৬১ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ২৮ ভাদ্র, ১৪৩০
নাম পরিবর্তনের আড়ালে
দেবাশিস আচার্য
যদিও আমরা বেশিরভাগই আমাদের দেশকে ভারতই বলি,কিন্তু ইন্ডিয়াতে এদেশের মানুষের কখনো কোনো আপত্তি শুনিনি, আমাদের তো বেশ ভালোই লাগে ‘‘ভারত আমার ভারতবর্ষ’’-এর সাথে ‘‘চক দে ইন্ডিয়া’’। ‘ইন্ডিয়া’কে আমাদের কারোই তো কখনোই গালাগালি বলে মনে হয়নি। তবে হ্যাঁ, ইতিহাসে লেখা আছে, ইন্ডিয়া নামে আপত্তি ছিল একজনের, তিনি হলেন সংঘের অন্যতম প্রিয়জন মহম্মদ আলি জিন্নার। পাকিস্তানের জাতির জনক তো মাউন্ট ব্যাটেনকে একেবারে চিঠি লিখে আপত্তি জানিয়ে বলেন, ভারতের নাম ইন্ডিয়া রাখা যাবেনা, ওটা অখণ্ড ভারতের প্রতীক, ইন্ডিয়া শব্দে একটা আলাদা শক্তি আছে বলেও তিনি দাবি করেন। যদিও আমাদের জাতির জনকের ইন্ডিয়া নামে কোনো আপত্তি ছিল না। (তাঁকে আজকের ‘ইন্ডিয়া’ পরিবর্তনকারীদের গুরুমশাই নাথুরামের হাতে খুন হতে হয়)
এখন এদেশের সংখীদেরও বিলম্বিত বোধোদয় হচ্ছে। জিন্নার সাথে ওদের অবশ্য নানা ব্যাপারেই সহমত আছে, জিন্নার মতো ওদেরও ধর্মনিরপেক্ষতা নাপসন্দ। ১৯৩৯ সালে ইন্ডিয়ান অ্যানুয়াল রেজিস্টারে ওদের এক প্রবক্তা তো খোলাখুলি বলেই দিয়েছেন, মিঃ জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বের সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই...’’। আচ্ছা ইন্ডিয়া বিদেশিদের দেওয়া তাই বাদ - এটা কোন যুক্তিতে! (যদিও ইন্ডিয়া ব্রিটিশদের দেওয়া নয়,হলেই বা কী? ক্রিকেট, রেল, নিউটন কি বাদ দেব) আচ্ছা কোনটা দেশি শব্দ কোনটা বিদেশি শব্দ এটা তো আমাদের মতো বহুত্ববাদী দেশে কম্বলের লোম বাছার মতো, তাহলে তো ভারত, হিন্দু এগুলোর শব্দ উৎস খুঁজলে কী হবে? ভারত শব্দের অনেক আগেই অশোকের শিলালিপিতে এই দেশকে জম্বুদ্বীপ(জামফলের দেশ) বলা হয়েছে। খারবেলের হস্তিগুম্ফা শিলালিপিতে সর্বপ্রথম লিখিতভাবে ভারত শব্দটি পাওয়া যায়। আমির খসরু ১৩৩৮ সালে ভারত বন্দনা করলেন।
ক’দিন আগে একনেতা সাংসদ তো জাতীয় সংগীত-এ পাকিস্তানের নদ সিন্ধু নামে আপত্তি জানিয়ে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন, তবে হিন্দু (এখন সনাতন বলতে ওরা বেশি স্বচ্ছন্দ) ধর্মের যেকোনো পূজার সূচনায় যে জলশুদ্ধির মন্ত্র আছে, সেখানে সিন্ধু শব্দ গঙ্গার সাথেই আদৃত (গঙ্গেচ যমুনাচৈব,নর্মদে সিন্ধু কাবেরী...) জানি না এই বৈদিক মন্ত্র পরিবর্তন করা হবে কিনা? হিন্দু মন্ত্রে পাকিস্তানের নদী, কোশাকুশিতে পবিত্র গঙ্গার সাথে পাকিস্তানের সিন্ধুর জল!
ইন্ডিয়া শব্দের পরিবর্তন, অথচ এই ইন্ডিয়া মেগাস্থিনিস থেকে মহাকবি শেকসপিয়র-এর লেখনিতে আজও অমর, নেতাজির আইএনএ, ৮৩-এর বিশ্বকাপ, লর্ডসের মাঠে, আমাদের ইতিহাসের পরতে পরতে গৌরবের সাক্ষী। ভারত আর ইন্ডিয়া এখানে একাকার, কোনোভাবেই শব্দের বিভেদে একে আলাদা করা যাবে না।
১৯৪৭-এ দেশটা টুকরো হয়েছিল, ভগৎ সিং-এর লাহোর আর মাস্টারদার চট্টগ্রামকে কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে রেখে, কিন্তু ভারত ভাবনাকে ভাঙা যায়নি, এদেশটাকেও পাকিস্তানের মতো দেশ বানানোর কারিগররা নাগপুরে ওঁত পেতেছিল, দেশের পতাকা কেন অপয়া তিন রঙের, কেন তা আয়তকার,কেন সেখানে সবুজ থাকবে, এসব প্রশ্ন তাদের কূট মনে ছিলই।আমাদের গর্বের তেরঙ্গা সেখানে বাতিল, তাদের দাবি ভাগওবা ঝান্ডাই হবে ভারতের জাতীয় পতাকা। তাদের কাছে ভারত বা ইন্ডিয়া দর্শন আপত্তিকর। তাইতো দেশের সংবিধান, তার প্রস্তাবনা, ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে সংবিধানে উল্লিখিত ইন্ডিয়া শব্দটাকে মুছে দিতে উদ্যত হয়েছে তারা।
অথচ ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে পাকিস্তানের রেডিয়োতে গান রেকর্ড করেছিলেন ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলিখান ‘‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে হায় রাম/ খেলত নন্দলালা...’’। আপত্তি উঠলো পাকিস্তানে বিধর্মী রাম আর নন্দলালা বাদ দিতে হবে গানের মুখরা থেকে। স্বয়ং জিন্না সাহেব ডেকে পাঠালেন ওস্তাদজিকে, ধীরকণ্ঠে অনুরোধ করলেন। সবিনয়ে ওস্তাদজি জানালেন যেখানে সংগীতে আল্লাহর সাথে রাম কিংবা নন্দলালা থাকতে পারবে না, সেদেশে তিনিও থাকবেন না,তাঁকে যেন ইন্ডিয়াতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জিন্না রাজি হন। ওস্তাদজি সটান চলে আসেন তাঁর ইন্ডিয়াতে রাজেন্দ্র প্রসাদের (প্রথম রাষ্ট্রপতি) কাছে। এদেশের নাগরিকত্ব চান। রাজেন্দ্র প্রসাদ সাদরে তাঁর অনুরোধ রক্ষা করেন। গুলাম আলি বলেন, তিনি বাকি জীবনটা রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কলকাতায় সংগীত সাধনা করতে চান। তারপরটা ইতিহাস। বড়ে গুলাম আলি থেকে রবিশঙ্কর বিশ্বে তুলে ধরেছেন ইন্ডিয়াকে, সাত সুরের ইন্ডিয়া। এই সাতসুরের ঐক্যতানকে বদলাতে চায় প্রায় একশো বছর ধরে ওঁত পেতে থাকা শকুনেরা।
ওদের পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশের কাছে মুচলেকা দিতে লজ্জা পায়নি, সারা পৃথিবীর ঘৃণিত ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির পথপ্রান্তে বসে বিজাতীয় ফ্যাসিজমের দীক্ষা নিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। ওরা হঠাৎ করে ইন্ডিয়া ব্রিটিশের শব্দ তাই একে বাতিল করতে হবে বলে মিথ্যা দেশপ্রেমের পাঠ দেবে? আসলে এর মধ্যে লুকিয়ে আছে ভয়ানক খেলা, যে খেলা ওদের পূর্ব পুরুষেরা হিটলার-মুসোলিনির কাছ থেকে শিখেছিলেন,এর নাম উগ্র জাতীয়তাবাদ, দেশ, দেশের মানুষ, তাঁদের জীবন-জীবিকা-সংস্কৃতি গোল্লায় যাক। একেই আমাদের রুখতে হবে। বিশ্বের যা কিছু ভালো, শুভংকর তাকে গ্রহণ করা আমাদের সংস্কৃতি। আবার যা কিছু ক্ষতিকর তাকে পরিহার করতে হবে ঘৃণাভরে,তা সে দেশি-বিদেশি যাই হোক। তাই আমরা রবীন্দ্রনাথ-এর সাথেই শেকসপিয়র, রুশো, গোর্কি নেব, হিটলার মুসোলিনি-সাভারকরদের বর্জন করব। ‘ভারত’ ‘ইন্ডিয়া’র লড়াই লাগিয়ে এদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য বহুত্ববাদকে মুছে ফেলা আর মানুষের মৌলিক সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর এই কৌশলকে রুখতে হবে সব দেশপ্রেমিক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের মজবুত ঐক্য দিয়েই।