুযোগ দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। অন্যরা ছিলেন এর বিরুদ্ধে। বিরোধিতার কারণ হলো নারী-পুরুষ মেলামেশার ব্যাপারে সামাজিক বাধা, নিজে ডাক্তার হয়ে খোদ রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র কাদম্বিনীকে মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ে প্রতিপদে সমস্যায় ফেলেছেন। তিনি নারীশিক্ষার বিরোধী ছিলেন। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার সময়ে এক নম্বরের জন্য কাদম্বিনীকে ফেল করিয়ে দেন। পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে সংশয় প্রকাশ করে কাদম্বিনী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ কোটসের কাছে আবেদন করেন, সহানুভূতিশীল অধ্যক্ষ বিষয়টি সিন্ডিকেটে পাঠান। সিন্ডিকেট জানায় পরীক্ষকের সিদ্ধান্তই সঠিক। সিন্ডিকেট আরও জানায়, পরের বছর তাঁকে অকৃতকার্য হওয়া বিষয়ে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে, ১৮৮৮ সালে চূড়ান্ত পরীক্ষাতেও বসতে পারবে। অবশ্য তাঁকে মেডিসিন ও সার্জারি প্রথম পরীক্ষার ফলের নিরিখে শংসাপত্র দেওয়া হয় - এটাই এলএমএসের সার্টিফিকেট। সেই অনুযায়ী কোটস তাঁকে সার্টিফিকেট দেন। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিলে পর আবার কাদম্বিনী মেডিসিনে অকৃতকার্য হন। এবারও পরীক্ষক রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র।

আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ কেন রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্রকে উপেক্ষা করে কাদম্বিনীকে ‘মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি উপাধি দিলেন’। ফাইনাল পরীক্ষায় মেডিসিনে অকৃতকার্য হওয়া সত্ত্বেও কেন কোটস তাঁকে মেডিসিনে চিকিৎসার অধিকার দিলেন - কারণ কোটসের স্থির বিশ্বাস ছিল যে, কাদম্বিনীর প্রতি রাজেন্দ্রচন্দ্র সুবিচার করেন‍‌নি, সেই কারণে তিনি বিশেষ হস্তক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

এই সময়ে কাদম্বিনীর জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, তা হলো ১৮৮৩ সালের ১২ জুন কাদম্বিনীর বিবাহ হয় মানবদরদী ব্রাহ্ম সমাজের শিক্ষক নেতা দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির সঙ্গে। এটা ছিল অসবর্ণ বিবাহ। দ্বারকানাথ ব্রাহ্ম আর কাদম্বিনী কায়স্থ। দ্বারকানাথের বয়স ৩৯, কাদম্বিনীর ২১। ব্রাহ্ম সমাজেও এই বিবাহ সমালোচিত ছিল। কাদম্বিনী ও দ্বারকানাথের বয়সের পার্থক্য দেখে তাঁরা মনে করেন এটা অসম বিবাহ। দ্বারকানাথের দার্শনিক গুরু অক্ষয়কুমার দত্ত, ব্রাহ্মনেতা আনন্দমোহন বসু, উমেশচন্দ্র দত্ত, স্বয়ং শিবনাথ শাস্ত্রীও বিবাহে উপস্থিত ছিলেন না। দুর্গামোহন দাস বিবাহের রেজিস্ট্রি করেন। ব্রাহ্ম সমাজের ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকায় সকল বিবাহের সংবাদ প্রকাশিত হতো। কিন্তু দ্বারকানাথ কাদম্বিনীর বিবাহের সংবাদ প্রকাশিত হয়নি।

বয়সের ব্যবধান এই বিবাহের আপত্তির উৎস মেনে নিলেও দ্বারকানাথ ‘দ্বিতীয় বিবাহ করব না’ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না করলে প্রথম পাশ করা ডিগ্রিধারী বাঙালি মহিলা ডাক্তার হওয়ার কৃতিত্ব কাদম্বিনী অর্জন করতে পারত না। বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই কাদম্বিনী ও দ্বারকানাথের আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা - যার পরিণতিতে এই বিবাহ। এই বিবাহ সম্পর্কে অনেকে বলেছেনঃ ‘‘জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবার ঘটনা।’’ কাদম্বিনী ও দ্বারকানাথের বিবাহ কলকাতার শুধু ব্রাহ্ম সমাজ নয়, সাধারণ জনমানসেও যথেষ্ট আলোড়ন দেখা দেয়।

অনেক বাধা পেরিয়ে মেডিকেল কলেজ থেকে পুরস্কারের মতো সান্ত্বনা উপাধি পেলেন। কলকাতাতেই প্রথম প্র্যাকটিস শুরু করেন ১৮৮৮ সালে। কাদম্বিনীর চেম্বার ছিল কলেজ স্কোয়ারে - ঠিকানা ১৫/৫, বেনিয়াটোলা লেন। তিনি প্রতিদিন বেলা ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত বিনা পারিশ্রমিকে গরিব নারী ও শিশুদের চিকিৎসা করতেন।

কাদম্বিনী উপলব্ধি করেছিলেন, যথেষ্ট তক্‌মা না থাকলে স্বদেশে মনের মতো কাজ করতে পারবেন না। হাসপাতালে তাঁকে ধাত্রীর কাজ করানো হতো। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। কাদম্বিনীকে ডাক্তার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ইয়োরোপীয় এবং অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ডাক্তাররা অগ্রাধিকার পেত। এই প্রসঙ্গে কাদম্বিনীর খোলা চিঠি আলোড়ন সৃষ্টি করে।

মহিলাদের ডাক্তারি পড়া এবং সমাজে মহিলা ডাক্তারের প্রয়োজনীয়তার কথা উপেক্ষা করে রক্ষণশীল পত্রিকাগুলি সমালোচনা করে। কাদম্বিনী প্র্যাকটিস শুরু করার পর তাঁকে ‘দেহোপজীবিনী’ বলা হয় ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায়। কাদম্বিনীর স্বামী দ্বারকানাথ পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করেন। বিচারে পত্রিকা সম্পাদক মধুসূদন পালের ছয় মাস জেল হয়।

এইসব ঘটনা থেকে দ্বারকানাথ ও কাদম্বিনী বিলাত যাত্রার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। একজন মহিলাকে শুধুমাত্র ডাক্তারি পড়তে একা জাহাজে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হওয়াটা সেই সময়ের বিচারে একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাছাড়া বাড়িতে চারটি শিশু সন্তানকে রেখে যেতে হয়েছিল। ছোটো ছেলে প্রভাতচন্দ্রের বয়স ছিল মাত্র এক বছর। তাঁর বিলাত যাত্রার প্রাক্কালে খবর আসে শিকাগোতে এক আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনী হবে। কাদম্বিনী সেখানে তাঁর সংগৃহীত জিনিসগুলি পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

১৮৯৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কাদম্বিনী জাহাজে ওঠেন, মিস পাল নামে এক মহিলা ছিলেন তাঁর যাত্রী সঙ্গী। চার সপ্তাহের কম সময়ে ইংল্যান্ডে পৌঁছে যান। সে দেশে পৌঁছানোর সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে ফর্ম জমা দেন ডিপ্লোমা কোর্সের ফাইনাল পরীক্ষায় বসার জন্য এডিনবরার নিকলসন স্ট্রিটের রয়েল কলেজ অব সায়েন্সে। ১৮৯৩ সালের ১২ এপ্রিল তাঁর ফর্ম পরীক্ষা করে গ্রহণ করেন এ এম ডুগল (জয়েন্ট ইন্সপেক্টর অব সার্টিফিকেট)।

কাদম্বিনী ট্রিপল ডিপ্লোমা এলআরসিপি (এডিনবরা), এসআরসিএস (গ্লাসগো) এবং এলএফবিএস (ডাবলিন) অর্জন করে দেশে ফেরেন। এই ‘ত্রিরত্ন’ উপাধির ফাইনাল পরীক্ষায় পাশ করার তারিখ ১৮ জুলাই, ১৮৯৩। ওই বছর রেজিস্টারে যে চোদ্দজন সফল হন তাঁর মধ্যে কাদম্বিনী একমাত্র মহিলা।

বিলেত থেকে কাদম্বিনী দেশে ফিরে কিছুদিন লেডি ডাফরিন মেডিকেল কলেজে চাকরি করার পর স্বাধীনভাবে চিকিৎসা শুরু করেন।

নেপালের রাজমাতাকে চিকিৎসা করে তিনি বাঁচিয়েছিলেন। ১৮৯৫ সালে কাদম্বিনী নেপালে যান মরণাপন্ন রাজমাতাকে সুস্থ করে তোলেন। প্রাথমিক চিকিৎসায় অসাধারণ সাফল্য লাভ করায় দীর্ঘ দু বছর নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডুতে রাজার অতিথি হিসাবে বসবাস করেন। রাজমাতা সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভের পর কলকাতায় ফেরেন। নেপালরাজ প্রতিশ্রুত অর্থের অতিরিক্ত কাদম্বিনীকে দিলেন। সর্বাঙ্গোপযোগী এক প্রস্থ অলঙ্কার - হিরে বসানো মুকুট, কণ্ঠের শতনরি, কেয়ুর কঙ্কন মেখলা থেকে চরণের নুপূর পর্যন্ত। কাদম্বিনী এই সব নিতে অস্বীকার করলে ধমকে উঠছিলেন বৃদ্ধা রাজমাতাঃ ‘‘এ সব কী তোকে দিচ্ছি হামি? এসব তো চুন্নি মুন্নি জ্যোতির্ময়ীকে লিয়ে। তুই তো স্রিফ গর্ধব কি মোট বইবি - কাঠমাণ্ডুসে কলকাত্তাত্বক।’’ এই জ্যোতির্ময়ী হলেন কাদম্বিনীর কন্যা স্বাধীনতা সংগ্রামী জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলি। নেপালের রাজমাতার সুস্থ হবার সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। পাইকপাড়ার রায় বাহাদুর শ্রীকৃষ্ণ বটকৃষ্ণ রায় চৌধুরির একমাত্র সন্তান নবীনকৃষ্ণের স্ত্রী হরিপ্রিয়ার পাকস্থলিতে মাংসপিণ্ড দেখা দেওয়ার পর স্বয়ং ডাক্তার ম্যাকডোনাল্ড স্টিভেনস নিদান দিলেন অস্ত্রোপচার ছাড়া কোনো উপায় নেই। নবীনকৃষ্ণ এক কবিরাজকে নিয়ে আসলেন - তিনিও স্টিভেন্সকে দিয়ে উদর বিদীর্ণ করাই কর্তব্য বললেন। নবীনকৃষ্ণ অতঃপর বাবামশাইকে জানান, কলকাতা শহরে একজন বাঙালি বিলাত ফেরত মহিলা ডাক্তার আছেন তাঁর নাম কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। নবীনকৃষ্ণ তাঁকে ডেকে আনলেন। কাদম্বিনী নিভৃতে পরীক্ষা করে জানালেন ওর পেটে কোনো টিউমার নেই। হরিপ্রিয়া সন্তানসম্ভবা। এখনই অস্ত্রোপচারের কোনো প্রয়োজন নেই।

শুধু ডাক্তারি নয় অন্যান্য বিষয়েও কাদম্বিনীর আগ্রহ ছিল। যেমন রাজনীতি, অবশ্য সেক্ষেত্রে স্বামী দ্বারকানাথ ছিলেন তাঁর প্রধান উৎসাহদাতা।

১৮৮৯ সালে বোম্বাই শহরে জাতীয় কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে যে ছয়জন নারী প্রতিনিধি ছিলেন তার মধ্যে ছিলেন কাদম্বিনী। রমাবাঈ রানাড়ে, লেখিকা স্বর্ণকুমারী দেবী, যোপান্দ, আমেদাবাদের সমাজ সংস্কারক মহীগৎরাম নীলকণ্ঠের স্ত্রী। ১৮৯০ সালে কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনে কাদম্বিনী ইংরেজিতে বক্তৃতা করেন। তিনি কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তা। কাদম্বিনীর ওপর সভাপতিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের ভার অর্পিত হয়। ১৯০৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের মহিলা সম্মেলনে তাঁর অবদান ছিল বিরাট। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজির সত্যাগ্রহের সমর্থনে তিনি কলকাতায় সভা করেছেন। ১৯২২ সালে কবি কামিনী রায়ের সঙ্গে বিহার ওডিশায় নারী শ্রমিকদের অবস্থা নিরূপণের উদ্দেশে গঠিত তদন্ত কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।

দ্বারকানাথ অসুস্থ হয়ে পড়লে পর কাদম্বিনী দিনরাত সেবা করেছেন। অবশেষে ১৮৯৮ সালে ২৭ জুন তাঁর জীবনাবসান হয়। দ্বারকানাথ যেদিন মারা যান, সেদিন বিকেলে একজন মহিলাকে প্রসবে সাহায্য করতে পৌঁছে যান কাদম্বিনী। এইরকম আচরণে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করলে কাদম্বিনীর উত্তর ছিলঃ ‘‘যে গেছে সে তো ফিরবে না, যে আসছে অর্থাৎ নবাগতকে আশীর্বাদ করো।’’

১৯২৩ সালের ৩ অক্টোবর কাদম্বিনীর জীবনাবসান হয়। জীবনের শেষ দিনও অস্ত্রোপচার করেছেন। অপারেশন থিয়েটার থেকে বাড়ি এসে পুত্রবধূ সরলাকে বললেন - লোকে বলছে ডাঃ গাঙ্গুলি নাকি বুড়ো হয়ে গেছে, তার হাত আগের মতো চলে না। আজ যে অপারেশনটা করেছি তা দেখে এ কথা বলতে কেউ সাহস পাবে না। পুত্রবধূকে খাবার তৈরি করতে বলে নিজের ঘরে গেলেন। শাশুড়ির দেরি দেখে সরলা তাঁর ঘরে গিয়ে দেখেন যন্ত্রণায় ছটফট করছেন - অনেক কষ্টে বললেন ‘ডাক্তার। বরফ।’ তারপর সব শেষ। ব্যাগে যে টাকা পাওয়া গিয়েছিল তা দিয়েই তাঁর শেষকৃত্য হয়। একষট্টি বছরের কর্মজীবনের পরিসমাপ্তি।

আমরা বিস্মিত হই ১৯৬১ সালে জন্মশতবর্ষে এই বাংলায় তাঁর জন্য কোনো স্মরণ অনুষ্ঠান হয়নি। আজও ১৮ জুলাই তাঁর জন্মদিন পালন হয় না।