৬১ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ২৮ ভাদ্র, ১৪৩০
৬ রাজ্যের ৭টি বিধানসভার উপনির্বাচনে বিজেপি কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৬ রাজ্যের ৭টি বিধানসভার উপনির্বাচনে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি জোর ধাক্কা খেয়েছে। লাগামহীন রিগিং ও সন্ত্রাস করে ত্রিপুরার দু’টি আসন কবজা করা এবং উত্তরাখণ্ডের বাগেশ্বর আসনটি বিরোধীদের একাধিক পার্টির লড়াইয়ের সুযোগে ধরে রাখতে পেরেছে বিজেপি। অন্যদিকে বাকি ৪টি আসনেই জয়ী হয়েছে বিরোধীরা।
গত ৫ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের ১টি, ত্রিপুরার দু’টি, উত্তরাখণ্ডের ১টি, উত্তরপ্রদেশের ১টি, ঝাড়খণ্ডের ১টি এবং কেরালার ১টি বিধানসভার আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
বিরোধীদের সম্মিলিত মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’ গঠিত হবার পর এই প্রথম দেশে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। আগামী লোকসভা নির্বাচন ও তার আগে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, তেলেঙ্গানা ও মিজোরাম বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই ফলাফল বিজেপি’কে যথেষ্টই চাপে ফেলে দিয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের ঘোসি কেন্দ্রে ব্যবধান দ্বিগুণ বাড়িয়ে ফের নির্বাচিত হয়েছেন সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী সুধাকর সিং। তিনি ৪২,৭৫৯ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন বিজেপি প্রার্থী দারা সিং চৌহানকে। ২০২২ সালে মৌ জেলার ঘোসি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিল সমাজবাদী পার্টি। এবারের বিজেপি প্রার্থী দারা সিং চৌহান সেবারে সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন। তারপর তিনি জুলাই মাসে বিধায়কপদে ইস্তফা দিয়ে বিজেপি-তে যোগ দেন। তাঁর ইস্তফার জন্যই এই কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিজেপি তাকেই প্রার্থী করে। এবারে সমাজবাদী পার্টির প্রার্থীকে সমর্থন জানিয়েছিল কংগ্রেস, সিপিআই(এম), সিপিআই, আরএলডি, আপ, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও সুহেল দেব স্বাভিমান পার্টি। ঘোসি কেন্দ্রে বিপুল ভোটে জয়ের পর সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ সিং যাদব বলেছেন, এই জয় ‘ইন্ডিয়া’র। আগামী লোকসভা নির্বাচনেও এই জয়ের ধারা অব্যাহত থাকবে।
বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ডে মন্ত্রী চন্দনরাম দাসের মৃত্যুতে বাগেশ্বর কেন্দ্রে ফের ভোট নেওয়া হয়। ২০২২ সালের বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থীর জয়ের ব্যবধান যেখানে ছিল ১২ হাজারের বেশি, এবারে সেখানে মাত্র ২ হাজারের কিছু বেশি ভোটে জয়ী হয়েছে বিজেপি। উল্লেখ্য, এবারে এই কেন্দ্রে বিজেপি’র বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টি তাদের প্রার্থী দিয়েছিল। ভোটের হিসেবে দেখা যাচ্ছে এবারে বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রার্থী দিলে এই আসনটি বিজেপি নিশ্চিতভাবেই হারাত।
ঝাড়খণ্ডের ডুমরি বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি সমর্থিত আজসু পার্টির প্রার্থী যশোদা দেবীকে ১৭,১৫৩ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার (জেএমএম) প্রার্থী বেবি দেবী। তিনি পেয়েছেন ১,০০৩১৭ ভোট। অপরদিকে আজসু প্রার্থী পেয়েছেন ৮৩,১৬৪ ভোট।
কেরালার পুথুপল্লি বিধানসভার উপনির্বাচনে জয়লাভ করেছেন ইউডিএফ’র কংগ্রেস প্রার্থী চণ্ডী ওমেন। তিনি ৩৭ হাজার ৭১৯ ভোটের ব্যবধানে এলডিএফ’র সিপিআই(এম) প্রার্থী জে. সি. টমাসকে পরাজিত করেছেন। কংগ্রেস পেয়েছে ৮০,১৪৪ ভোট, অপরদিকে সিপিআই(এম) পেয়েছে ৪২,৪২৫ ভোট। এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থীর জামানত জব্দ হয়েছে। প্রসঙ্গত, এই কেন্দ্রে ১৯৭০ সাল থেকে পরপর ১২বার একটানা জিতেছেন কেরালার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা ওমেন চণ্ডী। তাঁর পুত্র চণ্ডী ওমেন সহানুভূতির হাওয়ায় এবারে জয়ী হয়েছেন।
এদিকে নির্বাচন পর্ব শুরু হওয়া থেকে ভোটের দিন এবং গণনা কেন্দ্রে ব্যাপক হামলা, সন্ত্রাস, রিগিং, কারচুপি, জালিয়াতি করে ত্রিপুরার বক্সনগর ও ধনপুর কেন্দ্র দু’টি নির্লজ্জভাবে দখল করেছে বিজেপি। উপনির্বাচনের দিন বিজেপি’র বেপরোয়া লাগামহীন সন্ত্রাস, রিগিং সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ছিল। এর প্রতিবাদে ভোট গণনা বয়কট করে বামফ্রন্ট। এর আগে ব্যাপক রিগিং-সন্ত্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রহসনের ভোট বাতিল করে পুনরায় ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছিল বামফ্রন্ট।
বক্সনগর আসনে বিজেপি’র তফজ্জল হোসেন পেয়েছেন ৩৪,১৪৬ ভোট, সিপিআই(এম) প্রার্থী সেখানে পেয়েছেন মাত্র ৩,৯০৯ ভোট। অন্যদিকে ধনপুর আসনে বিজেপি প্রার্থী বিন্দু দেবনাথের ঝুলিতে গেছে ৩০,০১৭ ভোট, সেখানে সিপিআই(এম) প্রার্থী কৌশিক চন্দ পেয়েছেন ১১,১৪৬ ভোট।
এই ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো এক বিবৃতিতে বলেছে, ত্রিপুরার দুই বিধানসভা কেন্দ্রের ফলাফলে বামফ্রন্টের আশঙ্কাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। ত্রিপুরার এই ভোট বাতিল করে কঠোর নজরদারিতে নতুন করে নির্বাচনের দাবির যথার্থতাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পলিট ব্যুরো বলেছে, বক্সনগরে ৮৯ শতাংশ এবং ধনপুরে ৭১ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছে বিজেপি। সে রাজ্যের নির্বাচনী ইতিহাসে এই ফলাফল একেবারেই বেনজির। বক্সনগরে গত ফেব্রুয়ারিতেই সিপিআই(এম) প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছিল বিজেপি। ফলে বোঝাই যায়, বিরাট মাত্রার রিগিং ছাড়া সেখানে বিজেপি’র পক্ষে কোনোভাবেই ৮৯ শতাংশ ভোট পাওয়া সম্ভব নয়।
পলিট ব্যুরো স্পষ্টতই বলেছে, প্রশাসন ও পুলিশের যোগসাজশে ব্যাপকমাত্রায় রিগিং চালিয়ে ত্রিপুরার নির্বাচনকে প্রহসনের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে বিজেপি। এই ভোট বাতিল করে সে রাজ্যে কঠোর নজরদারিতে ফের নতুন করে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে পলিট ব্যুরো।
পশ্চিমবঙ্গের ধূপগুড়ি কেন্দ্রটি এবারে বিজেপি’র কাছ থেকে দখল করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী নির্মলচন্দ্র রায় ৪,৩০৯ ভোটের ব্যবধানে বিজেপি প্রার্থী তাপসী রায়কে পরাজিত করেছে। এখানে তৃণমূল পেয়েছে ৯৭,৬১৩ ভোট, বিজেপি পেয়েছে ৯৩,৩০৪ ভোট। শতাংশের হিসেবে তৃণমূল পেয়েছে ৪৬.২৮ শতাংশ এবং বিজেপি পেয়েছে ৪৪.২৩ শতাংশ।
এই কেন্দ্রে বামফ্রন্ট মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী ঈশ্বরচন্দ্র রায় পেয়েছেন ১৩,৭৫৮ ভোট, শতাংশের হিসেবে ৬.৫২ শতাংশ। তিনি ফলাফল প্রকাশের পর বলেছেন, ভোটে আমাদের পরাজয় হয়েছে। আমরা জনগণের রায় মাথা পেতে নিচ্ছি। একই সঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের রুটি-রুজির দাবিতে আমাদের লড়াই জারি থাকবে।
ধূপগুড়ি কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলাফল প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, তৃণমূল জিতেছে বলে প্রচারে এলেও প্রকৃতপক্ষে জিতেছে আরএসএস’র বিভাজনের রাজনীতি। নির্বাচনের মুখে ‘বিজেপি বাড়ছে’ বলে মুসলমানদের ভয় পাওয়ানো, আর তৃণমূল ‘মুসলমানদের দালাল’ হয়ে গেছে বলে বিজেপি’র পক্ষে প্রচার চালানো হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমরা বামপন্থীরা প্রতিটি ইঞ্চিতে ধৈর্য ধরে লড়াই করে চলেছি। মানুষের ঐক্য বিস্তার করার চেষ্টা করছি।