৬১ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ২৮ ভাদ্র, ১৪৩০
বিপন্ন আদিবাসী সমাজ
ডাঃ পুলিনবিহারী বাস্কে
ভূমিকা
চরম দক্ষিণপন্থী, উদারবাদী, সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট শক্তি বিজেপি-আরএসএস’র শাসনে ভারতের সংবিধান নিদারুণ আক্রমণের মুখে পড়েছে। এরা কোনোদিন স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। বরং ব্রিটিশদের সহযোগিতা করবে বলে মুচলেকা দিয়েছিল। আবার সংবিধানও গ্রহণ করে নেয়নি। মনুস্মৃতি রূপায়ণের দাবি জানিয়েছিল তারা। তাদের আরাধ্য ব্যক্তি ভি ডি সাভারকর বলেছিলেনঃ ‘‘মনুস্মৃতি হলো পবিত্রতম ধর্মগ্রন্থ’ - আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নৈতিক নীতিসমূহের চালিকা শক্তির নির্দেশাত্মক নীতি এবং তা আমাদের বহু শতাব্দী অনুসৃত আধ্যাত্মিক এবং স্বর্গীয় অভিযাত্রা সংহত এবং সুনির্দিষ্ট করেছে। আজকের দিনে মনুস্মৃতিই হলো হিন্দু আইন।’’ আমরা জানি মনুস্মৃতি কেমনভাবে জাতভিত্তিক সমাজের উন্মত্ত কাঠামো গড়ে তোলে এবং আদিবাসী সম্প্রদায়কে অসুর, ম্লেচ্ছ এবং নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীরূপে বিবেচনা করে। আজকের বিজেপি-আরএসএস নেতারা কখনোই এই ভাবনা বাতিল করেননি। মনুস্মৃতির ভিত্তিতেই হওয়া উচিত ভারতীয় সংবিধান - এই ভাবনা থেকে এমনকী নিজেদের সরিয়েও নেননি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের আগ্রাসী করপোরেটমুখী নীতির ফলে বনভূমিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ করপোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে লক্ষ লক্ষ আদিবাসীদের উৎখাত করে।
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের সংবিধান পরিবর্তন করতে চাইছে। দেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন করতে চাইছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আদিবাসী মানুষের সুদীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে বিকৃত করতে চাইছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
সাম্প্রতিককালে পরিলক্ষিত হয়েছে যে, আদিবাসী মানুষ জমির অধিকার ও অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছেন। তাদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি কাজ, বর্তমানে অন্য কাজে প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। গ্রামীণ এলাকা ছেড়ে জীবিকার স্বার্থে শহরে পলায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বনাঞ্চল এলাকার বনজ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার কারণে ব্যবসাবাণিজ্য, ‘ল্যাম্পস’গুলি প্রায় বন্ধ হতে বসেছে। ভৌগোলিক কারণে দূরবর্তী ও বিচ্ছিন্ন এলাকায় বসবাসের জন্য পশ্চাৎপদতা ও দারিদ্র্য বিরাজমান। ১০০ দিনের কাজের সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত। শিক্ষিত আদিবাসী বেকার যুবক-যুবতীর সংখ্যা বাড়ছে। চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ নীতি পালন করা হচ্ছে না। শূন্য পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে।
বর্তমানে রাজ্যে ব্যাপক নকল বা ভুয়ো জাতি শংসাপত্র অর্থের বিনিময়ে পাওয়া যাচ্ছে। যারা প্রকৃত আদিবাসী নয় তারাই এই শংসাপত্র পেয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে, ফলে প্রকৃত আদিবাসী ছেলেমেয়েরা উচ্চ শিক্ষা লাভ বা চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আদিবাসীদের জমি কেনা-বেচার সঙ্গেও এই সার্টিফিকেট ব্যবহার করে আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে।
আইনসমূহ
তফশিলি জাতি এবং তফশিল আদিবাসীদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা নিবর্তনমূলক আইন পিওএ আইন বলে পরিচিত। এই আইন ১৯৮৯ সালে লাগু হয়েছিল। এবং তখন থেকে পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু সংশোধন করা হয়েছে। আইনটি আদিবাসীদের বিরুদ্ধে অ-আদিবাসী কর্তৃক সংগঠিত অপরাধের জন্য এই আইনে বিশেষ আদালত গঠন, আর্থিক সহায়তা, ত্রাণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
১৯৯৬ সালে পিইএসএ আইনের পর বনাঞ্চল অধিকার আইন ২০০৬ হলো আদিবাসী সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইন। এই আইন ভয়ঙ্কর আক্রমণের কবলে পড়েছে, কারণ আইনটি আদিবাসীদের জমিকে নয়া উদারবাদী করপোরেটদের দখলদারি থেকে রক্ষা করে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০০৬ সালে সংশোধন হয়েছিল। এই আইনের সংশোধনগুলি আদিবাসী সম্প্রদায়কে অধিকার দিয়েছিল যা আগে কোনোদিন ছিল না। এই নিরাপত্তামূলক অধিকারসমূহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যেহেতু সরকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের নামে আদিবাসী সম্প্রদায়গুলিকে উচ্ছেদ করছে। জমি অধিগ্রহণ আইনে একটি বিশেষ অংশ রয়েছে আদিবাসীদের জন্য, যাদের জমি অধিগ্রহণ করতে চাওয়া হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য আইনসমূহ শ্রমিকদের অধিকার সংক্রান্ত, শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে, মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসা, ধর্ষণ ইত্যাদি সবই আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য। সম্প্রতি পরিযায়ী শ্রমিক আইন খারিজ করা এবং শ্রমকোডের সঙ্গে ওই আইনের সংযুক্তিকরণ আদিবাসীদের উপর বিশেষ বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কারণ পরিযায়ী শ্রমিকদের বড়ো অংশই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি
এক দেশ-এক আইন - লাগু হলে আদিবাসীদের নিজস্ব পরম্পরা, রীতি-নীতি, সংস্কৃতি সমাজে পালন করার অধিকার অবলুপ্তি হবে। সিএনটি এবং এসপিটি অ্যাক্ট-এ জমির জায়গায় অধিকার থাকবে না। আদিবাসীরা জল, জঙ্গল, জমির অধিকার হারাবেন। বনাধিকার আইন ২০০৬-এর আইন থেকে তারা বঞ্চিত হবেন। পিইএসএ-১৯৯৬ আইনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। পঞ্চম তফশিল অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। প্রিভেনটিভ অব এসটি/এসসি অ্যাক্ট্রোসিটিস অ্যাক্ট ১৯৮৯ - অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। শিক্ষার ও চাকরির সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। পরিচিতি সত্তা ও নিজস্ব ধর্মপালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এটি একটি ভয়ঙ্কর কালা কানুন আদিবাসীদের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে আনতে চাইছে বিজেপি সরকার। খুব সাম্প্রতিককালের জঘন্য ঘটনা মণিপুরে লক্ষ করা গিয়েছে। রাজ্যে প্রায় ৫৩ লক্ষ আদিবাসী মানুষ। ৪০টি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ভুক্ত তাদের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতির ভিন্নতা আছে, কেন্দ্রীয় সরকার নয়া-শিক্ষানীতি চালু করার ফলে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা সরকারিভাবে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার ফলে প্রায় ৮,০০০ স্কুল বন্ধ হতে বসেছে, যেটা কীনা আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় বেশি। শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে আদিবাসী মানুষ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। অধিকাংশ আদিবাসী হোস্টেলগুলি বন্ধ, স্টাইপেন্ড বন্ধ, শিক্ষার খরচ বৃদ্ধি হওয়ার কারণে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ছুটের সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটছে। এই সমগ্র বিষয় আদিবাসী অধিকার রাষ্ট্রীয় মঞ্চের আগামী চতুর্থ সর্বভারতীয় সম্মেলনে আলোচনা করে চূড়ান্ত করতে হবে এবং আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রামের সঠিক দিশা নির্ধারণ করতে হবে।