৬১ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ২৮ ভাদ্র, ১৪৩০
কলোনি ও বস্তির ওপর বুলডোজারের হামলা রুখতে হবে
দীপক ভট্টাচার্য
নদিয়ার ধুবুলিয়ায় বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে ঈশ্বরপল্লি।
উন্নয়নের নামে গরিব মানুষকে বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ বর্তমান শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। প্রান্তিক মানুষকে নির্মমভাবে নিরাশ্রয় করার একের পর এক ঘটনা যেভাবে সারা দেশ সহ আমাদের রাজ্যে ঘটে চলেছে তার বিরুদ্ধে জনচেতনা বৃদ্ধি করা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও নিজভূমিতে পরবাসী হয়ে উচ্ছেদের ঘটনা ভারতের জন্মলগ্নের ইতিহাসে এক চরম নির্মম, অমানবিক ও করুণ অধ্যায়। দেশভাগের বলি ছিন্নমূল মানুষের বিরাট অংশ এখনও সঠিক পুনর্বাসন পায়নি। লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তর বাসস্থানের অধিকার এখনো নিশ্চিত করেনি সরকার। মানব সমাজের অগ্রগতির স্বার্থেই উদ্বাস্তু সমস্যা দ্রুত নিরসনের প্রয়োজন। আমাদের দেশের এই সমস্যা জাতীয় সমস্যা ও তার সমাধানের দায় সরকারের। আজ দেশভাগের সহযোগীরাই কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায়। অন্যদিকে রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকার উদ্বাস্তুদের সমস্যা নিয়ে উদাসীন। বামফ্রন্টের আমলের পুনর্বাসন নীতি বর্জন করে উদ্বাস্তুদের ক্রমশ সংকটের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে এই সরকার।
বহু বঞ্চনার শিকার উদ্বাস্তুরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে প্রশাসনের উপর ভরসা না রেখে একসময় গড়ে তুলেছিল জবরদখল কলোনি। সাত দশকের বেশি সময় ধরে বামপন্থীরা ও উদ্বাস্ত গণসংগঠন ইউসিআরসি’র নেতৃত্বে ধারাবাহিক সংগ্রামে বহু শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে কলোনির স্বীকৃতি। পরবর্তীকালে বামফ্রন্ট সরকারের মানবিক প্রচেষ্টায় উদ্বাস্তরা জমির পূর্ণস্বত্বের অধিকার পায়। তাসত্ত্বেও স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরেও প্রায় ১৮০০ কলোনি কেন্দ্রীয় সরকারের স্বীকৃতি পায়নি। নিঃশর্ত দলিল প্রাপকের ৬০ শতাংশ এখনো পরচার অধিকার পায়নি। কলোনিগুলোকে বসবাসযোগ্য করার ও উন্নয়নের কাজে অর্থ বরাদ্দ না করায় কলোনি উন্নয়ন স্তব্ধ। বিভিন্ন রাজ্যে পাঠানো বসবাসকারী উদ্বাস্তুদের দুর্দশা আরও চরমে। এখনো বহু উদ্বাস্তু মানুষের ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তাটুকু নেই। সরকারি উদাসীনতায় উদ্বাস্তু স্বীকৃতি পত্র অনেকেরই না থাকার সুযোগ ব্যবহার করছে কায়েমি শক্তি।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সিএএ, এনআরসি, এনপিআর ইত্যাদির মধ্য দিয়ে উদ্বাস্তুদের ‘ঘুষপেটিয়া’, ‘উইপোকা‘, ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘শরণার্থী’ আখ্যা দিয়ে উদ্বাস্তুদের অসম্মান করে তাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। বিভাজনের ও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে উদ্বাস্তুদের ব্যবহার করায় বাড়ছে নতুন করে উদ্বাস্তু হওয়ার ভয়। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার পুনর্বাসনের দায়িত্বকে অস্বীকার করে যেমন দপ্তর তুলে দিয়েছে, তেমনি রাজ্য সরকার পুনর্বাসনের কাজ অর্ধসমাপ্ত রেখে দপ্তর গুটিয়ে আনছে। তার প্রভাব উচ্চ আমলা থেকে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে পড়েছে। এখনও ৮টি ক্যাম্পে অবহেলায় থাকা তিন শতাধিক উদ্বাস্তু সরকারের ত্রাণ নির্ভর। এর সাথে যুক্ত হয়েছে উন্নয়নের নামে উদ্বাস্তুদের ও গরিব বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ পরিকল্পনা।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা বিশ্বে ৭৮ জনে ১ জন উদ্বাস্তু বা শরণার্থী, প্রতি মিনিটে কুড়ি জন উদ্বাস্তু হচ্ছেন। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে উদ্বাস্তু সংখ্যা বেশি। রাষ্ট্রসঙ্ঘের শরণার্থী শাখার সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে এই সমস্যা তীব্রতর হচ্ছে। উদার অর্থনৈতিক, পুঁজিবাদী সংকট, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের চাহিদায় নিপীড়ন, অত্যাচার, দুর্দশা, খাদ্য সংকট, যুদ্ধ-সংঘাত, পরিবেশ দূষণ সহ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মানুষ ক্রমাগত স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে উদ্বাস্ত হচ্ছে। ইউএনএইচসি আর উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তার অধিকার, নতুন বাসস্থানের আশা হিসাবে বিভিন্ন বছরকে চিহ্নিত করলেও সেই ভাবনা যথাযথ কার্যকর করার বিষয়ে উৎসাহী নয় ভারত সরকার। মানবিক কারণে দ্রুত পুনর্বাসনের দাবিতে উদ্বাস্তুরা সোচ্চার হতেই নেমে আসছে রাষ্ট্রীয় দমন পীড়ন। একইভাবে শোষণ বঞ্চনার শিকার অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া গরিব বস্তিবাসীরাও।
কয়েক বছর আগে মার্কিন রাষ্ট্রপতির আগমন উপলক্ষে কেন্দ্রীয় সরকার নির্মমভাবে বস্তিবাসীদের ওপর বুলডোজার চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, পর্দার আড়ালে দারিদ্র্যকে ঢাকার চেষ্টা করেছিল। তারই প্রতিচ্ছবি দেখা গেল বর্তমান জি২০ সম্মেলনের প্রাক্কালে যা দেশবাসী দেখেছে। উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, আসাম সহ বিজেপি শাসিত রাজ্যের সংখ্যালঘু, দলিত, আদিবাসী, বাঙালিদের উপর ভয়ংকর বুলডোজার নীতি নিয়েছে সরকার। বিশেষ করে করপোরেটদের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ তুলে দেবার ও বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে সংবিধান সংরক্ষিত আইন পরিবর্তন করে অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। আসাম, মণিপুর, ঝাড়খণ্ড সহ বিভিন্ন রাজ্যে এধরনের একাধিক ঘটনা ঘটছে।
সম্প্রতি ওডিশার কেন্দ্রাপাড়া জেলার মহাকাল পাড়া বিধানসভায় রামনগর খরসানি পঞ্চায়েতের ১৯৫০ সালে আগত উদ্বাস্তুদের ১৯৭৬ সালে সরকার পাট্টা প্রদান করলেও পুনর্বাসন প্রাপ্ত কৃষিজীবী উদ্বাস্তুদের হঠাৎ ২০১২ সাল থেকে সরকার খাজনা নেওয়া বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে সরকার জিন্দাল গোষ্ঠীর নিপ্পন স্টিল কোম্পানির হাতে এই জমি তুলে দিয়ে পাট্টা পাওয়া উদ্বাস্তুদের উৎখাত করছে। মহামান্য হাইকোর্টের কাছে দ্বারস্থ হয়েও সুরাহা মিলছে না। আমাদের রাজ্যে তেমনি দেউচা-পাচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙায় আদিবাসীদের উৎখাতে শামিল রাজ্য প্রশাসন। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের সম্পদ আম্বানি আদানিদের হাতে তুলে দিতে দীর্ঘদিনের বাসস্থান থেকে উৎখাত করতে উদ্বাস্তু কলোনি, গরিব মানুষের বস্তির ওপর পুলিশি জুলুম, বুলডোজার নিয়ে আক্রমণ তীব্র হচ্ছে।
রেল ও সড়ক পরিবহণ দপ্তর এসময়কালে নানা জায়গায় অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ অভিযানে লিপ্ত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই রেলের জমির নিজস্ব মালিকানা সংক্রান্ত নথি না থাকা সত্ত্বেও কলোনি উচ্ছেদ হচ্ছে। নদিয়ার ধুবুলিয়ায় প্রতিরক্ষা দপ্তরের জমিতে নির্মিত সরকার স্বীকৃত ঈশ্বর পল্লিতে শাসকদলের সহযোগিতায় শতাধিক উদ্বাস্তুর ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বগুলার স্বীকৃত কলোনি সুভাষ পল্লির জমি হস্তান্তর না করে উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ করতে ই-টেন্ডার করে শাসক দলের অনুগতদের মধ্যে জমি বণ্টন করা হয়েছে। একইভাবে দুর্গাপুরে কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদিত ডঃ আম্বেদকর কলোনির ৮টি উদ্বাস্তু পরিবার সহ বস্তিবাসীদের উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে। মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। দক্ষিণেশ্বরে রেলদপ্তর বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করতে কয়েক মাসের মধ্যেই ৮ বার অভিযান চালিয়েছে। মানুষের প্রতিরোধে রেলদপ্তর সাময়িক পিছু হটেছে। বারাসতের কয়রা কদম্বগাছিতে রেলের প্রয়োজনেই অতীতে স্থানান্তরিত উদ্বাস্তুদের দ্বিতীয়বার উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। শিলিগুড়ির কাছে এনজিপি স্টেশনের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অঞ্চলেও উচ্ছেদ নোটিশ দিয়েছে রিলায়েন্সের হাতে জমি তুলে দেবার জন্য।
ফারাক্কার স্টেশন-পার্শ্ববর্তী ৭টি স্বীকৃত কলোনি রয়েছে গঙ্গার চরের খাস জমিতে যা এনটিপিসি এবং রেল ব্যারেজ নির্মাণকালীন ব্যবহার করা হয়েছিল। সেখানে কয়েক হাজার উদ্বাস্তুকে উচ্ছেদ করতে বারবার অভিযান চালানো হয়েছে। বর্তমানে মামলা করে সাময়িকভাবে স্থগিতাদেশ পেয়েছে উদ্বাস্তুরা।
হাওড়ার সাঁতরাগাছিতে কোনা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকৃত কলোনি নারায়ণ পল্লির জমি রেল হস্তান্তর না করে বারবার উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছিল। বিকল্প পুনর্বাসনের জন্য জেলাশাসককে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তর নির্দেশ দিলেও ৩০ বছর কোনো কাজ হয়নি। জমি অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর ছাড়াই বর্তমান রাজ্য সরকার এখানে দখলিস্বত্বের দলিল কয়েকটি পরিবারকে দিয়েছিল যা মূল্যহীন বলে প্রমাণিত। বর্তমানে রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য জাতীয় সড়ক বিভাগ কলোনির বাসিন্দাদের উচ্ছেদ নোটিশ দিয়েছে। যদিও ইতিপূর্বে ২২টি পরিবারকে বামফ্রন্ট সরকার এইচআইটি’র সহযোগিতায় স্থানান্তরিত করেছিল। তৃণমূলের সরকার এজাতীয় কোনো পরিকল্পনা না করে কলোনির বাসিন্দাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। এর সাথে সরকার অনুমোদিত লক্ষ্মী পল্লি, স্বরস্বতী পল্লিও উচ্ছেদের মুখে।
একইভাবে জাতীয় সড়ক দপ্তর রাস্তা সম্প্রসারণের নামে ব্যাপকভাবে উচ্ছেদ করছে। শিলিগুড়ির মাটিগাড়ায় এক্সপ্রেসওয়ে সম্প্রসারণে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ উচ্ছেদের মুখে। বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেসের পাশে কিছু পরিবারকে না জানিয়ে আদালতের নির্দেশে বহুতল আবাসনের স্বার্থে ঘর বাড়ি ভেঙেছে। আরও প্রায় তিন হাজার পরিবার উচ্ছেদের আতঙ্কে রয়েছে। অনুরূপভাবে কল্যাণী-বারাকপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে কয়েক হাজারেরও বেশি মানুষ উচ্ছেদ হয়েছেন।
উদ্বাস্তুরা বা বস্তিবাসী গরিব মানুষ উন্নয়ন বিরোধী নয়। কিন্তু বিকল্প পুনর্বাসনের পরিকল্পনা ছাড়া, কখনো শুধু করপোরেটের স্বার্থ রক্ষা করতে নির্বিচারে যে উচ্ছেদ অভিযান চলছে তাকে প্রতিহত করতে পশ্চিমবঙ্গ বস্তি উন্নয়ন সমিতি ও ইউসিআরসি সচেষ্ট। উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, শুধু জবরদখল কলোনি নয় সরকার স্বীকৃত নিঃশর্ত দলিল প্রাপ্ত কলোনিও ক্ষতিপূরণ, বিকল্প পুনর্বাসন ছাড়াই উচ্ছেদের মুখে। পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে বর্তমান রাজ্য সরকারের ভ্রান্ত নীতির সুবাদে। জমি হস্তান্তর ও অধিগ্রহণ ছাড়াই বর্তমান সরকার প্রদত্ত দখলিস্বত্বের দলিল কোথাও মান্যতা পাচ্ছে না। আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়িতে রেল দপ্তর রাজ্যের সরকারের এই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের জমিতে অবস্থিত কয়েকটি স্বীকৃত কলোনির জমি হস্তান্তর আজও অসমাপ্ত। বছরের পর বছর কালক্ষেপের পরেও উদ্বাস্তুরা স্থায়ী পুনর্বাসন পাচ্ছে না। এমনকী কয়েকটি কলোনির জমি যা রেল দপ্তর দেবে না বলে জানিয়েছিল, তাদেরকে বিকল্প জমিতে স্থানান্তরিত করতে রাজ্য, জেলা প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে তারাও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আতঙ্কিত। রাজ্য সরকারের অনীহায় পরচা রেকর্ড ভুক্তি না হওয়ায় পুরনো জমির মালিকরা আদালত, প্রশাসন, প্রোমোটার, বাহুবলীদের সহায়তায় বস্তি, কলোনি উচ্ছেদের সক্রিয়তা বাড়িয়েছে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে প্রশাসনিক মদতে ব্যাপক জমি দুর্নীতি। উদ্বাস্তু ও বস্তিবাসীরা নিরুপায় হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে ও লালঝান্ডাকেই নির্ভর করে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ, লড়াইয়ে শামিল হয়েছে। এদিকে শাসকদলও উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে মাঠে নেমেছে। রাজ্যের সর্বত্রই কলোনি ও বস্তিবাসীদের প্রতি এই অমানবিক আচরণের ফলে তাদের রুজি রোজগার, শিক্ষা সহ মৌলিক অধিকার আক্রান্ত হচ্ছে।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে রাজ্যের সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল সহ রাজ্য প্রশাসন, গণসংগঠনের পক্ষ থেকে একাধিকবার কলোনি স্বীকৃতি ও প্রয়োজনীয় অর্থের দাবি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জানানো হয়েছিল। বর্তমান রাজ্য সরকার কেন্দ্রের সাথে সখ্য, বোঝাপড়া বজায় রেখে চললেও কলোনি অনুমোদন সহ অর্থ আদায় করতে পারেনি। উপরন্তু বর্তমান রাজ্য সরকার কিছু ভুয়ো দলিল দিয়ে দাবি করছে উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। এখন রেল সহ অন্যান্য দপ্তর সরকারি জমিতে বসবাসকারীদের অবৈধ দখলদার বলে তাদের উচ্ছেদ করার জন্য রাজ্যের সহযোগিতা চেয়েছে। রাজ্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আধিকারিকদের সাথে সম্প্রতি বৈঠক করেছে। উদ্বাস্তুদের ও নিঃশর্ত দলিল প্রাপ্তদের নামপত্তন বা পরচার রেকর্ড ভুক্তি না হওয়ায় ও পুরনো মালিকের নাম থাকায় সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে।
ইউসিআরসি’র পক্ষ থেকে রাজ্য প্রশাসনে লিখিতভাবে সুনির্দিষ্ট সমস্যা সহ বারবার সমাধানের দাবি জানানো সত্ত্বেও কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় সম্প্রতি উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে। বলিষ্ঠভাবেই বলা হয়েছে যে, বিকল্প পুনর্বাসন ছাড়া কোনো স্তরেই উচ্ছেদ করা যাবে না। ১৯৫০ সালে রাজ্য বিধানসভায় উচ্ছেদ বিল বামপন্থীদের ও উদ্বাস্তুদের বিরোধিতায় সরকার প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৫১ সালের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে মামলার রায়ে দেখা যাচ্ছে (No. 148 - CA Dt. 15-7-1957 Case no 3363 Of 1951 Competent Authority under West Bengal Act XVI of 1951 for Calcutta & 24 Pagans Dt. 1-5-1957 Extract of judgment) ...The occupant has been able to prove himself to be a displaced person within the meaning of the Act and entitled to protection from eviction until alternative accommodation is furnished অর্থাৎ আদালত জানিয়েছে যে বিকল্প পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ করা যাবে না।
১৯৮৫ সালে Olga tellis vs Bombay Municipal Corporation সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, উচ্ছেদ করার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জীবন, জীবিকা এবং আবাসনের যে সাংবিধানিক অধিকার আছে তা রাষ্ট্রকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। সেক্ষেত্রে যাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে তাদের সেই জমিতে আইনি অধিকার না থাকলেও রাতারাতি গৃহহীন করে দেওয়া যাবেনা। এছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে International Covenant on Economic, Social and Cultural Rights (ICESCR), 1966-তে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে ভারত দেশের প্রত্যেকটি মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের অধিকার নিশ্চিত করা এবং নিরন্তর জীবনমানের উন্নতিসাধনের জন্য দায়বদ্ধ । বর্তমানে রেল সহ কেন্দ্রীয় সরকার যে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে তা একাধারে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ও আন্তর্জাতিক বোঝাপড়াকে খর্ব করছে। এই গর্হিত কাজ থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে। এ বিষয়ে রাজ্য সরকারেরও বিপুল দায় আছে। তাই নিষ্ক্রিয়তা কাটিয়ে রাজ্য দপ্তর ও জেলা প্রশাসনকে বকেয়া কাজ সম্পন্ন করা ও উচ্ছেদ রোধে তৎপরতা বাড়ানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে সর্বশক্তি দিয়ে যে কোনো কলোনি, বস্তি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে। সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষ ও সংগঠনকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জোটবদ্ধ প্রচার, প্রতিরোধ সংগঠিত করে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদের ধারক বাহক শাসক দলের বুলডোজার পলিটিক্সকে রুখে দিয়ে উদ্বাস্তু, বস্তিবাসী মানুষ সহ সমস্ত জনগণের বাসস্থানের অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।