৫৯ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৫ জুলাই, ২০২২ / ৩০ আষাঢ়, ১৪২৯
প্লাস্টিক নিয়ে কৌশলী আইন ভারত সরকারের
তপন মিশ্র
সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক (এসইউপি) বা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের উপর গত ১ জুলাই থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই তালিকার মধ্যে মাত্র ২১টি প্লাস্টিক উপকরণ রয়েছে। আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে প্লাস্টিক উপকরণগুলি ব্যবহার করি এই তালিকা সেই তুলনায় হিমশৈলের উপরিভাগ মাত্র। কুয়োর দড়ি, বালতি থেকে মোবাইল সেট এবং গাড়ির অভ্যন্তর পর্যন্ত কয়েক শত ধরনের প্লাস্টিকজাত উপকরণ আমরা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করে থাকি। এর কারণ প্লাস্টিক দামে সস্তা এবং এর কাঁচামাল সহজে পাওয়া যায়। এর মধ্যে মাত্র ২১টির উৎপাদন, বিপণন এবং ব্যবহার কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ হয়েছে। এই আইন ভঙ্গ করলে পরিবেশ রক্ষা আইন (ইপিএ)-এর ধারা অনুযায়ী ৫ বছর পর্যন্ত জেল এবং ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
সন্দেহ নেই যে, প্লাস্টিকের নিষিদ্ধ উপকরণগুলির উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাবে অনেক বড়ো পরিবেশগত বিপদ আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা যে আগে ছিল না তা নয়। কিন্তু যে বিষয়গুলি ভাবার আছে তা হলো, কোনরকমের প্রস্তুতি এবং বিকল্প ভাবনা ব্যতিরেকে এই নিষেধাজ্ঞাকে নতুন করে জারি করায় বেশ কয়েকটি প্রশ্ন আমাদের সামনে উঠে এসেছে।
সমস্ত ধরনের প্লাস্টিক উপকরণ (কেবল সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক নয়), জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে আমরা যা ব্যবহার করি, তা সবই বিশ্বের জলবায়ুর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কারণ প্লাস্টিক উৎপাদনের পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন হয়। ১ টন যে কোনো প্লাস্টিক উৎপাদন করলে ৫ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয় অর্থাৎ অনুপাত হলো ১:৫। অর্থাৎ প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ হোক বা প্লাস্টিকের চেয়ার সমস্ত ক্ষেত্রেই দূষণের পরিমাণ একই। তাহলে প্রথম ধাক্কায় জলের বোতল, ঠান্ডা পানীয়ের বোতল, পেট (polyethylene terephthalate) বোতল এই সমস্ত কিছুই নিষিদ্ধ তালিকায় আসা উচিত ছিল। এই বোতলগুলির সিংহভাগই বহুজাতিক কোম্পানিগুলির তৈরি ভোগ্যপণ্য প্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিপণন হয়। তাই কী এগুলি তালিকার বাইরে? বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১২ লক্ষ জলের বোতল ব্যবহার হয়।
এসইউপি-র উপর নিষেধাজ্ঞা একটি ভালো কাজের শুরু হলেও সফল হওয়ার জন্য এই আইনের যথাযথ প্রয়োগের প্রয়োজন। এই যথাযথ কথাটির মধ্যে উৎপাদন এবং বিপণনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের জীবিকার প্রশ্ন, মেট্রো শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত প্লাস্টিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের উপর নজরদারি, যে পরিমাণ এই ধরনের উপকরণ এখনো জমা আছে সেগুলির জন্য ছোটো বিপণনকারীদের যে আর্থিক ক্ষতি হবে তা সহানুভূতির সঙ্গে দেখা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। আইনে যে ব্যবস্থা আছে তা হলো, নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে কীনা তার উপর নজরদারি করবে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদগুলি। এটা আইনের কথা হলেও আসলে বাস্তবে কার্যকরী নয়। এর কারণ হলো, কেন্দ্রীয় সংস্থার তো নেয়-ই রাজ্যস্তরীয় কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদগুলিতেও এত কর্মী নেই যাদের মাধ্যমে দেশজুড়ে নজরদারি করা যায়।
প্লাস্টিক বিজ্ঞপ্তিতে কী আছে?
এদেশের শহরগুলিতে যে কঠিন বর্জ্য প্রতিদিন তৈরি হয় তার মধ্যে প্রায় ৭ শতাংশ হলো প্লাস্টিক উপকরণ। প্রতিদিন গ্রাম শহর মিলিয়ে ২০,০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। এদেশে বছরে প্রায় ২০ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়। এর ৬০ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হয়, বাকিটা বর্জ্যের সঙ্গে মিশে যায়। প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার কোনো সমাধান নয়, কারণ এটি পুনর্ব্যবহার হলে তার মান আরও হ্রাস পায় অর্থাৎ “ডাউনসাইক্লিং” হয়। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া বোঝায় যেখানে উচ্চ-মানের প্লাস্টিক নিম্ন মানের নতুন প্লাস্টিকে পরিণত করে ডাউনসাইক্লিং পদ্ধতি প্লাস্টিকের আয়ু কমিয়ে দেয়। স্বাভাবিক নিয়মে আবার বর্জ্য পরিণত হওয়ার আগে খুব ভাল মানের প্লাস্টিক সাত থেকে আটবার রিসাইকেল করা যেতে পারে। এগুলি নিশ্চয় ভয়ঙ্কর তথ্য। কিন্তু এর চেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, সরকারের পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ এবং যেগুলি এখনও বৈধভাবে বাজারে রয়েছে সেগুলির পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব অবজ্ঞা করা।
১ জুলাইয়ের বিজ্ঞপ্তির ভিত্তি হলো, ২০২১ সালের ১২ আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন, এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক (MoEFCC)-এর তৈরি আইন যার নাম ‘The Plastic Waste Management Amendment Rules, 2021’। এই আইনেই ২১টি দ্রব্যকে ‘স্বল্প ব্যবহার যোগ্যতা এবং উচ্চ আবর্জনা সম্ভাবনার’ কারণে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্বল্প ব্যবহার যোগ্যতা (low use potential) হলো, যে সমস্ত প্লাস্টিক উপকরণ একবার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয় এবং উচ্চ আবর্জনা সম্ভাবনা (highwastepotential) হলো যেগুলি জলাভূমি, নদী এবং নিকাশি নালাতে পাওয়া যায়।
তালিকার মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিক স্টিক, কানের বাড, বেলুন, পলিস্টাইরিন (থারমোকল), প্লাস্টিক পতাকা এবং ব্যানার (১০০ মাইক্রনের নিচে), প্লাস্টিক প্লেট, গ্লাস, কাপ, কাঁটা চামচ, ছুরি, চামচ, সিগারেট প্যাকেট, ৭৫ মাইক্রনের নিচে ক্যারিব্যাগ ইত্যাদি। ভারত সরকারের রাসায়নিক এবং পেট্রোকেমিক্যাল দপ্তরের তৈরি এক বিশেষজ্ঞ কমিটি এই তালিকা তৈরি করেছে।
ই-কমার্স প্যাকেজিংয়ে প্লাস্টিক
ওসিয়ানা (Oceana) একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যারা সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে প্রচার, তথ্য সংগ্রহ ও নিয়ন্ত্রণের কাজ করে। এই সংস্থা ই-কমার্স প্যাকেজিংয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে যে, অ্যামাজন ই-কমার্স কোম্পানি ২০২০ সালে ৫৯৯ মিলিয়ন পাউন্ড প্লাস্টিক প্যাকেজিং বর্জ্য তৈরি করেছে। এটি ২০১৯ সালের তুলনায় ২৯ শতাংশ বেশি।
‘সায়েন্স’ নামক বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি গবেষণার ফলাফলের সাথে ই-কমার্স প্যাকেজিং তথ্য একত্রিত করে ওসিয়ানা জানাচ্ছে যে, বিশ্বের সমস্ত জলপথ প্লাস্টিক প্যাকেজিং বর্জ্যের দ্বারা ব্যাপকভাবে দূষিত হয়েছে। ওসিয়ানা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের ১৪০০ অ্যামাজন প্রাইম গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছে যে, এদের মধ্যে ৯৪.৮ শতাংশ সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। ৯১ শতাংশ বলছেন যে, অ্যামাজনের প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের ব্যবহার কমানো উচিত। গ্রাহকরা চান, অ্যামাজন এবং অন্যান্য বড়ো বড়ো অনলাইন খুচরা বিক্রেতারা প্লাস্টিক-মুক্ত প্যাকিংয়ের ব্যবস্থা করুক। আমাদের দেশে যে আইন আছে এবং তার ভিত্তিতে যে নতুন বিজ্ঞপ্তি জারি হলো সেখানে এই ই-কমার্সের প্যাকেজিং ইত্যদি সম্পর্কে কোনো বক্তব্য নেই। তা করলে বহুজাতিকদের তোষণ কী করে সম্ভব হবে?
সরকারের কোনো ইতিবাচক ভাবনা নেই
যে সমস্ত এলাকায় প্লাস্টিকের ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয় সেখানে বর্জ্য সংগ্রহ এবং সেগুলিকে আলাদা করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। অনেক শহরে বর্জ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা থাকলেও পচনশীল এবং প্লাস্টিক বর্জ্য আলাদা করার পদ্ধতি নেই। ফলে বর্জ্য বর্জ্যই থেকে যায়।
আমাদের দেশে প্লাস্টিক সম্পর্কে গবেষণা এবং উন্নয়নের কাজ একদমই অপ্রতুল। এ ব্যাপারে সরকারের কোনো সদিচ্ছা নেই। এখনই যা করা দরকার তা হলো, বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের বিকল্প খুঁজে বার করা। আমাদের দেশে যে বিরাট পরিমাণের কৃষির অবশিষ্টাংশ নষ্ট হয় এবং তা অনেক ক্ষেত্রেই দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেগুলিকে ব্যবহার করে ব্যাগ ইত্যাদি তৈরি করা কিছুটা বিকল্পের কাজ করতে পারে। এখানে ছোটো এবং মাঝারি উৎপাদন সংস্থাগুলিকে প্রযুক্তি দিয়ে সহযোগিতা করা সরকারের একটা বড়ো দায়িত্ব যা সরকার না করেই এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
কার্যকরভাবে এক্সটেনডেড প্রডিউসার রেসপনসিবিলিটি (ইপিআর) বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। ইপিআর হলো উৎপাদক সংস্থার উদ্যোগে তাদের ব্যবহৃত প্যাকেটগুলির বর্জ্য সংগ্রহ করে পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা করা। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক ২০১৬ সালে বর্তমানে প্লাস্টিক বর্জ্যের নিয়ম-৯-এর অধীনে ইপিআর বাস্তবায়নের জন্য একটি জাতীয় কাঠামো তৈরি করেছে। ইপিআর-এ কোন উৎপাদনগুলি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত সে সম্পর্কে আমাদের খুব স্পষ্ট হওয়া দরকার। সাধারণভাবে এই ব্যবস্থাতে যে সমস্ত প্লাস্টিক প্যাকেজিং উপাদান অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেগুলি হলো, যেমন বহুস্তরযুক্ত প্লাস্টিক, পেট, দুধের পাউচ, স্যাচেট ইত্যাদি। এই আইন থাকলেও তার প্রয়োগ হয় না কারণ সরকার বহুজাতিকদের কোনভাবেই চাপ দিতে চায় না। যত চাপ ছোটো উৎপাদনকারী এবং এই সংস্থাগুলির সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের উপর।
উদ্বেগ এবং পক্ষপাতিত্ব
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, ২১টি উপকরণের তালিকাটি যথেষ্ট নয়, কারণ প্রধান প্লাস্টিকের দূষক যেমন বহু-স্তরযুক্ত প্যাকেজিং, যা চিপসের প্যাকেট থেকে শ্যাম্পুর বোতল এবং গুটখা পাউচ পর্যন্ত সবকিছুতে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়, সেগুলি নিষিদ্ধ তালিকার মধ্যে নেই। এগুলি যে কম ক্ষতিকর তা কিন্তু নয়। অবশ্য এগুলির সঙ্গে দেশীয় বৃহৎ পুঁজি এবং বহুজাতিকদের উৎপাদিত উপকরণ যুক্ত।
উদ্বেগের একটি প্রধান কারণ হলো যে, তালিকায় সাধারণভাবে অনেক বেশি ব্যবহৃত হয় এমন মাল্টি-লেয়ার প্লাস্টিক (এমএলপিএস) এবং সেইসাথে প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার কোনো উল্লেখ নেই। এগুলি অবশ্যই বর্জ্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমাদের আশেপাশের নিকাশি নালা, জলাভূমি, নদী এবং মহাসাগর থেকে পাহাড়ের শিখর পর্যন্ত সর্বত্র এগুলি পাওয়া যায়।
চিপস বা গুটখা বা খাদ্যপণ্যের প্যাকেটে ব্যবহার করা হয় বহু-স্তরযুক্ত প্লাস্টিক। এগুলি মূলত বড়ো এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলির পণ্য। এগুলি সমস্যাবহুল কারণ এগুলি প্রায় পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়। এর কারণ হলো, এই প্লাস্টিকের সাথে অ্যালুমিনিয়াম বা কাগজের দুই বা ততোধিক স্তর রয়েছে ফলে এগুলি পুনর্ব্যবহার করা যায় না বা করতে গেলে যে খরচ হয় তা অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হয় না। এই বিজ্ঞপ্তিটি ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে যে, আন্তর্জাতিক এবং দেশের বড়ো ব্র্যান্ডগুলি এই আইনে মোটেই প্রভাবিত হবে না। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারা হলো ছোটো বিনিয়োগকারী।
ভারতে এই মুহুর্তে এই ২১টি দ্রব্য উৎপাদনে প্রায় ৮৮ হাজার ইউনিট কাজ করছে এবং এর সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ। এদের জন্য কোনো বিকল্প রোজগারের প্রস্তাব এই বিজ্ঞপ্তিতে নেই। অর্থাৎ এই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের রুজির উপর আঘাত পড়বে। এদের পাশে দাঁড়ানোর কোনো সদিচ্ছাও সরকারের নেই।